মাসুদ বিন মোমেন আরো দুই বছর পররাষ্ট্র সচিব

আগের সংবাদ

বিশ্বকাপ উন্মাদনায় মেতেছে বিশ্ব

পরের সংবাদ

জন্মদিন > শাহরিয়ার কবির : মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসা¤প্রদায়িক দেশ গঠনে নিবেদিতপ্রাণ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন সে আন্দোলনকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন শহীদ জননীর সার্থক উত্তরাধিকারী শাহরিয়ার কবির। শাহরিয়ার কবির বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান লেখক, সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। লেখক হিসেবে তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি একজন শিশু সাহিত্যিক। কয়েক দশক ধরে শিশুসাহিত্য লিখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকায় ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাঁকে চাকরিচ্যুত করে। এরপর থেকে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের পাশাপাশি এই আন্দোলনকে বেগবান করার কাজে মনোনিবেশ করেন।
১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে দলনিরপেক্ষ ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। নির্মূল কমিটি গঠনের মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাজী নূর-উজ্জামান, শাহরিয়ার কবির ও জাহানারা ইমাম। নির্মূল কমিটি গঠনের কয়েকদিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি ৭২ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় জাতীয় সমন্বয় কমিটি। সমন্বয় কমিটি গঠনের পর শহীদ জননী পুরো সময় সমন্বয়ের কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত রাখেন। তখন শাহরিয়ার কবির নির্মূল কমিটি এবং সমন্বয় কমিটি দুটোতেই যুক্ত থেকে জাহানারা ইমামকে সহায়তা করেন। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহীদ জননীর মৃত্যুর পর জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া সমন্বয়ের শরিক রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। ফলে সমন্বয় কমিটির কর্মকাণ্ড এক রকম বন্ধই হয়ে যায়।
শহীদ জননী সূচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের এই আন্দোলনের গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে রাজপথে এই আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য শাহরিয়ার কবিরের উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে নির্মূল কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। সে বছর মে মাসে মহানগর সম্মেলন করার ভেতর দিয়ে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে নির্মূল কমিটির শাখা গড়ে ওঠে এবং নতুন কর্মীবাহিনীর সৃষ্টি হয়। মূলত তখন থেকেই শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়াই নির্মূল কমিটির আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। শহীদ জননীর আন্দোলনকে বহুমাত্রিক করা এবং এই আন্দোলন তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এই আন্দোলনের কর্মীবাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান করার লক্ষ্যে ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে তরুণ কর্মীদের জন্য কর্মশালা করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে সচেতন করা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’ স্থাপন ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মেলা’র আয়োজন করা।
যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্ম অনুসন্ধানের জন্য ১৯৯৩ সালে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল জাতীয় গণতদন্ত কমিশন। তাঁর নেতৃত্বে মূলত নির্মূল কমিটির তরুণ নেতাকর্মীরা এবং শুভানুধ্যায়ীরা মাঠ পর্যায়ে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দুরূহ এই তদন্ত কাজ সম্পন্ন করেন। ১৯৯৩ এবং ১৯৯৪ সালে ২ খণ্ডে ১৬ জন যুদ্ধাপরাধীর দুষ্কর্মের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনার অনুসন্ধান এবং ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি নথিকরণের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। এসব জবানবন্দির ভিত্তিতে নির্মূল কমিটি ১৯৯৯ সালে ‘একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি’সহ কয়েকটি সংকলন প্রকাশ করে। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের দুষ্কর্মের তদন্ত প্রতিবেদন এবং ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে প্রদান করা হয়।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসমূহের ওপর যে নজিরবিহীন নির্যাতন চলেছে তার ওপর প্রায় তিন হাজার পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র ২০০৫ সালে প্রকাশ করেন শাহরিয়ার কবির। সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে। এরপর ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে অনুরূপ আরো দুটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে, যার মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা চার হাজারের উপরে।
২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নির্মূল কমিটির জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বিঘিœত ও বানচালের উদ্দেশ্যে দেশে-বিদেশে জামায়াত ও সমমনা বিভিন্ন দলের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা। আরো চ্যালেঞ্জিং ছিল সর্বোচ্চ আদালতে শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারীদের বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং ট্রাইব্যুনালের রায় পরিবর্তনের সম্ভাবনা। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলার কর্মসূচিতে শাহরিয়ার কবিরের আহ্বানে নির্মূল কমিটির সঙ্গে শরিক হয়ে দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে আদালত অবমাননার জন্য শাস্তিও পেতে হয়েছে, কিন্তু নির্মূল কমিটি তাদের অবস্থানে অনড় থেকে নিজামী, মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মীর কাশেমসহ শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে পেরেছে।
জাহানারা ইমাম ও শাহরিয়ার কবির- নির্মূল কমিটির এই দুই প্রতিষ্ঠাতার উদ্যোগে ১৯৯২ সাল থেকেই বহির্বিশ্বে নির্মূল কমিটির আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মান শাখা গঠিত হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য এবং ইউরোপের ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম এবং অস্ট্রেলিয়ায় নির্মূল কমিটির শাখা গঠিত হয়েছে। ২০১২ সালে শাহরিয়ার কবিরের উদ্যোগে পাকিস্তানেও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাখা গঠিত হয়েছে। নির্মূল কমিটি শুধু বাংলাদেশে নয়, বহির্বিশ্বেও নাগরিক আন্দোলনের আইকনে পরিণত হয়েছে। নির্মূল কমিটি সংগঠন থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নির্মূল কমিটি বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরেও মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের তত্ত্ব নির্মাণের পাশাপাশি রাজপথে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলন সম্পর্কে গবেষণা হচ্ছে, এম ফিল ও পিএইচডির অভিসন্দর্ভ রচিত হচ্ছে। বিদেশ থেকে গণমাধ্যম কর্মী ও গবেষকরা আসছেন এই আন্দোলন সম্পর্কে জানার জন্য। এই আন্দোলন সম্পর্কে দেশে ও বিদেশে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে। প্রতি বছর নির্মূল কমিটির নেতারা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হচ্ছেন।
গত ২৭ বছরের আন্দোলনের ভেতর দিয়ে নির্মূল কমিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে পেরেছে। আন্দোলনে যৌথ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে কেন্দ্র থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটির যাত্রা শুরু হয়েছে এবং শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে আন্দোলনের সফলতা এসেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নির্মূল কমিটি কাজ করে যাচ্ছে।
নির্মূল কমিটি গঠনের পর থেকে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বে আজ এই পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে দেশের ভিতরে ২০০টি এবং দেশের বাইরে ১২টি শাখা রয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযম আমির মনোনীত হওয়ার প্রতিবাদে এই সংগঠনের জন্ম হলেও বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতি আন্দোলনে নির্মূল কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের পর ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে নির্মূল কমিটির মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলন সফলতা লাভ করে। তবে নির্মূল কমিটির অন্য একটি লক্ষ্য ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, যার জন্য শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটির নেতারা নিরলস পরিশ্রম করছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শহীদ জননী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিস্তারের যে ঝান্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন তার সার্থক উত্তরাধিকার বহন করছেন তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি শাহরিয়ার কবির। তিনি সে পতাকাকে গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে দেয়ার কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি- সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন না ঘটানো পর্যন্ত নির্মূল কমিটির এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিস্তারের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ধর্মনিরপেক্ষ অসা¤প্রদায়িক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নির্মূল কমিটি। নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল এই দুজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন, সভা করেছেন, করেছেন বক্তৃতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলতে। তারা যেন করেছেন নতুন এক মুক্তিযুদ্ধ। জাতি হিসেবে এই দুজন ব্যক্তিত্বের কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য।
আগামী ২০ নভেম্বর এই নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে তাকে শুভেচ্ছা ও শুভাকামনা জানিয়ে অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি যাতে আরো দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব দিতে পারেন সে প্রত্যাশা থাকল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়