এইচএসসির বিতর্কিত প্রশ্ন, প্রণেতারা শাস্তি পেলেন : আর কোনো পাবলিক পরীক্ষার দায়িত্ব নয়

আগের সংবাদ

স্বাচিপের পঞ্চম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী : চাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

পরের সংবাদ

আলী ইমাম : স্মৃতির ভেতরে বসবাস

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তখন সন্ধ্যা।
মৃদু শীতের ছোঁয়া। এমন সময় অনতুর ফোন। অনতু মানে আলী ইমাম ভাইয়ের একমাত্র পুত্রসন্তান। পেশায় চিকিৎসক। খুব ভারি কণ্ঠে সে বলল, আমীরুল কাকু, আব্বু তো আর নেই। চ্যানেল আইতে খবরটা দিয়ে দিন। আমি স্তম্ভিত হয়ে রইলাম। বিষাদে আচ্ছন্ন আমি। চ্যানেল আইয়ের ছাতিম গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছি। ছাতিম গাছের সোঁদা গন্ধ। আমার তখন কান্না পাচ্ছে। সাগর ভাইকে ফোন দিলাম। সাগর ভাই আর্তনাদ করে উঠলেন। এই সত্য তিনি মেনে নিতে পারছেন না। কারণ প্রায় ৫৫ বছরের পথচলা। শিশুসাহিত্য, শিশু সংগঠন, টেলিভিশন- একটা জীবন আলী ইমাম এবং ফরিদুর রেজা সাগর একসঙ্গে কাটিয়েছেন।
স্মৃতির পর স্মৃতি মনে পড়তে লাগল। আমার সঙ্গেও প্রায় ৪৫ বছর সম্পর্ক। পিতাতুল্য তিনি। অভিভাবক ছিলেন। আলী ইমাম ভাই আমাদের শূন্য করে দিয়ে চলে গেলেন। ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায়। কিছুক্ষণ চ্যানেল আইতে এলোমেলো ছোটাছুটি করলাম। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। সাগর ভাই আবার ফোন দিলেন। নিউজ কেমন হবে আলী ইমাম স্মরণে, মরদেহ কখন চ্যানেল আইতে আসবে, জানাজা কখন হবে- এসব নির্দেশনা দিতে থাকলেন। আমি আবার বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে এলাম। শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন এর সঙ্গে কথা বললাম। দুজনই কিছুটা অসুস্থ। তারা আশৈশব আলী ইমামের বন্ধু। একসঙ্গে লেখালেখির জীবন। তারা চ্যানেল আইতে আসতে রাজি হলেন। উপস্থাপক হিসেবে পেলাম সময় প্রকাশনের ফরিদ আহমেদকে। সেট, লাইট, ব্যাকড্রপ সব প্রস্তুত হলো। শাইখ সিরাজ তত্ত্বাবধান করলেন। তিনিও প্রচণ্ড বিষাদ আক্রান্ত। আলী ইমামের প্রয়াণ আমরা কেউ মেনে নিতে পারছি না।
রাত ৯টায় রেকর্ডিং করলাম। ১০টায় সম্প্রচার। কান্নাভেজা একটা অনুষ্ঠান তৈরি হলো। ইফতেখার মুনিম, মোস্তাফিজুর রহমান নান্টু, ইমরান পরশ প্রমুখ সদা প্রস্তুত। আলী ইমাম চ্যানেল আইতে প্রচুর অনুষ্ঠান করেছেন। আর্কাইভ থেকে ফুটেজ নিয়ে ইফতেখার মুনিম একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে ফেলল তাৎক্ষণিকভাবে।
আমি অনতুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে চলেছি। আলী ইমাম ভাইয়ের মরদেহ সকাল ১০.৩০টায় বাংলা একাডেমি নজরুল মঞ্চে সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নেয়া হবে। বাদ জোহর চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে জানাজা হবে। চ্যানেল আই ছিল আলী ইমামের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে এমন অনেক অনুষ্ঠান তিনি উপস্থাপনা করেছেন- সাহিত্যবিষয়ক যে কোনো অনুষ্ঠানে আলী ইমামের সরব উপস্থিতি। তার কর্মের পৃথিবী বিশাল বড়। টেলিভিশনে শিশুশিল্পী হিসেবে অংশ নিতেন। পরে প্রযোজক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু। জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে অবসর গ্রহণ। এর পাশাপাশি তিনি একজন প্রথিতযশা শিশুসাহিত্যিক। আজীবন তিনি ছোটদের জন্য দুহাতে লিখেছেন। ১৯৬৩ সাল থেকে তার লেখালেখির শুরু। কচিকাঁচার আসর, খেলাঘর, টাপুরটুপুর, মুকুল, নবারুণ, শিশু, ধান শালিকের দেশ- এসব পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তার বই প্রকাশিত হয়েছে প্রায় পাঁচশত। বই বের হলে তিনি শিশুর মতো আপ্লুত হতেন। খুব ভালো কথক ছিলেন তিনি। আমরা মুগ্ধ হয়ে তার বক্তব্য শুনতাম। বিগত ৩০ বছর ধরে তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্কুল কর্মসূচিতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন বক্তৃতা দিয়ে। কোনো ক্লান্তি নেই তার। বিপুল প্রাণশক্তি। বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন।
আমাদের পরমগুরু আবদুল্লাহ আবুু সায়ীদকে ফোন দিলাম। স্যার খুব ভালোবাসতেন আলী ইমামকে। টেলিফোনে বেদনা ঝরে পড়তে লাগল সায়ীদ স্যারের। আমাকেও বললেন, শরীরের যতœ নিও।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা, শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন সবাই জানাল, আলী ইমাম ভাইকে নিয়ে তারা স্মরণসভা করবেন। প্রত্যেকেই বেদনায় আচ্ছন্ন। কারণ আলী ইমাম ভাই অসম্ভব পজেটিভ মানুষ। সবার সঙ্গে সহজে মিশতে পারতেন। সবার মাঝে স্মৃতির ছাপ রেখে যেতেন। আহমাদ মাযহারের সঙ্গেও নানা বিষয়ে কথা হতে লাগল বারবার। মন বড় অস্থির। অনেক বেশি কথা বলছি সন্ধ্যা থেকে। মাযহারের সঙ্গে আলী ইমাম বিষয়ে অনেক কথা হলো। গভীর রাত পর্যন্ত অক্লান্ত সেই আলোচনা। পিয়াস মজিদ. আশিক মুস্তাফা, অদ্বৈত মারুত, মামুন সারওয়ার, মঈন মুরসালিন, নাফে নজরুল সবাই উদ্রগীব। ফেসবুকে অনবরত পোস্ট হচ্ছে তার মৃত্যুসংবাদে সবার মন খারাপ। ঠাটারি বাজারে পৈতৃক বাড়ি, আজিমপুরে শ্বশুরবাড়ি- কত দিনরাত্রি। কত স্মৃতি। আলী ইমাম ভাইয়ের ছোট শ্যালক রাজন আমার স্কুল বন্ধু। ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগল না আমার। তারপর সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বিষাদে আমাদের জীবন বয়ে যেতে লাগল। আমাদের জীবনে আলী ইমামের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। আমাদের লেখালেখির প্রচণ্ড উৎসাহদাতা তিনি। মন প্রাণ ভরে তিনি সব সময় প্রশংসা করে গেছেন। আমাদের মানস গঠনে তার ব্যাপক ভূমিকা। লেখালেখি, টেলিভিশন সব কাজেই আলী ইমামের ভালোবাসা ও প্রেরণায় আমরা ঋদ্ধ হয়েছি। টেলিভিশনের কাজ শিখেছি তার কাছে। পরে পূর্ণতা পেয়েছি সাগর ভাইয়ের কাছে।
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আল মনসুর, সাইদুল আনাম টুটুল, আলী ইমাম, রিয়াজউদ্দিন বাদশা, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন- এরা ছিল পরস্পর হরিহর আত্মা।
এদের পরম্পরা ধরে ফরিদুর রেজা সাগর, ইমদাদুল হক মিলন, আফজাল হোসেনের আগমন। এর পরের পরম্পরা আমাদের বলা যেতে পারে। লুৎফর রহমান রিটন, আসলাম সানী, আহমাদ মাযহার, শহিদুল আলম সাচ্চু প্রমুখ।
অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ইমাম ভাই ছিলেন খুব অস্থির মানুষ। নানা কাজ নিয়ে তিনি সারাক্ষণ ছটফট করতেন। কত ধরনের তার কোনো হিসাব নাই।
অনায়াসে তিনি একদিনে তিনটা অনুষ্ঠান প্রযোজনা করতেন। চার-পাঁচটা বই একসঙ্গে লিখতেন। বই তৈরি করতেন। প্রæফ দেখতেন। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতেন। বইয়ের মেকআপ দিতেন। বই পেস্টিং করতেন। যেন তিনি দশভূজা।
পুরো দেশ তিনি বারবার ঘুরে বেড়িয়েছেন। কচিকাঁচার মেলার আহ্বায়ক হিসেবে অধুনা পাকিস্তান চষে ঘুরেছেন। পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্মসূত্রে দেশ পরিভ্রমণ করেছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির মাধ্যমে বেশ কয়েকবার দেশভ্রমণ করেছেন। আলী ইমাম ভাইয়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সেটা হচ্ছে আলী ইমাম ভাইয়ের ভোজনপ্রিয়তা। অসম্ভব ভোজনরসিক। কাবাব-রটি, কাচ্চি বিরিয়ানি, মাটন ভুনা, ইলিশ মাছ, লোকায়ত বাংলার খাবার- এসবই ছিল তার প্রিয়। গরুর মাংসের কাবাব দিয়ে তিনি ডালভাত খেতে খুব পছন্দ করতেন। গরুর মাংসের যে কোনো রেসিপি আলী ইমাম ভাইয়ের জিহ্বাকে অসংযত করে তুলতো। তার কোনো সংকোচ ছিল না। তিনি রাস্তার ধারের হোটেল কিংবা পাঁচতারা হোটেলে একই রকম রুচি নিয়ে খেতেন।
চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের তিনি ছিলেন অন্ধ ভক্ত। রায়ের কোনো সমালোচনা তিনি সহ্য করতেন না। রায়ের চলচ্চিত্র, শিশুসাহিত্য, সম্পাদনা, প্রচ্ছদ নির্মাণ সব কিছুতেই তিনি পাগলের মতো উচ্ছ¡াস প্রকাশ করতেন। আলী ইমাম সমগ্র বাংলা ভাষার প্রেক্ষাপটেই একজন শক্তিমান শিশুসাহিত্যিক। তার অজ¯্র বইয়ের সমুদ্র থেকে মনিমুক্তো খুঁজে বের করা কঠিন। দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া, নীল ডুংরির আতঙ্ক, শাদা পরি, বনকুসুমপুর রহস্য, ভয়াল ভয়ংকর, চারজনে রুপালি ফিতে- থোকা থোকা অসংখ্য বইয়ের নাম উল্লেখ করা যায়।
তার লেখার বৈশিষ্ট্য নিয়ে শত শত পৃষ্ঠা লেখা যায়। ভালো-মন্দ সমালোচনাও করা যায়। কিন্তু এখন ভাবি, এতো লেখা কীভাবে সম্ভব?
আলী ইমাম ভাই ছিলেন প্রচুর পরিশ্রমী। বলতেন, আমি কলম পেষা মজুর। আমরা মুখো বিস্ময়ে তার কথা শুনতাম। আজিমপুরে ইমাম ভাইয়ের বাসায় রাত জেগে কাজ করেছি। লিপি আপা পরম যতেœ আমাদের বাত খাওয়াতেন। সেসব দিনের কথা কেমন করে ভুলি। আলী ইমাম ভাই জীবিতকালেই বর্ণময় স্মৃতিমধুর, দরদী এক চরিত্র। তার সঙ্গে কত ঘটনা। কত স্মৃতি, কত কাহিনি ছড়িয়ে আছে। তিনি ছিলেন আমাদের জীবনের অংশ।
বাংলা একাডেমি নজরুল মঞ্চে তার মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম- আলী ইমাম ভাইও স্মৃতির ভেতর বসবাস শুরু করলেন। আমরা এখন রিক্ত, নিঃস্ব, শূন্য। আমরাও স্মৃতি হয়ে যাব।
আলী ইমাম ভাইয়ের বক্তৃতার বাণী ধার করে বলতে চাই, মাধবীর কানে কানে বাতাস কহিল মৃদুস্বরে, নিজেরে চেন না তুমি আমরা তোমারে চিনি সবে।
আলী ইমাম ভাই ভালো থাকবেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়