মাসুদ বিন মোমেন আরো দুই বছর পররাষ্ট্র সচিব

আগের সংবাদ

বিশ্বকাপ উন্মাদনায় মেতেছে বিশ্ব

পরের সংবাদ

হাস্যরস সাহিত্য ধারার অসামান্য কারুকার

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাবা ছিলেন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের বড় কর্তা। ছেলেটিরও ইচ্ছে বাবার মতো ব্যাংকার হবে। পড়াশোনা করবে অর্থনীতি বিষয়ে। তাই ক্লাস নাইনে উঠে ঠিক করল মানববিদ্যা বিভাগ মানে আর্টস নেবে। মানববিদ্যা বিভাগে ১৫ দিন ক্লাসও করল। ক্লাসে বাঙালি ছাত্র ছিল মাত্র ১২ জন আর ছেলেটি ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয়। বাঙালি সহপাঠী বন্ধুরা ছেলেটিকে বলল, তুমি সায়েন্স পড়, তুমি সায়েন্স পড়লে আমরা সাহস পাব, আমরাও পড়ব। কিন্তু ছেলেটি বলল, না ভাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে অর্থনীতি বিষয় পড়তে হবে। তার জন্য সায়েন্স পড়ার দরকার কী? বন্ধুরা বলল, তাহলে তো জাহিদ জিতে গেল। জাহিদ হলো ক্লাসের সেকেন্ড বয় এবং অবাঙালি ছাত্র। বন্ধুরা বলল, জাহিদ বলেছে, তোমরা আর্টস নেবে না তো কী নেবে? তোমাদের বাঙালিদের মাথায় ঘিলু আছে, যে সায়েন্স পড়বে, ঘিলু নেই। জাহিদের এই কথা শুনে ছেলেটি সিদ্ধান্ত পাল্টাল। আর্টস ছেড়ে দিয়ে সায়েন্স পড়ল এবং ভালো রেজাল্ট করে অবাঙালিদের পেছনে ফেলে দিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ল অর্থনীতি বিষয় নিয়ে আর বাবার মতো ব্যাংকার হলো। গল্পকার ইমরুল চৌধুরী ছিলেন ছেলেটির কাকা। কাকার দেখাদেখি ছাত্র বয়সেই শুরু করল গল্প লেখা। নতুন ধরনের মজার সব গল্প লিখে সাড়া ফেলে দিল চারদিকে।
বলছি কাইজার চৌধুরীর কথা। জীবনটাও তার গল্পের মতোই বর্ণাঢ্য ও আকর্ষণীয়। আপাদমস্তক গল্পের মানুষ তিনি। গল্প তার চোখেমুখে, মগজের কোষে কোষে, শিরা-উপশিরায়। গল্প যেন তাকে ঘুমাতে দেয় না। মন খুলে গল্প শোনাতে পারলেই যেন তার শান্তি। গল্প বলেন মজা করে, রসিয়ে রসিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে। দারুণ তার গল্প বলার ভঙ্গি। যেমন তার কাহিনীর চমক, তেমনি বর্ণনার ঝলক। কথার চমৎকারিত্বে কখনো ঘোর লাগার জোগাড়, কখনো আবার হতবাক মানতে হয় বিস্ময়ে। বিষয়ে বুননে কথনে অত্যন্ত সপ্রতিভ আধুনিক গল্পের রূপকার তিনি। যদি তার গল্পের সঙ্গে লেখকের নাম নাও ছাপা হয়, তবু পাঠকের বুঝতে কষ্ট হয় না, গল্পটি কার। এই স্বতন্ত্র ধারার গল্প লেখকের নাম কাইজার চৌধুরী। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে অবিরল ধারায় লিখে চলেছেন তিনি। লিখছেন ছোটদের জন্য। কিন্তু কেবল ছোটরাই তার পাঠক নয়। তিনি সেই শিশুসাহিত্যের লেখক, যা সর্বজন পাঠ্য। তাই তার পাঠক-পরিধি বেশ বিস্তৃত। বিপুল পাঠক-নন্দিত লেখক তিনি।
কাইজার চৌধুরী মূলত হাস্যরস ধারার লেখক। সহজাত হাস্যরস তার রচনার প্রাণ। রসময় উপস্থাপন যেন তার স্বভাবজাত ব্যাপার। যে কোনো বিষয় নিয়েই লিখুন না কেন, সরস উপস্থাপনার গুণে তার সব লেখায় হাস্যরসটাই প্রধান হয়ে ওঠে। তবে হাস্যরসের আড়ালে গল্পের মূল সুর-স্বাদ কখনো ঢাকা পড়ে না। বরং ভিন্ন মাত্রা পায়। এটি তার রচনার অনন্য বৈশিষ্ট্য। তার এই ধারার পাঠকপ্রিয় বইগুলো হলো, ‘বিল্টু মামার হালচাল’ (১৯৯০), ‘বিল্টু মামার যত কাণ্ড’ (১৯৯২), ‘বিল্টু মামার আরেক কাণ্ড’ (২০১৪)। এসব লেখার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যে সৃষ্টি করেছেন বিল্টু মামা নামের মজার চরিত্রটি।
কাইজার চৌধুরীর বিষয়-বৈচিত্র্য, ধরন-প্রকৃতি একেবারে তার নিজস্ব। যখনই তিনি যে বিষয়ে কলম ধরেছেন, তার অনুপম ভাষাভঙ্গি ও প্রকাশভঙ্গির কারণে তা হয়ে ওঠে অনবদ্য সৃষ্টি। বাংলাদেশে হাস্যরস-প্রধান সাহিত্য-ধারার এক অসামান্য কারুকার তিনি। নির্মল হাসির গল্প ছাড়াও তিনি প্রচুর মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখেছেন, লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এই পর্বে তার বিশেষ আলোড়িত লেখা ‘শেমুর’ (১৯৯৫)। শেমুর মানে শেখ মুজিবুর রহমান। এটি রূপকথাধর্মী একটি বড় গল্প। বঙ্গবন্ধুর বীরত্বগাথার মহাকাব্যিক রূপায়ণ। লেখকের বয়ানে একটু জানা যাক-
‘শেখ মুজিবুর রহমান!-কিশোরের গলায় বিস্ময়।-কী অদ্ভুত নাম! আমাদের কারু তো এমন ধরনের নাম রাখা হয় না মা! ওর বেলায় হলো কেন?
‘মা হেসে কয়, রাতদুপুরে কীসব প্রশ্ন করছ বাছা! তবে বলছি শোনো। যারা মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে, যারা মানুষের জীবনে সুখ আনতে যেয়ে নিজে দুঃখ-কষ্ট সয়ে যায়, সেইসব লড়াকু মানুষদের আমরা শেখ মুজিবুর রহমান নামেই ডাকি।’
কাইজার চৌধুরীর সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত গল্পের বইটির নাম ‘মুজিবুরের বাড়ি ফেরা’। ভোরের কাগজ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত পাঁচটি গল্পে সাজানো এক চমৎকার বই এটি। গল্পগুলো হলো- হেকমত দারোগা, নেয়ামত-কেরামতের গল্প, মুখোশ, বেলাল বাড়ি ফিরেছে কী, মুজিবুরের রাড়ি ফেরা। কাইজার চৌধুরীর বঙ্গবন্ধু বিষয়ের গল্পগুলো অমিত বিক্রম মানবতাবাদী বীরের প্রতি অনন্য শ্রদ্ধার্ঘ।
তিনি ভূতের গল্প লিখেছেন অসংখ্য। সেসব গল্পের আঙ্গিক-অনুষঙ্গ আশ্চর্য আনকোরা। তার এই ধারার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো- ‘সপ্তভূতের সপ্তকাণ্ড’ (১৯৯১), ‘ভূত চেনা সহজ নয়’ (১৯৯৩), ‘পুরনো সেই ভূতের কথা’ (২০০০), ‘চোরের গল্প ভূতের গল্প’, ভূতের খোঁজে’ (২০০২) ইত্যাদি। ভূতের গল্প মানে ফ্যান্টাসির জগৎ। কিন্তু তার ভূতের গল্প নিছক ফ্যান্টাসির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, একই সঙ্গে নানা শিক্ষণীয় উপাদানে সমৃদ্ধ। অসামান্য কল্পনাশক্তির ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিময়। গোয়েন্দা ও রহস্য গল্পও তিনি লিখেছেন। যেমন, গোয়েন্দা সাজল বিল্টু মামা’ (১৯৯২), ‘পরশ পাথর রহস্য’(১৯৯৪)। ‘একাত্তরের রূপকথা’, ‘একাত্তরের ছেলেরা’, ‘শোভনের একাত্তর’, ‘ঘটেছিল একাত্তরে’ ইত্যাদি তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাড়া জাগানো গল্প-উপন্যাস। তার মুক্তিযুদ্ধের গল্পকথা হানাদার শত্রæবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরের প্রতি তীর্যক ভাষ্যে অদ্ভুত ব্যাঙ্গাত্মক আখ্যান। স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির প্রাচুর্যময় প্রাণের উল্লাস।
কাইজার চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন যথাক্রমে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে। পেশাগত জীবনে ছিলেন খ্যাতিমান ব্যাংকার। এবি ব্যাংকসহ দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন সফলতার সঙ্গে। এই প্রাণবন্ত সুরসিক গল্পকার স্বভাবে ঈষৎ গম্ভীর, কিন্তু সামাজিকতায় অত্যন্ত আন্তরিক, বন্ধুবৎসল। ভেতরে ভেতরে ভীষণ কোমল মনের মানুষ, দুঃখ-কষ্ট একেবারেই সহ্য হয় না তার। তাই জীবনে একটিও কষ্টের গল্প লেখেননি। মার্জিত রুচির হৃদয়বান এক মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। চেনা-জানা মানুষের সমস্যা সংকটে তিনি সব সময় সাহায্য-সহযোগিতায় উদারহস্ত।
শিল্পসাহিত্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নিয়েও গভীর উৎসাহ তার। শিশুসাহিত্য ছাড়াও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এবং লাতিন আমেরিকা ও প্রতিবাদী চলচ্চিত্র বিষয়ে তার মূল্যবান গবেষণা-প্রবন্ধ রয়েছে। তবে তার প্রধান সুখ্যাতি শিশুসাহিত্য রচনার জন্য। শিশুসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার, চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদক এবং ছোটদের কাগজ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তবে একজন লেখকের প্রার্থিত যে পুরস্কার পাঠকের ভালোবাসা, সেটা তিনি অর্জন করেছেন অভূতপূর্ব মাত্রায়। আমাদের এক বিরল চরিত্রের বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী। গত ১৫ নভেম্বর ছিল তার ৭৪তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন প্রিয় শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী। আপনি দীর্ঘজীবী হোন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়