স্থায়ী কমিটি : স্টেডিয়ামে নারীদের খেলার পরিবেশ নিশ্চিতের সুপারিশ

আগের সংবাদ

দফায় দফায় বাড়ছে ওষুধের দাম : দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ক্যাবের, দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ রোগে ভুগে মারা যাবে

পরের সংবাদ

নিয়তি রুদ্র শাহীন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভোর হয়ে আসছে।
সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল। ঊষার দুয়ার খোলার পরপরই চমৎকার দৃশ্য। চারিদিক ফকফকা। এই ফ্ল্যাটের গা ঘেঁষে আছে সজিনা গাছ। গাছটা খুব বয়স্ক। মূল গাছটা-তো আছেই, পাশাপাশি শাখা-প্রশাখাগুলোও আশির বুড়োর মতো সাত বাঁকা। প্রতিটি ডালে লম্বা লম্বা হয়ে ঝুলে ঝুলে আছে শিম। আধো আধো বাতাসে দোল খাচ্ছে। ভাঙা একটি ডালে দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে আছে একটি কাক। একেবারে নিঃসাড় হয়ে। কী হয়েছে কে জানে। চুপচাপ।
কাকটার গায়ে ভোরের আলো পড়েছে। ফলে তার ছায়া লম্বা-লম্বি হয়ে ফ্ল্যাটের জানালা ভেদ করেছে। প্রবেশ করেছে ঘরের ভেতর। এই ফ্ল্যাটের জানালা খোলা নিষেধ। ব্যবসার খাতিরে এমন নিয়ম চালু করেছে জোহরা সর্দারনি।
ভোরের ঝলমল আলো দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল কুসুম। তাই একটুখানি জানালা খুলে দিয়েছিল। বেবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল কাকটার দিকে।
জানালাটা খোলা দেখে সহকর্মী মিনু চেঁচিয়ে উঠে। তীব্র গলায় বলতে থাকে- জানালা খোলা কেন? সর্দারনি এসে দেখলে তোর ভোদা ভেঙে চুরমার করবে।
মিনুর কথাটা শুনে তত বিচলিত হয়নি, বরং ধীরে ধীরে গ্রীবাটা বাঁকা ফিরে তাকায় কুসুম। হতাশার কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- এখন সর্দারনি কোথায়?
ইতস্ততবোধ করছিল মিনু। সে ভেবেছিল কুসুম থতমত খেয়ে বসবে। ভয় পেয়ে যাবে। আঙ্গুলের ডগায় থুথু লাগিয়ে বুকে ঘষা দিয়ে, চোখ টান টান করে বলবে- এভাবে কি কেউ চেঁচামেচি করে? এটাতো চেঁচামেচির স্থান নয়…
কুসুম মøানস্বরে জিজ্ঞেস করে- থেমে গেলি কেন? আর কিছু বলার আছে?
মিনু নিস্তব্ধ হয়ে রইল।
কুসুম ভ্রæ-কুচকে বললো- ব্যাপার কী? হঠাৎ করে আমার মতো ভাবুক মানুষ হয়ে গেলি ক্যান?
কথাটা শুনে মিনু খিলখিল করে হাসে। চাপা উত্তেজিত হইয়া পুনরায় জিজ্ঞেস করে- জানালার লগে দাঁড়াইয়া কবি হয়ে গেলি নাকি?
কথাটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুসুম।
মিনু অতি আবদার করে আবার নিচুস্বরে বলে- বাদ-দে বইন, ভাববার কিছুই আর নেই। কপালে যা লেখা ছিল- তা ঘটবে। আয় চল, হাত-মুখ ধুইয়া ল। এক সাথে চা- নাস্তা করুম।
কখন যে দরজার সামনে জোহরা এসে দাঁড়িয়ে আছে একটু টের পায়নি। দু’হাত দরজার দু’প্রান্তে দিয়া, আঁচলটা কোমরে গিট বাঁধিয়া, বীর পুরুষের মতো সিগ্রেটে সুখটান মারে। আর বৃষগরুর মতো শ্বাস ফেলে। কী অদ্ভুত কাণ্ড!
দৃশ্যটা দেখে থতমত খেয়ে বসে কুসুম আর মিনু। পুরোপুরি ফিরে তাকায়। হাঁটু দুটি কাঁপে, তবে কিছু জিজ্ঞেস করার মতো সাহস পাচ্ছে না।
জোহরা সর্দারনি সিগ্রেটে আরও একবার সুখটান দিয়ে যায়। চেঁচিয়ে উঠে কর্কশ ভাষায় বলতে থাকে- এই মিনু, তারে এত বোঝানোর দরকার কী? সে-তো পুরান মাগী। নতুন একজন কিনে এনেছি। তারে বুঝাইয়া শিখাইয়া ঠিক কর…
ভাঙা গলায় মিনু বলে- ঠিক আছে।
-যা, এক্ষুনি- যা।
কথাগুলো শুনে মিনুর গায়ের পশম তাল গাছ হয়েছে। কিন্তু করার মতো কিছু নেই। আর পাশের মানুষ কুসুমের মুখ খানিতে ছাই রঙ ধরেছে। কাঁপছে থর থর করে।
জোহরা পুনরায় জেগে উঠে। ভারী ভারী গলায় কুসুমকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে- এই মেয়েরে দেড় লক্ষ টাকা পুঁজি খাটাইয়া এখানে এনেছি। আজ তিন মাস পার হয়ে গেছে। এখনো অর্ধেক টাকা উঠে আসেনি।
হতভম্ব হয়ে আছে মিনু। ভ্যাল ভ্যালে চোখ দুটি মেলে সর্দারনির ঠোঁটের পানে চেয়ে আছে।
দাঁত কটমট কটমট করিতে করিতে সর্দারনি বলেই যাচ্ছে। বলছে- মেয়েরে এত করে বুঝাইলাম- একটু মেকআপ-টেকআপ করে ইস্টিন্ডার হইয়া থাকার জন্য। কাষ্ঠমারদের সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু মাগী আমার সব কথা কানের বাহিরে রাখে। পাত্তাই দে না।
মিনু একটু বাঁকা চোখ করে তাকায়। এই সল্প সময়ের ভেতরে কুসুমের দু’চোখ ভরে গেছে জলে। টলমল করছে সেই জল।
জোহরা আবারও বলতে থাকে- গত রাতে তার বিছানায় একজন মন্ত্রীর পুত পাঠাইছি। পর মুহূর্তে সে আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে ফিরে গেছে। সব অভিযোগ। বাধ্য হয়ে তারে আমার লগে রেখেছি। সারারাত।
মিনু নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করে- কি-রে কুসুম, এসব কী?
অস্পষ্ট গলায় কুসুম কহিল- বিশ্রী বিশ্রী কাণ্ডগুলো আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
কথাটা শোনামাত্র রেগে উঠে জোহরা। আরও তীক্ষèস্বরে চেঁচিয়ে উঠে। বলে- নাচতে নেমে উঠান বাঁকা বলে লাভ নেই, তোরে এখানে মাগনা নিয়ে আসি নাই। আমার হাতে পাঁচ লক্ষ টাকা গুনে দিয়ে চলে যা। আমার কোনো আপত্তি নেই। না হয় কামাই করে দিতে হবে। না পারলে তোর পাছা ভেঙে দেব। তুই জানিস না- আমি কত বড় হাইওয়ান। ট্রেনিং নিয়ে এই ব্যবসায় নেমেছি, সুতরাং কোনো ধরনের ছলছাতুরী আমার লগে চলবে না।
মিনু বার বার চোখ ওঠায়। আবার নেমে পড়ে। ঝরে পড়ে বুক। কাঁপছে থরথর করে।
সিগ্রেটের অনেকটা অংশ জ্বলে গেছে। ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছে। সুখটান দেবার কথা ভুলে গেছে সর্দারনি। ভারী গলার স্বরে বলে যাচ্ছে- এই মাগী, আমার কথা মন দিয়ে শোন। আইজ রাইতে নতুন একজন আসবে। তারে তোর সাথে দেব। কোনো ডিস্টাব করবি না। যদি করিস খবর আছে।
কুসুম ফিশ ফিশ করে জিজ্ঞেস করে- মিনু, কী হবে-রে?
বাক্যটা শুনে গেছে জোহরা। অকপটে সিগ্রেট টান দিয়ে কহে- বোদাটা ছেঁচা করে দেব।
দরজার লগে সরু গলি। কোনো মতে দু’জন হাঁটা যায়। আপাতত গলিতে কোনো লাইট নাই। আপাতত গলির শেষে ছোট্ট একটা কার্নিশ দিয়ে প্রবেশ করা আলোর ওপর নির্ভর।
পাশের একটি কক্ষ থেকে ছুটে এসেছে রেশমা। সেই এখানকার পুরাতন বাসিন্দা। সবকিছুতে পারদর্শী। সর্দারনির বাক্যটা শুনে খিল খিল করে হাসে। স্বাভাবিক গলার স্বরে তাকে বলতে শোনা যায়- গাঁও গিরামের মাইয়া আসলে এরকম যন্ত্রণা পোহাতে হয়। খুব বিরক্তকর।
জোহরার হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলছিল বেনসন সিগ্রেটের শেষ অংশ। প্রচণ্ড ধোঁয়া উড়ছে। মনে নেই সুখটান দেবার। ছ্যাঁকা লাগার পর টান দিয়ে চলে। মেজাজ ঠাণ্ডা করে। আগুনের ফুলকি ওঠা-নামা করতে দেখা যায়।

দুই.
দুপুর বেলা।
রেশমা নবাগত একজন যুবককে নিয়ে তার কক্ষে যাচ্ছে। শারীরিক খসরত উপস্থাপন তার বেশ চমৎকার। বার বার নজর ফিরে যায়।
জোহরা মিটি মিটি হাসে, তাকায় ফ্যাল ফ্যাল করে। যেহেতু এমন খসরত তার উপার্জনের বৃহত্তম অংশ।
মিনু নিচু স্বরে কহে- কিছু দেখছিস কুসুম?
-হ।
ভারী ভারী পায়ে হাঁটছে সর্দারনি। তার চলার মাঝে নবাবী ভাব আছে। ডান হাতের আঙ্গুলে বেনসন সিগ্রেট চাপ থাকলেও বাম হাতে মুঠো ফোন। অনেক দামি। আয়নাটা ছোটখাটো একটা টিভির মতো। মাঝে মাঝে কার ফোন আসে, রিসিভ করে। সুখটান দিতে দিতে মুঠো ফোনের আয়নাতে ছবি দেখে কথাও বলে। সিগ্রেটের ধোঁয়া উড়ছে। তার গন্দ সারা ফ্ল্যাটজুড়ে ম-ম-ম করছে। তার হাঁটার মাঝে শব্দ হয়। পায়ের পাতার শব্দ। টাস্-টাস্-টাস্। এটা কোন তার মুদ্রা দোষ নয়। ইচ্ছে করে এমন ভাব করে। অর্থাৎ সর্দারনি হওয়ার একটি গর্ভবোধ।
হাঁটতে হাঁটতে মুঠোফোন অফ করে। কুসুমের কাছে এসে বলে- আজ শুক্রবার। বন্দের দিন। তোকে আজ একটা ভালো কাষ্টমার দেব। তোর মতো ভাবুক প্রিয়।
কুসুম কিছুই বলতে পারে না। মিনু হাত নাড়া দিয়ে কহে- কিছু শুনতে পাচ্ছিস?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় কুসুম।
সর্দারনি তিক্ত গলায় কহে- কোনো কাস্টমার যেন অসন্তুষ্টি না হয়। প্রায় কাস্টমার আমাকে নালিশ করে। তোদের কারণে আমার ব্যবসার মন্দা ভাব এসে গেছে।
কথাটা শেষ করে মিনুকে উদ্দেশ্য করে সর্দারনি বলে- এই মিনু, তুই বরং মেয়েরে বোঝা। প্রতিদিন পুলিশি চাঁদা, গুণ্ডা ভাতা, ঘর ভাড়া, ফ্যামিলি বাজার ইত্যাদি মিলে অনেক খরচ। যা পোহানো খুব কষ্টকর।
মিনু কহিল- টিক আছে-তো!
-তাকে কম টাকা দিয়ে কিনেছি?
-না।
-তাহলে? টাকার অংকটা তারে শুনাইয়া-দে।
সর্দারনি চলে গেছে। কুসুম নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করে- আমারে কত টাকা দিয়ে কিনে ছিল-রে?
-তা-তো সঠিক জানি না। সর্দারনি একেক সময় এক এক ধরনের কথা বলতে শুনি।
কুসুম মাথাটা নিচু করে ফেলে। শ্বাস ফেলে খুব। সেই শ্বাস ছিল অতি গভীর থেকে।
শুশুশু
সন্ধ্যার দিককার সময়।
বারান্দাটা খুব ছোট্ট। তার মাঝে ছোট্ট একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে রেশমা। মাথার উপরে ঝুলছে সোডিয়াম লাইট। মিটিমিটি সোনালি আলোতে মৃদু মৃদু ঝকঝক করছিল চুল। পরনে ছিল গোলাপি রঙের জামা। ওড়না পড়েনি। তাই তার বুকের উন্মুক্ত ফসলগুলো মাচাতে ঝুলানো বাংলা কদুর মতো দেখাচ্ছে।
প্যান প্যান করতে করতে জোহরা এসে গেছে। রেশমাকে দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। তীক্ষè গলার স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলে- এই মাগী, এখানে বাতির আলোতে করছিস কী? আশপাশের কিছু খবর জানিস্?
-কী? সহজ কণ্ঠে বলে রেশমা।
-চোখ মেলে দেখ্। তোকে অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছে।
গ্রীবাটা ফিরে তাকায়। আশপাশেই তাল গাছের ন্যায় খাড়া খাড়া হয়ে আছে সব ভবন। যার ভেতরে বাবুই পাখির মতো মানুষের বসবাস।
জোহরা আবারও তীব্র স্বরে কহে- যা। ভেতরে যা।
গা টেনে ভেতরে পা রেখে যায় রেশমা। নিম্ন কণ্ঠে নিজে নিজে বলতে থাকে- কই! কোনো খদ্দর-তো এখনো আসেনি।
ঠোঁট লম্বা করে জোহরা বলে- আসবে। ফোন পাচ্ছি। তার আগেই মুখে-মণ্ডলে ভালো করে স্নো-পাউডার লাগা। তলাতেও কিছু লাগা।
কথাটা শুনে খিল খিল করে হেসে উঠে মিনু।
জোহরা কী যেন করছে। হাতে শুকানো কাপড়ের বস্তা। ব্যস্ততার মাঝে কুসুমের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে- ঐ বুড়ো মেয়েরেও বল স্নো-পাউডার ঘষতে। মেয়েরে কিনে আমার পুরাটা লছ। লাভ করাতো দূরের কথা- পুঁজিটাও উঠে আসেনি।
মিনু বললো- আসবে আসবে।
-ততদিনে বুড়িরে আরও কেউ নিবে না।
রেশমা পাচা দোলাতে দোলাতে হাঁটে। নিচু স্বরে বলে- বুড়িরে এবার বুড়ো খদ্দর দেন। দেখা যাক কী হয়।
-ঠিক। জোয়ানরা শুধু অভিযোগ করে। কাল রাতে মন্ত্রী পুতের ঘটনা আরও বৈচিত্র্য। সেই যুবক ক্ষিপ্ত হয়ে এসে বলে- মাগনা আইছি নাকি? টেকা ফেরত-দে।
-তারপর?
-ভাগ্য ভালো, আমি গেছি। রাত ভর অভিনয়-টবিনয় করে শান্তিতে রাত কাটাইছি।
মিনু অকপটে কহে- কুসুম খুব ভালো মেয়ে।
কথাটা শুনে রাগান্বিত হইয়া যায়। বিক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলতে থাকে- ভালো হলে এখানে কেন এসেছে? কোনো গার্মেন্টসে মরতে বল।
-সে এসেছিল চাকুরী করতে। দুর্ভাগ্যবসত এখানে।
তিনি কথাটা শুনে উপেক্ষা করলেন। -হু!
হাঁটতে থাকলো জোহরা। তার স্বাস্থ্য খুব ভালো। এই বয়সেও তারুণ্যের ভাব আছে। যেকোনো পুরুষকে বশিভূত করে সহজে। হাঁটছে আর মুখ দিয়ে অনবরত খই ফুটছে। বলছে- এমন বাক্য প্রতিদিন শুনি। কান ঝালাফালা। তার দ্বারা আমার কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং লোকসানি। গার্মেন্টসে হোক বা ইস্টিশানে হোক- যেখানে মন চায় যেতে পারবে। আমার দেয়া পুঁজিটা বুঝিয়ে দিলে হবে।
কুসুম দরজার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল।

তিন.
ধীরে ধীরে বাসার সব জানালা বন্ধ হয়ে আসছে। পর্যায়ক্রমে দরজাও। বাতি জ্বালার নিয়ম মোটেই নেই। শুধুমাত্র মিটমিট বাতিগুলো জ্বলবে। এই নিয়মের বাহিরে কেউ যেতে পারবে না। এটা আইন।
আবছা আবছা অন্ধকারে খদ্দরের আগমন ঘটছে। ১০টার পর এই ফ্ল্যাটে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। প্রহরী এক পায়ে দাঁড়ানো। তাই যেই কেউ আসুক- সময়ের ভেতরে।
মিনু দরজার কড়া নাড়া দিচ্ছিল। ভেতরে কুসুম। অনেকক্ষণ ধরে। বিশ্রী একটা শব্দ। কট্ কট্ কট্। পাশের কক্ষেই ছিল সর্দারনি। বিশ্রী শব্দটা শুনে ছুটে আসে। এসেই চেঁচিয়ে উঠে। -মাগী মরে গেছে নাকি? এত ডাকার পরও দরজা খোলে না কেন?
মিনু নিচুস্বরে বলে- এভাবে চেঁচাতে হয়?
পাশের বাসার সব লোকজন জেগে উঠছে। তারপরও এই মাগীর নিদ্রা ভাঙছে না। ঘটনা কী?
মিনু থেমে আছে দরজার কাছে। থর থর কাঁপছিল তার মন। ভাবছে- কোনো দুর্ঘটনা নয় তো! আত্মহত্যা, খুন, জখম বা ফাঁশি পতিতালয়ের জন্য অসম্ভব কিছু না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কপালে উঠছে চোখ। পায়চারী করছে দুটি পা। ক্ষণ পরে পুনরায় ধাক্কা দিয়ে যায়। কুসুম! এই কুসুম!!
শেষমেশ দরজা খুলেছে কুসুম। মিনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে কহে- এতক্ষণে নিঃশ্বাস ফেললাম। কী টেনশনে ফেলে দিয়েছিস!
আউলা-ঝাউলা কুসুমের চুল। ড্যাব ড্যাবে চোখ। মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছিল। চোখ ঘষতে ঘষতে বললো- কেন? কী হইছিল?
-এত ডাকি তারপরও তোর ঘুম ভাঙে না। মনে মনে সন্দেহ হইতেছে- কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুসুম বলল- মরি নাই বইন। অনেক বার মরতে চেয়েছি, কিন্তু বেহায়া মন- পারি নাই।
কুসুমের হাত ধরে, মøানস্বরে মিনু বলে- মরিস না বইন। তুই আছিস বলে আমিও সাহস পাই। না হয় একা হয়ে যাব। কারণ তোর মনের সাথে আমার মিলে।
জোহরা ওদিকে চিল্লাচিল্লি শুরু করেছে। কণ্ঠের স্বর শঙ্কচিলের মতো। ধাঁরালো। বলতে শোনা যাচ্ছে- এন্মে ব্যবসার মন্দা ভাব চলছে। কাষ্টমার খুব কম। তার মাঝে একটা মাগীও কাজের নয়। যত সব। থানা-পুলিশি বা গুণ্ডা ভাড়ার এক কানা কড়িও কম দিতে পারি না। যথা সময়ে পৌঁছে দিতে হয়। ইস্!
রেশমা বলে- না দিলে?
-পরের রাইতে হামলা। লম্বা কাহিনী। পিপার, টিভিতে ভাইরাল। সর্বনাশ।
-বলেন কী? হতভম্ব হয়ে যায় রেশমা।
-একবার পিপারে ছাপাইয়া দিছিল। এক্কেবারে ছবি-টবিসহ। এরপর আর নিস্তার নাই। পারছি না শহরে থাকতে পারছি না গিরামে। শেষে পালাইয়া গেছি দূর গিরামে।
-বহু ঝামেলা। তারপর কী হইল?
-আর বলিস না। শুধু মনের জ্বালা বাড়বে। গিরামে গিয়ে উপোস পর্যন্ত থেকেছি। মানুষের ঘরে ঘরে ঝিঁ-এর কাজ করেছি। শেষে গিরামের চেয়ারম্যানের লগে খাতির করে রাইত কাটাইছি। তার সাহায্য নিয়ে পুনরায় ব্যবসায় নেমেছি। কিন্তু ততদিনে ব্যবসার সিস্টেম অনেক পরিবর্তন।
-যেমন?
-আগে থানা, পুলিশ, প্রশাসন, মাস্তান, গুণ্ডা বা সাংবাদিকদের চাঁদা ঘুরানো যেত। এখন সেই সব কথা থাক- বাসায় গিয়ে দিয়ে আসতে হয়। তাও আবার আগে-ভাগেই।
কথাগুলো এখনো জোহরার মুখের ওপর রয়ে গেছে। কে যেন এসেছে। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে। তার পাশ দিয়ে কে যেন হাঁটছে। পায়ের পাতার শব্দ হচ্ছে, তবে খুব ভারী ভারী। বিচিত্র একটা শব্দ কানে লাগছে, টাস্-টাস্-টাস্….

ধীরে ধীরে এই ফ্ল্যাট নীরব-নিস্তব্ধ। নেই কোনো মানুষের সারাশব্দ। এর ভিতরে একজন রেশমাকে নিয়ে গেছে। একজন মিনুকে। এভাবে পছন্দ করে নিয়ে যাচ্ছে কক্ষে কক্ষে। একজনের সামনে কুসুমকে প্রদর্শিত করা হয়েছিল। তার পছন্দ হয়নি। এর জন্য সর্দারনির চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। -এই মেয়েরে বার বার বলিছি একটু স্মার্ট হতে। এখন কাষ্টমারগণ মুখ ফিরে নিচ্ছে। না হয় এই মেয়েরে রেখে লাভ আছে? -দূর হ…
ইতস্ততবোধ করে মিনু। খাটিয়া বসে আফসোস করে। যুবক জামা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে- কুসুম কে-রে?
-খুব ভালো মেয়ে। মিনু বলল।
যুবক নিচুস্বরে বলল- সেই ভালোর কোনো দাম নেই। চক্চক্ করলে আজকাল সোনা হয় না।
কিছুক্ষণ পর আরও একজন এসেছে। কিন্তু কোথাও কর্ম খালি নাই। মিনু নিচুস্বরে বলে- কুসুম আছে।
জোহরা মলিন কণ্ঠে বলে- কী জানি বাবা, তাকে পছন্দ হয় কিনা!
-হতেও পারে।
কুসুম তার কক্ষে খাটিয়া বসে আছে। গোমটা পরা। মিট মিট আলোতে তত স্পষ্ট নয়। জোহরা যুবকের হাত ধরে নিয়ে গেছে তার কক্ষে। মুহূর্তে হানা দেয়ার মতো করে কহিল- এই মাগী, দাঁড়া। পাছাটা একটু ঘুরিয়ে দেখা। পছন্দ হয় কি না….
কথাটা শুনে কুসুম লজ্জাবোধ করলো।
ওড়না দিয়ে ঘোমটা পরা ছিল কুসুম। লজ্জা, অপমান আর বঞ্চনায় চোখ ভর্তি জল। নিচের দিকে মুখ রেখে দাঁড়াইবার চেষ্টা করল। এই ক্ষণ সময়ে জোহরা সর্দারনি পরিচয়- নাম বলল। -ওর নাম নোমান।
মাথাটা অবনত করে রেখেছে কুসুম। একবার ফিরে তাকায়নি। তাকায়নি নোমানের দিকে।
নোমান লজ্জা পেল। সর্দারনির অপবাক্য শুনে ইতস্ততবোধ করলো। তাই বলল- না থাক। আমি বরং একটু বাথরুমে যাই।
নোমান নামের মানুষটি বাথরুমের দিকে গেল।
জোহরা চলে যাচ্ছে। দরজা বন্ধ করার আগে আরও একবার ধমক দিল। বলল- এই মাগী, কোনো অভিযোগ না শুনি মত। যদি শুনি- এসে বোদাটা ভেঙে দেব।
কথাটা শেষ করে সর্দারনি চলে গেল। তার চলার গতি খুব ভারী ভারী। বিশ্রী একটা শব্দ বইছে পুরা ফ্ল্যাটে। ধুম-ধুম-ধুম।
নোমান বাথরুম থেকে বের হয়ে হাত-মুখ মোছার আগে বাতি জ্বালিয়ে দিল। কুসুম বারণ করতে চেয়েছিল পারেনি। নোমান তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলিল- সর্দারনি কী বলল-রে?
কুসুম কোনো উত্তর দিতে পারল না। ড্যাবা-চ্যাকা হইয়া শুধু চেয়ে আছে। নোমান ছিল তার ছেলে বেলার, পাঠশালার আর কলেজ জীবনের বন্ধু। কিন্তু এই স্থানে দেখাশোনা সম্পূর্ণ বেমানান। তাই কী বলে মনের ভাবগুলো প্রকাশ করবে তার জানা নেই। তাই হতভম্ব হইয়া আছে কুসুম।
তোয়ালেটা যখন নোমানের মুখ থেকে সরে গেছে- হয়ে গেছে বিমর্ষ! অবাক হবার মতো। সে শুধু জিজ্ঞেস করল- তুমি এখানে?
কুসুম মলিন স্বরে শুধু বলতে পারল- এমন জীবন আমার ভাগ্যে লেখা ছিল। এছাড়া আর কিছু নয়।
ততক্ষণে দুটি চোখ দিয়ে অজস্র ধারায় জল আসতে শুরু করল কুসুমের। সেই জল থুথুনি গড়াচ্ছে…।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়