এইচএসসির বিতর্কিত প্রশ্ন, প্রণেতারা শাস্তি পেলেন : আর কোনো পাবলিক পরীক্ষার দায়িত্ব নয়

আগের সংবাদ

স্বাচিপের পঞ্চম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী : চাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

পরের সংবাদ

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ শুরু আজ : নারীর প্রতি সহিংসতা বহুমাত্রিক এক চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : পরিসংখ্যান বলছে, নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না। উল্টো তা যেমন বেড়েছে তেমনি এই সমস্যা বহুমাত্রিক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৭ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮৮৫ জন নারী ও কন্যাশিশু। ২০২১ সালে ৩ হাজার ৭০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। এ সংখ্যা ১ হাজার ২৩৫। ২০২০ সালে দেশে ১ হাজার ৩৪৬ কন্যাশিশু ও নারী ধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ৩ হাজার ৪৪০ জন নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘নারী নির্যাতন’- লিঙ্গভিত্তিক এই সহিংসতা বিশ্বজুড়েই রয়েছে। এই সহিংসতার আওতায় রয়েছে দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নারীরা যখন অন্যের দ্বারা জোরপূর্বক বঞ্চনার

সম্মুখীন হয় এবং শারীরিক, যৌন ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সেই পরিস্থিতিকে নারী নির্যাতন বলে। নারীর যে কোনো অধিকার খর্ব বা হরণ করা এবং কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেয়া বা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছানুসারে কাজ করতে বাধ্য করাও নারী নির্যাতনের শামিল। তবে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন যতটা গুরুত্ব পায় অনান্য বিষয়গুলো ততটা পায় না।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এই সহিংসতার প্রভাব নারীর একক কোনো সমস্যা বা এর প্রভাব শুধু নারীর ওপরই পড়ছে তা নয়। পরিবার, সন্তানাদি এবং অর্থনীতির ওপরও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী ও শিশুদের সেবায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের পরও প্রতি বছর দেশে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি, সেসব দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নামও। দেশের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি নারীদের ৫০ শতাংশই জীবনে কখনো না কখনো সঙ্গীর হাতে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের তথ্যমতে, ৮৭ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। এ পরিসংখ্যানের তথ্য পুরাতন হলেও চিত্র খুব একটা বদলায়নি বলে বলছেন নারী অধিকারকর্মীরা।
বন্ধে আছে নানা উদ্যোগ : আওয়ামী লীগের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে নারী নির্যাতন বন্ধে আইন বা আইনের প্রয়োগসংক্রান্ত কোনো অঙ্গীকার নেই। তবে তার আগের দুটি নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি এমন প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে চায়। এসডিজির পঞ্চম লক্ষ্য, নারী ও কন্যাশিশুর সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন। আর ১৬তম লক্ষ্য শিশুদের ওপর অত্যাচার, শোষণ, পাচার এবং সব ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করা। সরকার নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-৩০) প্রণয়ন করছে। এর আওতায় প্রয়োজনীয় কাজগুলো করার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ পাচ্ছে। নারী নির্যাতন বন্ধে প্রচলিত আইনের পাশাপাশি বাংলাদেশে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাস করা হয় এবং ২০০৩ সালে কিছু সংশোধনী আনা হয়। সর্বশেষ এই আইনের সংশোধন করা হয় ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে ও কঠোর শাস্তির বিধানসহ প্রতিরোধের ব্যবস্থার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। জনস্বার্থে করা একটি রিটে ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট ওই রায় দেন। কিন্তু সেগুলোর কোনো বাস্তবায়ন নেই।
সহিংসতা কেন কমছে না : অধিকারকর্মীরা বলছেন, সুরক্ষার অভাব নারীর এগিয়ে চলার পথ আটকে দিচ্ছে। তারা বলছেন, সহিংসতা প্রতিরোধের কাজটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর গোড়া পরিবারে, সমাজে বিদ্যমান নারীর প্রতি বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। মোকাবিলার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যক্রম প্রয়োজন। পাশাপাশি সহিংসতার প্রতিকারের চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী এডভোকেট সালমা আলী বলেন, দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। নির্যাতনের অনেক ঘটনায় মামলা হলেও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে আপস-মীমাংসা করতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও, পরিস্থিতি বিশ্নেষণে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। বরং বিচারহীনতার কারণে নির্যাতনের ভয়াবহতা ও নৃশংশতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
মানবাধিকারকর্মী শীপা হাফিজা মনে করেন, একটি উন্নত ও মানবাধিকারসম্পন্ন নিরাপদ দেশ গঠনের জন্য নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধগুলোর প্রতিরোধ ও প্রতিকার অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার পরও অন্য যে কোনো অন্যায় বা অপরাধের মতো আমরা হয়তো ধর্ষণ পুরোপুরি প্রতিরোধ বা বন্ধ করতে পারব না; তবে সচেতনতা, সতর্কতা, সামাজিক ও আইনি প্রতিকার এ সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে পারে। এসডিজি অর্জনকে সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ, অবহেলা ও নিপীড়নের ঘটনাগুলো চিহ্নিত করে তা সুরাহায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়মিত, কার্যকরী এবং শক্তিশালী নিরীক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। এ দায়িত্বে পরিবার, পাড়া-পড়শি, সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে দেশব্যাপী মানবতা উন্নয়নের এ ধস বন্ধ করতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে সুরক্ষার সর্বজনীন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ শুরু : নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আজ ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে ১৬ দিনব্যাপী এই পক্ষ পালনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। পক্ষকালব্যাপী এই আয়োজন পালিত হবে ‘সবার মাঝে ঐক্য গড়ি; নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ করি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ‘নারী ও কন্যা নির্যাতন বন্ধ করি; নতুন সমাজ নির্মাণ করি’ এই স্লোগান এবং আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ‘নিঃশঙ্ক জীবন চাই: নারী নির্যাতনমুক্ত সমাজের অঙ্গীকার চাই’ প্রতিপাদ্য দিয়ে পক্ষকালব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
প্রসঙ্গত, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৯৮১ সালে ল্যাটিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলন দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস উদযাপন কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে এই দিবস ও পক্ষ পালন করছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়