এইচএসসির বিতর্কিত প্রশ্ন, প্রণেতারা শাস্তি পেলেন : আর কোনো পাবলিক পরীক্ষার দায়িত্ব নয়

আগের সংবাদ

স্বাচিপের পঞ্চম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী : চাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

পরের সংবাদ

পাতাদের ক্যানভাসে মুহম্মদ নূরুল হুদা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অতি সাম্প্রতিক বহুমাত্রিক, সব্যসাচী কবি ও সাহিত্যিক মুহম্মদ নূরুল হুদার যাপিত জীবনের জানা অজানা দিকের তথ্যলব্ধ বর্ণাঢ্য কাহিনি নিয়ে সাহিত্যিক হারুন পাশা তার বিশেষ আয়োজনভিত্তিক পত্রিকা ‘পাতাদের সংসার’ সাজিয়েছেন। এ সংখ্যায় লিখেছেন দেশের সুপরিচিত প্রবীণ, নবীন কবি ও লেখকদের নিয়ে।
দরিয়ানগরের বিক্ষুব্ধ ঢেউ আর তার বিচিত্র খেয়ালের সঙ্গে সংগ্রামী জীবনের দৈনন্দিন কর্মস্রোতের সঙ্গে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা একাত্ম হয়ে গেছেন, তাই তিনি নিজেকে অর্থাৎ জাতিসত্তার পরিচয় খুঁজতে গিয়ে হয়েছেন আত্মানুসন্ধানী- ‘রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি/ সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি/ আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি’।
জাতিসত্তার এই ব্যতিক্রমী কবিকে নিয়ে পত্রিকার সম্পাদক হারুন পাশা বেশ ভাবলেন, নিবিষ্ট হলেন সব্যসাচী, জাতিসত্তার কবি নূরুল হুদার অন্তরালে মুখিয়ে থাকা মানবতাবাদী, সাম্যবাদী জীবনের মূর্ত-বিমূর্ত ভাবনার অতলস্পর্শী মোহময় চিত্রকল্পের চলিষ্ণু ধারাকে উন্মোচন করতে। বলা বাহুল্য হবে না বলেই বলতে হয় সম্পাদকের এই মহতী উদ্যোগ নিতান্তই সময় ও কালের আবেদন। পত্রিকার বহিরাবরণ সত্যি দৃষ্টিনন্দন এবং বৃহৎ কলেবরে ভেতরের তথ্যবহুল শব্দকল্পের প্রতিমা সজ্জায় যে বিভার দু্যুতিময়তা সহজেই বলে দেয় এটা সম্পাদকের মেধা ও মননের ঐশ্বর্যময়ী ফসল। যথার্থ মানুষের আলোক অনুসন্ধানে তিনি ব্রতী হয়েছেন, যেন বহু আগে থেকেই। যে শ্রমের পরাকাষ্ঠা তিনি দেখিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে ধন্যবাদযোগ্য।
ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এই ‘বিশেষ আয়োজনভিত্তিক পত্রিকা ‘পাতাদের সংসার’ সাহিত্যমহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছে, কৌতূহলী হয়েছেন পাঠক। কী আছে এ পত্রিকার জঠরে, অন্দরমহলে। আগ্রহান্বিত হলাম এই পত্রিকার পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মানসে। তাই পত্রিকার দৃষ্টিনন্দন মলাট উল্টিয়ে সূচিতে মনোনিবেশ করতে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় ১২৫ জন কবি ও লেখকের লেখা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশাল আয়তনের পত্রিকা সমগ্রে আকণ্ঠ ডুবে, সেখান থেকে সব আয়োজন সম্মুখস্থ করতে না পারলেও কিছু কিছু লেখকের লেখার চুম্বকাংশ তুলে ধরে একদিকে যেমন একজন জাতিসত্তার কবি নূরুল হুদাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করব, অন্যদিকে এক্ষেত্রে সম্পাদকের সৌন্দর্যময় সৌকর্য ও সফলতার বিশেষত্ব নিয়ে কথা বলব।
আলোকিত প্রবন্ধ ও নিবন্ধ
প্রখর পাণ্ডিত্যের অধিকারী কবি নূরুল হুদা তার কাব্যজগতের রূপকল্প বলুন বা চিত্রকল্প বলুন, তাতে আত্মস্থ হয়েছেন নিজস্ব ধ্যানধারণায়। বস্তুত একজন কবির চারণের ক্ষেত্র বিশাল পরিসরের হলে ও কবির কাব্যসত্তায় মিশে আছে নোনাজলে সাগরের ঘ্রাণ বাতাসে দরিয়ানগরের মৃত্তিকার আবহমান কাল ধরে জীবন-জীবিকাজুড়ে থাকা তামাটে জাতির চলমান কাহন।
পত্রিকার প্রতিটি প্রবন্ধই তথ্যবহুল ও সমৃদ্ধ। প্রবন্ধকারদের অনেকে কবিকে তাদের আপন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল্যায়ন করার প্রয়াস পেয়েছেন।
পত্রিকার শুরুতেই তাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক, নাট্যজন, লেখক ও প্রাবন্ধিক মমতাজউদ্দিন আহমদ আমার কবি প্রবন্ধে বলতে দেখা যায়, মুহম্মদ নূরুল হুদা শব্দ শিকারি। কোথা থেকে না কোথা থেকে শব্দকে খুঁজে আনে। বাছবিচার করে না। ইলিয়ডে তার আনন্দ, শেক্সপিয়ারে তার নেশা, বাল্মিকীতে সে অনুরাগী, হোমারে সে অভিভূত, আর কোরানে সে আকণ্ঠ! আর আছে তার সাগর, আছে পাহাড়, আছে ঈদগাহ বিদ্যালয়। কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘কবির চোখে কবি’ প্রবন্ধে কবি নূরুল হুদা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন ‘গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং ভালো কবি এককথা নয়। আমি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে গুরুত্বপূর্ণ কবি বলে মনে করি’।
কবির ভাবনার ক্ষেত্র, নির্মাণের শৈল্পিকতায় নিটোল, নিখুঁত শব্দচালনা, কবিতার রূপচিত্র রূপায়ণ কবিতার গভীরে মূর্ত-বিমূর্ত ভাবনার রহস্যময় বিচরণ, হৃদয়ে মাটির টান বাস্তবতার গাঢ় আবেদন নিয়ে বলতে গিয়ে ‘বহুমাত্রিকতায় আকর্ষিত কবি’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকার আহমদ রফিক বলেছেন, ‘ষাটের দশকের কবি হয়েও কবিতায় যতটা মননশীল সম্ভবত ততটাই কিংবা কিছুটা বেশিই মানবিকবোধের বিচ্ছুরণে আন্তরিক। মাটি-সংলগ্ন শিকড়ঘেঁষা মানসিকতা তার লেখক চৈতন্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য’। এই প্রবন্ধে প্রবন্ধকার কবি নূরুল হুদার সৃষ্ট সাহিত্যকর্মে বহুমাত্রিকতার স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। বলেছেন, ‘গদ্যরচনায় অলঙ্কারময়তা যেমন সৌন্দর্যের পথে তেমনি তার স্বরসন্ধানী বাক্যবিন্যাসের ঋজুরূপের সৃষ্টির সম্পন্নতায় সৃষ্টিধর্মিতায় পৌঁছে দেয়। এদিক থেকে গদ্যরচিয়তা নূরুল হুদাকে শৈল্পিক সৃষ্টির অন্য এক বৈশিষ্ট্যময় যাত্রিক মনে করা যায়’।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘মুহম্মদ নুরুল হুদার কবিতা জাতিসত্তার দিকে অন্তর্জগতের যাত্রা’ প্রবন্ধে আমরা দেখতে পাই কবির ১৯৬৭ সালে প্রথম কবিতা ‘টুকরো কবিতা’ যা ঊনসত্তরের জুলাই-অক্টোবর মাসে ‘কণ্ঠস্বর’-এ প্রকাশ হয় এবং ২য় কবিতা ‘দূরে যাচ্ছো’
কবিতা ছাপানো হয় কণ্ঠস্বরে ১৯৭২ সালে। এখানে আমরা কবি নূরুল হুদার ছাত্রজীবনের
পরিচয় পাই।

কাব্যালোচনার প্রক্ষেপণ
পত্রিকায় নূরুল হুদার আটচল্লিশটা কাব্যগ্রন্থের আলোচনা হয়েছে। প্রতিটা আলোচনায় উঠে এসেছে কাব্যগ্রন্থের স্বরূপ ও প্রকৃতি। বাজারে কবির বইয়ের কাটতি অর্থাৎ দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অনেক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ও নাম পাঠক মহলের অজানা। কাব্যালোচনা পরিচ্ছদ সে তৃষ্ণার কিছুটা হলেও নিবারণ করবে।
আলী মনোয়ারের ‘শোণিতে সমুদ্রপাত ও সাম্প্রতিক কবিতা’, সৈকত আসগর ‘আমরা তামাটে জাতি’ এবং মাহমুদ কামালের ‘জাতিসত্তার কবি’ কাব্যের আলোচনায় প্রতিভাত হয়েছে কবি নূরুল হুদার জাতিসত্তার অপরূপ বিভা।

বীক্ষণে কাব্যোপন্যাস
পত্রিকায় সংযোজিত হয়েছে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কাব্যোপন্যাস নিয়ে খুব সুন্দর একটা লেখা। ‘অনুবাদে স্বকীয়তা এবং ভিন্নধারার উপস্থাপনা’ নিয়ে শাহানা সিরাজীর লেখাটা কবির অন্য এক সৃজনের বহুমুখিতার স্বরূপ উদঘাটন করে। লেখাটা আমার কাছে ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে, খুব ভালো লেগেছে।

গল্প ও উপন্যাসে সমুদ্র জ্যোৎস্না
কবি নূরুল হুদা আপন স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তায় সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন অবলীলায়। ইতোপূর্বে সাহিত্যে কবি নূরুল হুদার বহুমাত্রিক বিচরণের ওপর আহমদ রফিক এক নাতিদীর্ঘ সমৃদ্ধ প্রবন্ধ উপহার দিয়েছেন। এই অংশে আলোচক সৌরভ শিকদার, আহমেদ মওলা, নিঝুম শাহ আলোচনা মুগ্ধতা ছড়ায়।
এ ছাড়াও গল্পের ওপর নিশাত খানের ‘মৈনপাহাড়ের ধ্যানী সন্নাস’ ও নূর কামরুন নাহার ‘আয়নাদীঘি : অতল ভাবনার দীঘি’ এর আলোচনা এককথায় দ্যুতিময়। এখানে কবিকে অন্য এক রূপে প্রত্যক্ষ করি।

ভ্রমণকাহিনী সম্পর্কিত
কবির ভ্রমণকাহিনী নিয়ে লেখা গ্রন্থগুলোর ওপর মাহমুদ হাফিজ, আমিনুল ইসলাম সেলিম এবং মিজান মনিরের আলোচনা মুগ্ধতা ছড়ায়। এখানে কবির জীবনের ভ্রমণ কাহিনীর ওপর অন্য একটা আবহের সন্ধান মেলে।

শিশুসাহিত্য ভাবনা
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার শিশুসাহিত্য নিয়ে ভাবনার ওপর লেখা নিয়ে রফিকুর রশীদ ও তাহমিনা কোরাইশীর আলোচনা বেশ কথাময়।

প্রবন্ধ জগৎ নিয়ে দৃষ্টিপাত
মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রবন্ধের জগৎ সম্পর্কে আব্দুল মান্নান সৈয়দের আলোচনা অসাধারণ ও ঐশ্বর্যময়। এখান থেকে স্পষ্ট হয় কবির গদ্য রচনা বিকাশ লাভ করে স্বাধীনতার পরে। তিনি নূরুল হুদার প্রবন্ধ সম্পর্কে লিখেছেন- ‘নূরুল হুদা তার প্রবন্ধে সবসময়ই উন্মত্ততাকে শাসনে রেখে, নেপথ্যে রেখে কাজ করেছেন। ফলে তার প্রবন্ধগুলোয় দেখি ভাবনার একটি নতুন বিন্যাস, যুক্তির একটি নতুন ধারাক্রম। আর সব সময়ই স্বকীয় উচ্চারণে’। বিশ্বজিৎ ঘোষের প্রবন্ধ পাঠে আমরা কবি নূরুল হুদার প্রবন্ধ ভুবন সম্পর্কে বিশদ একটা ধারণা পেতে পারি।
অনুবাদক, সম্পাদক ও চিকিৎসক হিসেবে কবির পরিচিতি নিয়ে আলোচনার বিশাল এক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে পত্রিকার পাতাজুড়ে। ‘পাতাদের সংসার’ পত্রিকায় আরো কিছু বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে যেমন আপন এলাকায় কবির পরিচিতি, নিবেদিত কবিতা, কয়েকটি সাক্ষাৎকার, কবির জীবনী, স্মৃতির অ্যালবাম ও আলোকচিত্রে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। এসব বিষয় পত্রিকাকে অন্য এক মাত্রায় উন্নীত করেছে।
পত্রিকার সম্পাদক ‘হারুন পাশা’ বহুমাত্রিক জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার যাপিত জীবনের শৈশব-কৈশোর, যৌবনের কক্সবাজারের পোকখালি গ্রামের কবির স্মৃতিকথা ও সৃজিত সাহিত্যকর্ম নিয়ে দারুণ সব তথ্য সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে কবিকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন।
বলা বাহুল্য হবে না যে পত্রিকার সম্পাদক এদিক দিয়ে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত। একজন জাতিসত্তার বহুমাত্রিক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে একটা জ্যোৎস্নাময় আলোক প্রাঙ্গণে দেখার, জানার আয়োজনের জন্য সম্পাদকের বহুল প্রচেষ্টা খুবই আন্তরিক।
সংগ্রহে রাখার মতো এই সংখ্যাটি কবির সাহিত্য জীবনের বিভিন্ন দিক ও অজানা বিষয়ের সন্ধান দেবে।

মুহম্মদ নূরুল হুদা সংখ্যা
সম্পাদক : হারুন পাশা
পৃষ্ঠা : ৮৬৪
মূল্য : ৩০০ টাকা।
প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০২২

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়