এইচএসসির বিতর্কিত প্রশ্ন, প্রণেতারা শাস্তি পেলেন : আর কোনো পাবলিক পরীক্ষার দায়িত্ব নয়

আগের সংবাদ

স্বাচিপের পঞ্চম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী : চাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

পরের সংবাদ

আদালতে নড়বড়ে নিরাপত্তা পুলিশের আশকারায় অনিয়ম

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** টাকায় মেলে আসামির সঙ্গে সাক্ষাৎ ** সিসিক্যামেরা অপর্যাপ্ত ** নিয়ন্ত্রণ নেই চলাচলে, সক্রিয় নানা চক্র ** সিজেএম আদালতের পেছনের গেট তালাবদ্ধ কেন? **
রকি আহমেদ : ঢাকার নি¤œ আদালত থেকে দুই জঙ্গি আসামিকে ছিনতাইয়ের চাঞ্চল্যকর ঘটনা এখন টক অব দ্য ক্যান্ট্রি। আদালতের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিনতাই হলো কীভাবে- এ নিয়ে জনমনেও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গেছেন। গাফিলতি বা দায় কার তা এখনো নিরূপন করা হয়নি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মামলায় আসামিদের হাজিরার জন্য আদালতে আনা নেয়ার সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে একেবারেই নড়বড়ে। ভিআইপি ছাড়া অন্য আসামি তোলার সময় ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গা-ছাড়া ভাব দেখা যায়। শুধু ওই দুই জঙ্গি ছিনতাই নয়; নানা সময় আরো অনেক আসামি আদালত থেকে পালিয়ে গেছেন।
এর মধ্যে চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল মানিকগঞ্জের কলেজশিক্ষার্থী মনির হোসেন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বাদশা মিয়াকে আরেক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণে আনা হলে আদালত থেকে পালিয়ে যান তিনি। এছাড়া গত ২৩ মার্চ ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে সাইফুল ইসলাম নামে মাদক মামলার এক আসামি পালিয়ে যান। এছাড়া গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়ার সময় ডাকাতি মামলার আসামি হারুনুর রশিদ ওরফে সুমন পালিয়ে যান। ওই ঘটনায় হাজতের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসআই বদরুজ্জামানসহ ৮ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া গত ২৮ জুলাই আদালত থেকে ডিবি পুলিশের কাছ থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় মাদক মামলার এক আসামি রায়সাহেব বাজার মোড়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ির সামনে পড়লে ছিনতাইকারী ভেবে তাকে আটকায় শিক্ষার্থীরা। পরে জানা যায়, ওই আসামি মাদক মামলার শুনানি শেষে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়ার সময় পালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে আসামির হাতে কোনো হাতকড়া দেখা যায়নি। আসামির নাম ও হাতকড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডিবির পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক ওই আসামির ভিডিও ভোরের কাগজের কাছে রয়েছে। এমন নানা সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের কাছ থেকে আসামি পলায়নের ঘটনা দেখা যায়।
এছাড়া জঙ্গি বা মৃত্যুদণ্ডের আসামিদের আদালতে হাজির করার সময় মাথায় হেলমেট, দুই হাতকড়া ও বুলেটপ্রæফ জ্যাকেট পরানো ও পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর নিয়ম থাকলেও রায়ের দিন বাদে অন্য সময় তা মানা হয় না। সবাইকে সাধারণ আসামিদের মতো এক হাতে কড়া পরিয়ে বা এক দঁড়িতে সবাইকে বেঁধে আদালতে আনতে দেখা যায়। কখনো কখনো শিথিল নিরাপত্তার সুযোগ নেয় আসামিরা।
দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সিজেএম আদালতের পেছনের গেট দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ থাকার বিষয়টি এখন আলোচনায় উঠে এসেছে। ২০২০ সালে উদ্বোধনের পর থেকে সিজেএম আদালতের পেছনের গেট তালাবদ্ধ। তাই হাজতখানার সামনেই সিজেএম আদালতের এই গেট থাকলেও তা বন্ধ থাকায় আসামিদের কাঠগড়ায় আনা নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে আদালতে তোলা হতো। সূত্র বলছে, হাঁটিয়ে নিতে পারলে আসামিদের সঙ্গে স্বজনদের কথা ও দেখা করানোর মাধ্যমে বকশিশ পান পুলিশ সদস্যরা।
এছাড়া অর্থের বিনিময়ে মেলে আসামির সঙ্গে তাদের স্বজনদের দেখা করা, খাবার দেয়া ও আড্ডা দেয়ারও সুযোগ। অনেক সময় হাতকড়া খুলে দেয়া হয়। এ ধরনের চিত্র আদালত প্রঙ্গণে যেন নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা। আসামিকে হাজিরার জন্য আদালতে নিয়ে যাওয়া ও আনার পথে, এজলাস কক্ষে ও হাজতখানায় অর্থের বিনিময়ে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হতো। তবে এ বিষয়ে ধরা পড়লে সাময়িক শাস্তি দেয়া হয়। বড় কোনো শাস্তি না হওয়ায় অর্থের বিনিময়ে আসামিদের দেয়া এসব সুযোগ দেয়া বন্ধ হয়নি।
এমন একটি ঘটনা- চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের মহিলা হাজতখানায় আলোচিত যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামিমা নূর

পাপিয়ার সঙ্গে বাইরের দুই যুবকের প্রফুল্ল মনে কফির আড্ডা দিতে দেখা যায়। এ সময় বাইরে নারী পুলিশ সদস্যদেরও পাহারা দিতে দেখা যায়। আসামির সঙ্গে আড্ডার বিষয়ে জানতে চাইলে দুই যুবক নিজের গেস্ট বলে ওইসময় প্রথমে পরিচয় দেন হাজতখানার পুলিশের ইনচার্জ নৃপেন কুমার বিশ্বাস। পরে সাংবাদিকরা এলে যুবকদের চেনেন না বলে জানান নৃপেন কুমার। আড্ডার ওই ঘটনার ভিডিও ভোরের কাগজসহ নানা গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এ ঘটনায় মহানগর হাজতখানার পুলিশের ইনচার্জ নৃপেন কুমারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তিনি এখন সিএমএম আদালতে নিয়োজিত বলে জানা গেছে। এভাবে শাস্তি না হওয়ায় বন্ধ হচ্ছে না আদালত পাড়ায় অর্থের বিনিময়ে আসামিদের সাক্ষাৎ।
অন্যদিকে আদালতপাড়ায় প্রতিদিন বসতে দেখা যায় নানা হকার। তারা অনুমোদন পেলেন কীভাবে, তা নিয়ে জনমনেও প্রশ্ন। এ বিষয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতের বটতলায় বসা হকাররা বলেন, আমরা অনুমতি পেয়েই বসেছি। তবে অনুমতি দিল কে তা স্বীকার করতে নারাজ তারা। এছাড়া প্রতিদিন কোনো কাজ না থাকলেও ভবঘুরে সেজে থাকা পকেটমার, ভুয়া আইনজীবীসহ নানা চক্র আদালতে ওঁৎ পেতে থাকে।
অন্যদিকে আদালতের সব স্থানেও নেই সিসিক্যামেরা। জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাস্থল ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের গেটেও নেই কোনো সিসিক্যামেরা। এর আগে দুই বছর আগে আদালত এলাকার নিরাপত্তার জন্য ১৩০টি সিসিক্যামেরা বসানোর আবেদন করা হলেও তা অনুমোদন না পাওয়ায় তা বাস্তবায়ন হয়নি বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
আসামিদের নিরাপত্তা ও সিজেএম আদালতের গেট তালাবদ্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, জঙ্গি ছিনতাইয়ের বিষয়ে তদন্ত চলছে। আসামিদের আদালতে তোলার ক্ষেত্রে আরো নিরাপত্তা জোরদার করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যেখানে নেই সেখানে সিসিক্যামেরা লাগানো হচ্ছে। আর বিচারকদের নিরাপত্তার জন্য সিজিএম আদালতের পেছনের গেট বন্ধ ছিল। আমরা ঠেকে শিখেছি। এখন থেকে শুধু আসামিদের যাওয়া-আসার জন্য এ গেট খুলে দেয়া হবে।
এদিকে আদালতে পুলিশ উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) জসিম উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, কোনো পুলিশ সদস্য যদি টাকা নিয়ে আসামিদের সুযোগ সুবিধা দেয়, এর প্রমাণ পেলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব। এছাড়া আদালতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সিসিক্যামেরা পর্যাপ্ত নেই। লাগানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিনি আরো বলেন, তিনটি উচ্চ পর্যায়ে কমিটি হয়েছে। তারা তদন্ত করলে বিস্তারিত জানা যাবে।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের (কারা অনুবিভাগ) অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে। আসামিদের মূল রাস্তা দিয়ে পেছনে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। যদি ভেতর দিয়ে আনা নেয়া করা হতো, তাহলে ঝুঁকিটা অনেকখানি কম থাকত। নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিল তাদের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা তা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিরোধে কিছু ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে- সে ব্যাপারে সুপারিশ করা হবে।
উল্লেখ্য, গত ২০ নভেম্বর দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকার সিজেএম আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশের চোখে স্প্রে মেরে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আনসার আল ইসলামের সদস্য আবু সিদ্দিক সোহেল ও মইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। ঘটনার রাতে ২০ জঙ্গিকে আসামি করে মামলা করেন কোর্টের পুলিশ পরিদর্শক জুলহাস উদ্দিন আকন্দ। ওই দিন রাতেই ১০ জঙ্গির ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এছাড়া পলাতক ওই দুই জঙ্গিসহ বাকিদের গ্রেপ্তারে রাজধানীতে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। অন্যদিকে পালিয়ে যাওয়া ওই দুই জঙ্গিকে ধরিয়ে দিতে পারলে প্রত্যেকের জন্য ১০ লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়