রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য : শিশুবক্তা রফিকুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য পেছাল

আগের সংবাদ

ঢাবি সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি : বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে স্বচ্ছতা থাকতে হবে

পরের সংবাদ

স্বাধীনতার ঋণ : মেজর গণি ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার ঋণ : মেজর গণি ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট- এটি একটি প্রেক্ষাপট আলোচনা, পূর্ণাঙ্গ কোনো নিবন্ধ নয়। স্বাধীনতার ইতিহাস যারা চর্চা করছেন এই প্রেক্ষাপটটি স্মরণ রাখলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও তার প্রতিষ্ঠাতার প্রতি সুবিচার করতে পারবেন। ১৯ শতকে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে মার্শাল রেইস সামরিক জাতির সদস্যরাই কেবল ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য, অন্যরা নয়। ১৮৮৫-৯৩ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ লর্ড ফ্রেডেরিক রবার্টস এ ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ভারতের দক্ষিণাংশ থেকে সেনাবাহিনী যাদের নিয়োগ করেছে তিনি তাদের মনে করেছেন ‘আনওয়ারলাইক’ অর্থাৎ যুদ্ধের অনুপযুক্ত এবং উত্তরের কঠোর পরিশ্রমী যুবকরাই কেবল যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। ১৮৮০ থেকে ১৯০০-এর দশক পর্যন্ত অযোগ্য জাতির সদস্যদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগই নিষিদ্ধ ছিল। কমান্ডার ইন চিফ রবার্টসের পছন্দ ছিল পাঞ্জাবের শিখ আর নেপালের গোর্খা। তখন পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সৈনিকের অধিকাংশ সরবরাহ এসেছে পাঞ্জাব ও নেপাল থেকে। একক জাতি বিবেচনায় দুই মহাযুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি সৈন্য ছিল পাঞ্জাবি আর ধর্মীয় বিবেচনায় সর্বোচ্চ সংখ্যার সরবরাহ এসেছে পাঞ্জাবের মুসলমানদের মধ্য থেকে। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় অর্ধেক পাঞ্জাবের, ছয় ভাগের এক ভাগ গোর্খা ও পাঠান। এক-তৃতীয়াংশেরও কম ভারতের অন্যান্য জাতি থেকে।
‘যখন বাঙ্গালী পল্টন গঠন করার, প্রস্তাব হয় অনেক বাঙ্গালী মা বিশেষ করে যাদের একটিমাত্র পুত্রসন্তান তারা আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলেন, পাছে তাদের ছেলেরা সৈন্যদলভুক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারায়!… ছেলে যুদ্ধে না হয় না-ই গেল। কিন্তু বাংলাদেশ তো সকল রোগেরই আকর। এই সকল রোগে কত শিশু, বালক, কিশোর ও যুবক মায়ের কোল অন্ধকার করে অনন্তধামে চলে যাচ্ছে। কই, কোমল মা কি তার ছেলেকে রোগে অকালমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারছেন?…এক সময়ে তো এই বাংলাদেশের মায়েরাই নিজের হাতে ছেলেকে বীরসাজে সাজিয়ে যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিতেন। তবে আজ বাঙ্গালী মা ছেলের জন্য এতটা কাতর হয়ে কেন?’
চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার কিরণ চন্দ্র দে আইসিএস ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের জন্য সৈন্য সংগ্রহের যে আদেশ দিয়েছেন তা এমুখ-ওমুখ ঘুরতে ঘুরতে মায়েদের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে। সুতরাং আতঙ্কিত মায়েদের কান্না শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু জ্ঞানীজনেরা বলেছেন, এটা তো বাংলাদেশের জন্য অতিশয় সুখের সংবাদ। ৪৯ বেঙ্গলিজ গঠন করার কারণে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাঙালিদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এই শুভ সংবাদের পর মায়েরা কাঁদছেন আর বাবারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এর কারণ কী? ‘৪৯ বাঙ্গালী রেজিমেন্ট স্থায়ী হয়ে যাওয়ায় কেন আমাদের মনে এত আহ্লাদ হচ্ছে তার কারণ আর কিছুই নয়- আজ বাঙ্গালী জাতের অন্তত হাজার দুই-তিন লোকের মানুষের মতো মানুষ হওয়ার পথ খুলে গেল। আগে আমাদের ধারণা ছিল যে মানুষ হতে গেলে খুব বেশি করে লেখাপড়া শিখতে হবে- দেশসুদ্ধ লোককে বিএ, এমএ পাস করে উচ্চশিক্ষিত বলে পরিচিত হতে হবে- এক কথায় বিদ্যের জাহাজ হতে হবে।…’ প্রথম মহাযুদ্ধে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হলেও বাঙালি সৈনিকরা তাদের পুরনো বদনাম- যে তারা যোদ্ধার জাতি নয়, তা ঘোচাতে পারেনি। তারা যুদ্ধ করার সুযোগই পায়নি। তাদের বড় অংশ অসুখ-বিসুখে শয্যাশায়ী ছিল। এই রেজিমেন্টের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ব্যারেট বাঙালিদের রেজিমেন্টের স্কোয়াডগুলোর নাম দিয়েছিলেন : মিজলেস (হাম) স্কোয়াড, হুপিং কাফ স্কোয়াড ও স্কারলেট ফিভার (পীতজ্বর) স্কোয়াড।
বাঙালি পল্টনে যোগদান করতে যুবকদের বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হলেও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। বালিয়াদির জমিদার তার জমিদারির এক রায়ত যোগদান করলে তিনি তার খাজনা মওকুফ করেন এবং ২০ টাকা এককালীন অনুদান প্রদান করেন। সরকারের শুভদৃৃষ্টিতে থাকার জন্য জমিদাররা সর্বত্রই পুরস্কার ও প্রণোদনা ঘোষণা করেন। প্রতি মাসে অন্তত ২৫০ জন নবনিয়োগপ্রাপ্ত সৈনিকের চাহিদার জায়গায় তা ৯০ জনে নেমে আসে এবং আরো কমতে থাকে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ১৯১৫ সালের মে মাসে একজন মুসলমান হাবিলদার তার বন্ধু হাবিলদারকে চিঠিতে লেখেন : আল্লাহর দোহাই এসো না। ইউরোপের এ যুদ্ধে এসো না। তোমার রেজিমেন্ট কিংবা এর কোনো অংশ এখানে আসছে কি না আমাকে জানাও, আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আমার ভাই ইয়াকুব খানকে বলো সে যেন জওয়ান হওয়ার জন্য নাম না লেখায়, দোহাই লাগে। তোমার কোনো আত্মীয়ও যদি থাকে তাদের জন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে তালিকায় নাম লেখাতে বারণ করছি। শাওন মাসের বৃৃষ্টির মতো কামান, মেশিনগান, বন্দুক আর বোমা দিন-রাত সমানে বর্ষিত হচ্ছে। পাতিলে রান্না করা খাবারে সিদ্ধ না হওয়া একটা-দুটো শস্যদানার মতো কেউ কেউ বেঁচে গেছে। প্রথম থেকে ১৯১৯-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত ভারতীয়ের সংখ্যা ১৫ লাখ। আর বাঙালি সৈনিকদের রেজিমেন্ট ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় হাজার। ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি স্বল্পায়ু সেনা রেজিমেন্ট। আর গঠিত হয় ২৬ জুন ১৯১৭ এবং এটা দুর্ভাগ্যজনক যে মহাযুদ্ধের পর ৩০ আগস্ট ১৯২০-এ রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়।

স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ফেল করে বাঙালি
বাঙালিকে সৈন্য দলে নেয়া হবে। এ হুকুম হওয়ামাত্র দলে দলে ছেলেরা ভর্তি হতে গেল। কিন্তু ছেলেদের উৎসাহের অভাব না থাকলে কী হবে স্বাস্থ্যের অভাব বিলক্ষণই ছিল। ভর্তি হতে যেতেই ডাক্তারি পরীক্ষায় অনেককে ফেল হয়ে ফিরে আসতে হলো।…‘পরীক্ষায় দেখা গেল বাঙালি যুবকদের মধ্যে সৈন্য হওয়ার মতো ছোকরা খুব কম।’
এ বর্ণনা তুলে ধরছি ১০০-এরও অধিক বছরের পুরনো স্বাস্থ্য সমাচারে প্রকাশিত ৪৯ বেঙ্গলিজ থেকে (আশ্বিন ১৩২৬, লেখক অজ্ঞাত)।

ডিফেন্স অব ইস্ট পাকিস্তান লাইস ইন ওয়েস্ট পাকিস্তান
১৯৪৭-এর স্বাধীনতা বাঙালির জন্য এনে দেয় অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তান। এর একটি বিশ্বস্ত বিবরণ পাওয়া যায় আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর গ্রন্থে রয়েছে: ‘যথা সময়ের খানিকক্ষণ আগেই শহীদ সাহেব (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) তার গাড়িতে করিয়া আতাউর রহমান ও আমাকে লইয়া গভর্নমেন্ট হাউসে গেলেন। গভর্নমেন্ট হাউসের লাউঞ্জেই সর্বপ্রথম কালো মোচওয়ালা ছয় ফুটের বেশি লম্বা বিশাল আকারের এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা। শহীদ সাহেব পরিচয় করাইয়া দিলেন : ইনিই আমাদের প্রধান সেনাপতি ও বর্তমানে একই সঙ্গে দেশরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান।… তিনিই বলেছিলেন, ইস্ট পাকিস্তান ইজ ইনডিফেন্সিবল, ডিফেন্স অব ইস্ট পাকিস্তান লাইস ইন ওয়েস্ট পাকিস্তান। সরকারি দায়িত্বশীল লোকের মুখে ঐ ধরনের কথা শুনিয়া আমি যারপর নাই চটিয়া গিয়াছিলাম। এই ধরনের বিপজ্জনক কথা দায়িত্বশীল নেতার মুখের উপযোগী কথা নয়। … প্রধান সেনাপতি-দেশরক্ষা মন্ত্রী নিজের ঐ উক্তির সমর্থনে যা যা বলিলেন তা শুনিয়া আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমাদের প্রধান সেনাপতির মুখেও কলিকাতার মুসলিম বস্তিওয়ালার কথাই শুনিলাম। ভারত যদি পূর্ব বাংলা আক্রমণ করে, তবে পাকিস্তানি বাহিনী দিল্লির লালকেল্লা ও লোকসভার শিখরে পাকিস্তানি পতাকা উড্ডীন করিবে। হিন্দুস্তান অতঃপর পূর্ব পাকিস্তান ফিরাইয়া দিয়া আপস করিবে।’

মেজর গণি
মেজর আবদুল গণির জন্ম ১৫ ডিসেম্বর, ব্রিটিশ-ভারতের ত্রিপুরা জেলায়, এখনকার কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার নাগাইস গ্রমে। মাদ্রাসার ছাত্র হয়েও তিনি মেধা ও যোগ্যতায় সীমিত গণ্ডির বাইরে এসে ১৯৪১ সালে কিংস কমিশনে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে লড়াই করেন বার্মা রণাঙ্গনে। তিনি অনুভব করেন বাঙালির নিজস্ব রেজিমেন্ট থাকতে হবে। একটি প্রতিকূল অবস্থায় ক্যাপ্টেন গণির উদ্যোগ এবং ক্যাপ্টেন এস ইউ খান ও তার প্রচেষ্টায় অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট। লেফটেনেন্ট কর্নেল প্যাটারসন হলেন রেজিমেন্ট অধিনায়ক, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুকৃতি সর্বজনবিদিত। ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কার্যত পশ্চিম পাকিস্তান সুরক্ষায় সবচেয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে বাংলার এই রেজিমেন্ট। আর অনস্বীকার্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে বেঙ্গল রেজিমেন্ট। স্বাধীনতা যুদ্ধে ২ জন বীরশ্রেষ্ঠসহ ৩৫২ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাই বেঙ্গল রেজিমেন্টের। সেই রেজিমেন্টের সৃষ্টি টাইগার গণি হিসেবে পরিচিত মেজর গণির হাত ধরে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্বতন্ত্র ও প্রতিবাদী চরিত্রের গণিকে ধারণ করতে পারেনি। অকালে সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীকে পরাস্ত করে নির্বাচিত হন এবং প্রাদেশিক পরিষদে একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানের ভূমিকা পালন করেন। জার্মানিতে সাবেক সৈনিকদের সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে ১১ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে আকস্মিকভাবে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ নিয়ে পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে মেজর গণি প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইংরেজিতে লিখিত যে প্রস্তাবনা পেশ করেছেন তাতে তার মিশন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার যে রাজনৈতিক বিবেচনা ও প্রতিরক্ষা দর্শন এতে প্রতিভাত সংক্ষেপে তা উপস্থাপন করা হচ্ছে:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সামরিক সহায়তা ও অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না দেয়ায় দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তান সমালোচিত ও সন্দেহভাজন হয়ে উঠেছে; বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান এ নিয়ে সোচ্চার। নিঃসন্দেহে জাতীয় নিরাপত্তা সর্Ÿোচ্চ অগ্রাধিকার, কিন্তু তা হতে হবে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য, কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য নয়। এ ধারণা দেশের পশ্চিমাংশের মানুষের মধ্যে বহুল প্রচারিত হয়ে উঠেছে যে পূর্ব পাকিস্তানিরা তাদের ভূখণ্ড প্রতিরক্ষায় সক্ষম নয়- এ ধারণাকে বদ্ধমূল হতে দেয়া উচিত হবে না। এখন সন্দেহ করার সঙ্গত কারণ রয়েছে পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে সামরিক পরিকল্পনা ও কৌশলগত প্রতিরক্ষা চর্চা কেন্দ্রের হেয়ালিপূর্ণ ভাবনার ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে, এটাও বদ্ধমূল হয়ে পড়েছে যে পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিক নিরাপত্তা পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল। সামরিক সহায়তা দিয়ে প্রতিরক্ষা ও আক্রমণভাগ উভয়ই শক্তিশালী করার মাধ্যমে পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে গণতন্ত্র সংহতকরণের জন্য যে আমেরিকান নীতির কথা বলা হচ্ছে পাকিস্তানের বেলায় তার খণ্ডিত ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার বাইরে রেখে কেবল পশ্চিমের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই লক্ষ্য। সশস্ত্র আন্দোলন ও বহিঃশত্রæর অনুপ্রবেশ যে পূর্বাঞ্চলেও ঘটবে তা মোটেও আমলে নেয়া হচ্ছে না।
পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কি কেবল কিছু বন্দুক আর গোলাবারুদের কথা বলা হচ্ছে? মোটেও তা নয়। জনগণের দক্ষ সামরিকায়ন বা মিলিটারাইজেশনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য দরকার প্রতিরক্ষা বাহিনীর গ্যারিসন, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যায় সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষার অন্যান্য সেক্টরে নিয়োগ প্রদান। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কোনো সামরিক পরিকল্পনা এবং কৌশলগত কর্মসূচি প্রণয়ন অর্থহীন বলে যারা মনে করছেন কার্যত তারাই পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও সামরিক সক্ষমতার ওপর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নির্ভরতার দর্শন ভ্রান্ত হতে বাধ্য। প্রতিরক্ষার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের আক্রমণ সক্ষমতাও একই সঙ্গে বাড়াতে হবে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে নৌ ও বিমান বাহিনীও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক সহায়তা পাঠিয়ে অঞ্চলটির সুরক্ষার পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং একই সঙ্গে তা পাকিস্তানের মার্কিন বলয়ের সঙ্গে সম্পাদিত সিয়াটো প্রতিশ্রæতিরও পরিপন্থি। বাঙালি মার্শাল রেস নয় এই ধারণা থেকে বের হতে তাদের শারীরিক গঠনের দোহাই দেয়া অসমীচীন, কারণ স্মরণ রাখতে হবে গোর্খা রেজিমেন্টে সৈনিক নিয়োগে পাঁচ ফুট উচ্চতাই গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। আর ইতিহাস গোর্খা রেজিমেন্টের সাফল্যের সাক্ষ্য দেয়। মানতেই হবে মেজর গণির প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়