অর্থপাচার মামলা : বরকত-রুবেলের আরেক সহযোগী কারাগারে

আগের সংবাদ

আরব্য রজনীর নতুন রূপকথা : সৌদি আরব ২ : আর্জেন্টিনা ১ > মেসিদের প্রত্যাশিত হারে স্তব্ধ ফুটবল বিশ্ব

পরের সংবাদ

ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে

প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত কিছু সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, আগামীতেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। ব্যাংকগুলোয় জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে। সন্দেহ নেই, আলোচ্য ঘোষণা জনমনে তৈরি হওয়া উদ্বেগের কিছুটা প্রশমন ঘটাবে। কিন্তু এতে কি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অস্থিরতার অবসান ও সমস্যার সমাধান আসবে? সহসা তেমনটি হওয়ার আশা করা যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে এবং এটি ক্রমাগত বাড়ছে। অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা, গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যাংক আইনের ঘন ঘন পরিবর্তন, উচ্চমূল্যস্ফীতির মধ্যেও সুদের হার স্থির করে রাখা প্রভৃতি কারণে ব্যাংক খাত নিয়ে জনমনে এক ধরনের উৎকণ্ঠা রয়েছে। সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারা ও বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের নতুন করে ফাইল খোলা বন্ধের মতো পদক্ষেপ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কয়েক দিন আগে কয়েকটি ব্যাংককে সতর্কও করা হয়েছিল। এগুলো ব্যাংক খাত সম্পর্কে জনমনে ভীতির সঞ্চার করেছে। এক্ষেত্রে দেশের কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি জনগণকে সাময়িক স্বস্তি দিলেও ব্যাংক খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান ব্যতিরেকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল ব্যাংক খাত প্রত্যাশা করা যায় না। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর পদক্ষেপই এ খাতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে পারে।
ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি দায়িত্ব বিবেচনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণকারী প্রধান গোষ্ঠী ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতা, ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী, জাতীয় কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির যথার্থ উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংকে সংঘটিত হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সেখানে ঋণগ্রহীতা ও কর্মকর্তারা গোপন সমঝোতার মাধ্যমে অস্বচ্ছ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সে ঘটনায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় এ সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এর বাইরে নয়। পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্বিক নির্দেশনা দেবে, নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে আর ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন, এটাই নিয়ম। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কার্যপরিধি আইন দিয়ে নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়, পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাজে হস্তক্ষেপ করছে। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ কমে যাচ্ছে। এটা ব্যাংক খাতের জন্য মঙ্গলজনক নয়। অনেক সময় ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও ত্রæটির কারণেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। এসব কারণে ব্যাংক খাতে দুর্নীতি দেখা দিচ্ছে, জবাবদিহির ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে পরস্পরকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে জবাবদিহির বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে সংস্কার থেকে সরে এসে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, ফলে আজ ব্যাংক খাত ঝুঁকির মুখে। এখান থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। খেলাপি ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে আটটি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের তালিকায় চারটি সরকারি ও বেসরকারি চারটি ব্যাংক রয়েছে। তবে কিছু কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো ব্যাংকিং খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাতে গত এক যুগে বেশকিছু বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকারও বেশি বের করে নেয়া হয়েছে। সুদসহ যার পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই টাকার পুরোটাই এখন খেলাপি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল উচ্চ খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে উল্লেখ করে তা কমানোর উদ্যোগ ও পরিকল্পনা জানতে চায়। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে দ্রুত বিভিন্ন আইন সংশোধন করার পাশাপাশি আর্থিক খাত সংস্কার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা, গতিশীলতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুন খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে তা যথাযথ পর্যালোচনা করতে হবে। প্রদত্ত ঋণকে যথাযথ তদারক করতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় আইন, গাইডলাইন এবং নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন, গাইডেন্স এবং তদারকি বাড়াতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকেও দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে এবং ব্যাংক সেক্টরের উন্নয়নের স্বার্থেই বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে। অধিকন্তু অর্থঋণ আদালতসহ আইনি প্রক্রিয়াকে আরো উন্নত এবং সংস্কার করতে হবে, যাতে আইনের সাহায্য নিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা যায় এবং ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। তাছাড়া গ্রাহককে যেনতেন প্রকারে ঋণ প্রদান করে মুনাফা অর্জনের টার্গেট ব্যাংকগুলোকে পরিহার করতেই হবে। মুনাফা অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা ব্যাংক সেক্টরকে বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি করেছে। ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণ নীতিমালা পুনর্বিন্যাস এবং ঋণকে বিভিন্ন সেক্টরে বণ্টন করতে হবে। বর্তমানে কিছু উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন, ঋণ পুনরুদ্ধার কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা। এসব উদ্যোগ তখনই সফল হবে, যখন ঋণখেলাপিরা দেখবে যে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে এবং কাউকেই অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে না। প্রয়োজনে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হোক। প্রস্তাবিত কমিশনের ম্যান্ডেট হতে পারে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর সুচিন্তিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চিহ্নিত করখেলাপি ঋণসহ অন্যান্য সমস্যার মূল চিহ্নিতকরণ; আইনি কাঠামোর সংস্কার; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা বিধান; ব্যাংক বোর্ড গঠনের জন্য নীতিমালা; আইন প্রয়োগে সমস্যার চিহ্নিতকরণ এবং আইনের পরিবর্তন। কমিশন ব্যাংক খাতের দক্ষ, যুগোপযোগী ও সুশাসনভিত্তিক পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেবে। সরকারকে সেসব পরামর্শ বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে এ ধরনের উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়