মাসুদ বিন মোমেন আরো দুই বছর পররাষ্ট্র সচিব

আগের সংবাদ

বিশ্বকাপ উন্মাদনায় মেতেছে বিশ্ব

পরের সংবাদ

আলতাবানু

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমড়াগাছের ডালে একটা কাক ক্ষণে-ক্ষণে ডেকে যাচ্ছে, শীতের দুপুরবেলা, রোদ মাথার ওপর থাকলেও কেমন যেন শীতের ভাবটা বেশ জানান দিচ্ছে, বাঁশঝাড়ের সবুজ পাতাদের কানে-কানে কথার ঢেউ বেশ পষ্ট আছড়ে পড়ছে এখন, ওদিকের রতনপুরের সড়ক ধরে ইয়াজুদ্দি মোল্লা নিজের কেনা বাইকে বাড়ি ফিরছে, দুপুরের আহারের সময় হলেও তার কিন্তু দুপুর-বিকেল রাত্রি বলে কোনো কথা নেই। খাওয়াটাকে সে অতো পাত্তা দেয় না। রতনপুরের বাজারে তার লুঙ্গি-গামছা কাপড়ের দোকান, সপ্তাহে দুই দিন হাটবারে তো কথায় নেই, অন্যবারেও তার দোকান দেদারসে চলে, তার কাছে ব্যবসা মানে আল্লাহর হালাল রিজিক। দোকানে তার দু’ দুটো লোকও কাজ করে, দিন নেই রাত্রি নেই আল্লাহ তাকে হাত উজার করেই দিয়েছে, আর তাই গত বছর হজটাও পালন করে এসেছে, তারপর থেকে হাজিদের মতো পোশাকটাকে আর ছাড়েনি, সৌদি পোশাক গায়ে জড়িয়ে থাকে, নিজেকে সে এখন নেক-বান্দা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে, আজকে দুপুর বেলা বাড়ি ফেরার কারণ শুধু যে দুপুরের খানা তা নয়, রোজিনার একমাত্র ছোটবোন আলতাবানু অনেক বছর পরে বোন-বোনাইয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছে, এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেই যতীন বাগদীর মোটরচালিত যান মানে ভটভটিতে চড়ে রসুলডাঙ্গা থেকে নয় ক্রোশ দূরে জাহানারাবাগে এসেছে, খবরটা যতীনকে দিয়েই রোজিনা জানিয়েছে স্বামী ইয়াজুদ্দিকে। পাকুড়িয়া-কলমা-বিল্লি-নাদনহাট থেকে সোজা দক্ষিণমুখো তারপর পলাশী-মাছভাঙা হয়ে খাড়ি জমি ধরে সখীপুরের এঁটেল মাটির তপ্ত গরম, ওপাশে মতিনগঞ্জের ইটভাটা তারপর মেহেদিচরের বিরান প্রান্তর, চকনকুলপুরের সীমানা পেরিয়ে এলেই পরে জাহানারাবাগ, রসুলডাঙ্গা থেকে দূরত্ব যেমন, তেমনি বেশ কষ্টও সহ্য করতে হয়। কিন্তু খবর হচ্ছে শালিকা বলে কথা, খবর শুনেই মন কেমন উছাটন হয়ে ওঠে, একমাত্র শালিকা দীর্ঘদিন পরে বাড়ি এসেছে তখন দুলাভাই কি আর হিসেব-নিকেশ নিয়ে দোকানে পড়ে থাকতে পারে! ব্যবসাপাতি রেখে মাছ-মাংস মুরগি বাইকে চড়িয়ে বাড়ি ফেরে ইয়াজ, বাড়ির ভেতর তখন অনেক গালগল্প কথা আর হাসাহাসি, ইয়াজ স্বাভাবিকের চেয়েও একটু নরোম হয়ে গলার শব্দ দেয়, আলতাবানু ঘর থেকে দাওয়ায় বেরিয়ে আসে, ইয়াজ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে, ভাবতেই তার মাথা আউলা-ঝাউলা হয়ে যায়, তার একমাত্র শালিকা আলতা, এতটা সুন্দরী আর এত বড়টি হয়ে গেলো অথচ সে কোনো খবরই রাখেনি। এমন ডাসা পেয়ারার মতো চিবুক-ললাট-ঠোঁট, সমস্ত শরীর যেন নদীর জোয়ার, কুলকুল করে নিরবধি সুর ধরে এগিয়ে যাবে কোথায় কোন দূর অচিনপুরে। নিজেকে ঢেকে কোথায় রাখবে ভেবে পায় না। ইয়াজ মনে-মনে ভাবে তার তো টাকা-পয়সা সম্পদ-সম্পত্তি কোনো কিছুই কমতি নেই, সংসারে যেদিক তাকাবে, সবখানে সুখ উথলে পড়ছে, গোয়াল ভরা গাই-বাছুর-গরু, দীঘি ভরা মাছ, ক্ষেত ভরা ফসল, গোলাঘর ভরা ধান, চালে-মাচায় আনাজ তরিতরকারী, বাগানের গাছে ফল-ফলালি বাড়ির দাওয়ায় রবিশস্য সরিষা-আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন অথচ তারপরও কেমন যেন অন্ধকার, রোজিনার কোলে একটা বাচ্চা আসেনি আজো, ডাক্তার-কবিরাজ সবই দেখিয়ে একটা জিনিস প্রমাণ হয়েছে দোষ কিন্তু রোজিনার নয়, মাদারীগঞ্জের খ্যাতনামা হেকিম আলফাজ তালুকদার সাহেবও স্পষ্ট জানিয়েছে, দোষটা হলো ইয়াজুদ্দির জন্মগত, কোনোদিন বাবা হতে পারবে না- তারপরও সে তাদের কথা বিশ্বাস করতে পারে না। নিজে গিয়ে হজ করে এসেছে- সে কারণেও বলা যায়। নিজের দোষ থাকতে পারে, তা মানতে কষ্ট হলেও বিশ্বাস করতে পারে না। অনেক দিন থেকে মনে-মনে ভেবে রেখেছে আবার চেষ্টা করবে, হজ কাফেলার সময় মহিষতলার বরজাহান হাজি ওরফে তেঁতলে বলেছিল, বাল-বাচ্চা হলো আল্লাহ পাকের দান…
ইয়াজু বলেছিল, কিন্তু হাজি সাহেব, দোষ তো আমার ডাক্তার বলে!
-রাখো মিঞা দোষ? দোষ আমাকে দেখিয়েও না, দোষ…
-ডাক্তার-কবিরাজ-হেকিমরা…
-কার দোষ কে জানে, স্বয়ং আল্লাহ পাকের দুনিয়ায় মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা গুনাহ, কবিরা গুনাহ!
-কিন্তু আমি কী করতে পারি।
-কী করবে জানো না মিঞা, আল্লাহর কেরামতি বোঝে কার সাধ্যি, হজরত ইব্রাহিম (আঃ) বৃদ্ধ বয়সে বিয়ে করেছিলেন, কি ইসমাইল (আঃ) এর জন্ম হয়নি, রাসুল্লাহ সাল্লেলিসালামের সব থেকে কাছের সাহাবি ছিলেন মাবিয়া, কঠিন অসুখে পড়ে শেষ বয়সে বিয়ে করে ইয়াজিদের জন্ম হয়, মাজেজা বুঝলে…
-কিন্তু আমি কী করবো…
-আহা চেষ্টা করবে, আল্লাহ মানুষকে সবুর করতে বলেছে, নিরাশ হতে বলেনি এবং একমাত্র সবুর কন্যে ওলাই আল্লাহর দিদার পায়-
-তুমি মিঞা আবার বিয়ে করবে, তাছাড়া প্রথম বিয়েটা ফরজ আর দ্বিতীয়টা কিন্তু সুন্নত, ইয়াদ আছে তো!
-বিয়ে করাটা এখন কেমন দেখায়।
-তুমি তো নামাজি হয়েও বে-নামাজি বে-দ্বীন নাফরমানির মতো কথা বলছো, তোমার কী আর বয়স, ধন-সম্পদ বেশ করেছো, একসঙ্গে চারটে বিবি ঘরে রাখতে পারো, তা কি জানো না।
তেঁতলে হাজির কথা অনেক ভেবেছে, মানুষটা অনেক দিন হলো দুনিয়া ছেড়েছে, বয়স হয়েছিল, কিন্তু ভেবে কোনো কুল-কিনারা করতে পারেনি। সংসারে একটা নতুন মানুষকে বরণ করার মনোবৃত্তি সবার থাকে না, থাকলেও সামাজিক সুতোর টানে কেমন যেন আলগা হয়ে যায়, তখন আরো বেখাপ্পা লাগে। একরাত্রে সরাসরি রোজিনাকে কথাটা বলতেই, সে কি কান্নাকাটি, সতীনের সঙ্গে থাকতে পারবে না, যদি সতীন আসে তো বিষ খেয়ে মরবে বলেও ভয় দেখায়। সেই ভয় থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়া তারপর একেবারে নিজের মতো থাকা, ইয়াজুদ্দি এতদিন নিজের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু এখন আলতাবানুকে দেখে মনটা কেমন যেন ময়ুরপঙ্খির মতো চঞ্চলা হয়ে উঠলো, মায়ের পেটের দু’ বোন বেশ থাকবে সংসারে, মা-মেয়ের মতো, দূর ছাঁই আসতাগফেরুল্লা! দু’ বোনের মতো—-
যাই হোক কথাটা এখন তুললেও কোনো ক্ষতি নেই, রোজিনা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। বিয়ে তাকে করতেই হবে আর আলতার পাশে তাকে নেহাৎই মন্দ লাগবে না। পুরুষ মানুষের আবার বয়স বলে কি কোনো কথা আছে? তাছাড়া তার মতো এমন জামাতা পাবে খুঁজে- ওদের বাপ-ভাই। দরকার হলে ওর ছোট ভাইটা, যে বেকার হয়ে বাপের অন্ন ধ্বংস করছে, তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবে টাকা খরচা করে, আর বুড়ো শ্বশুরকে লাখ তিনেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলবে, এবার আপনি আল্লাহ পাকের ঘর আর মদিনাতুল মনোয়ারা অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর পবিত্র রওজা মোবারক জিয়ারত করে আসেন, এতে নিশ্চয় মাছ ঠিকই বড়শি গিলবেই, কারণ টাকায় পৃথিবীর সমস্ত সম্মানের উৎস। এতেই শ্বশুরের মন যেমন গলবে তেমনি আলতাবানুর মন সরস হবে আর ছোট শালাটারও একটা হিল্লে হলে কৃতজ্ঞতার বুঁদবুঁদ ছাড়বে, প্রতিবাদি চেহারাটা নিমেষে সমূলে ধ্বংস হবে। আর রোজিনারও কোনো আশ্রয়হীন হওয়ার শঙ্কা থাকবে না, বাপ-ভাইয়ের সুখ-শান্তি দেখে আলতাকে আপোসে বরণ করে নেবে। কোনো উচ্চবাক্য করার ক্ষমতা থাকবে না।
আচমকা আলতাবানু চকমকিয়ে কথা বলে ওঠে, কী দুলাভাই কথা বলা থেমে গেলো যে, নাকি আমার ওপর হেভি রেগে আছেন…
চোখের তারায় ঝিলিক তুলে ইয়াজু তাকায়, ক্ষেপে তো আছি রে শালিকা, আর কেনো বা ক্ষেপবো না বলো দেখি…
-কেনো-কেনো আমি এসে কি বিপদে ফেলেছি, তাহলে চলে যাচ্ছি…
-বিপদ আমার আবার কিসের বিপদ, আমাকে আগে জানালে আমি গিয়ে বাইকে চড়িয়ে নিয়ে আসতাম তুমি জানো না।
শালিকা-দুলাভাইয়ের রঙ্গের রসিকতার কথা শুনে রোজিনা মুখ টিপে হেসে কাপড়ে মুখ লুকিয়ে বাড়ির ভেতর চলে যায়। দুপুরের রেশমি রোদটুকু আলতার চোখে-মুখে লেগে আরো খানিক খোলতাই দেখায়, গোয়াল ঘরের ভেতর থেকে একটা বাছুর ছুটে বেরিয়ে ওপাশের দীঘিটার দিকে চলে যায়। বাতাবিলেবু গাছের মাথায় শীতের রোদ বেলা শেষের গল্প শোনায়, তবে এখনো দিনের আলো নিভতে অনেক দেরী, কার্তিকের রোদ তারপরও বেশ মিষ্টি লাগে, বাতাসে কি একটা ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে, ইয়াজুর কাছে মনে হয় আলতার শরীর থেকে খুব মিষ্টি এই সুভাস আসছে, চুলের সুভাস আর শরীরের সুভাস মিলেমিশে অন্যরকম এক স্বতন্ত্র ঘ্রাণ তৈরি হয়ে বাতাসকে করে তুলছে মাতোয়ারা। টিনের চালে কয়েকটি চড়–ই কিচিরমিচির জুড়ে দিয়েছে, ওদের যেন আজ আনন্দের দিন, কিসের আনন্দ এত, নাকি একে অপরের সঙ্গে খুনসুটি, সে যাই করুক, মিষ্টি ঘ্রাণের সঙ্গে মিষ্টি কিচিরমিচির বেশ লাগে। মন কেমন জুড়িয়ে যায়, ভালো হয়ে যায়।
আলতাবানু-রোজিনা ভাত বেড়ে দেয় ইয়াজুদ্দি হাজিকে, আসলে আলতা তার বোনকে সহযোগিতা করে হাতে-হাতে, কিন্তু ইয়াজু নাছোরবান্দা, একসঙ্গে খেতে হবে দু’বোনকে, কথামত তারপর তারা একসঙ্গে টেবিল-চেয়ারে খেতে থাকে, ইয়াজুর নজর সবসময় আলতার দিকে হলেও রোজিনা কিন্তু ওসবে তেমন পাত্তা দেয় না, কারণ সে জানে তার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে করার কোনো মুরোদ নেই। আর আলতার মতো মেয়েকে ঘায়েল করাটাও চাট্টিখানি কথা নয়। আজকের দিনের মেয়ে বলে নয় আলতা কিন্তু অনেক বেশি সচেতন, বিশেষ করে নিজের ব্যাপারে, বয়স কম হলেও অনেক ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে।
আলতার জন্য সেদিন বিকেলের পরপরই ইয়াজু দোকান থেকে বাড়ি ফিরে আসে, নানান পদের মুখরোচক খাবার নিয়ে, আঙ্গুর-আপেল থেকে মোঘলাই পরোটা-চপ-পিঁয়াজি কেক, আলতাবানুর মন কেমন ভালো হয়ে যায়। সত্যিই মানুষটা একমাত্র শালিকার যতœ নিতে জানে, বাড়ির অন্য লোকেরা বিশেষ করে ইয়াজুদ্দির ভাবি-বোন-ভাইয়েরা দেখে আনন্দে গড়িয়ে পড়ে, অতিথি নারায়ণ, সেই অতিথিকে সেবা করা বড় পুণ্যের, মানুষটা যে আদর-আপ্যায়ন, আত্মীয়-স্বজনের যতœ-আত্তি করতে জানে তার প্রমাণ আলতার প্রতি অগাধ ভালোবাসা।
-দুলাভাই আপনি একি কাণ্ড করেছেন, বাজারের যে সমস্ত তুলে…
-তা আর পারলাম কোথায়, ইচ্ছে করে আমার একমাত্র শালিকার জন্য রতনপুর বাজারটাই তুলে নিয়ে—-
-থাক-থাক তাহলে গ্রামের লোকে আর সবাই খাবে কী?
-কেনো ওরা আর কতো খাবে, এখন আমার শালিকা খাবে সবাই দেখবে।
-যাহ, তাহলেই হয়েছে কেল্লাফাতে, আমার পেট যে চড়কগাছে উঠে যাবে, খেয়াল আছে।
– কেনো আমি আছি না, আমি নামিয়ে নিয়ে আসবো…
তারপর অনেকটা সময় দুজনের মধ্যে হাসি খুনসুটি চলে। দু’ দিনেই দুজনে খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, অনেক দূরে কোনো ঝোঁপঝাড়ে কী একটা পাখি ডেকে যায়, ডাকটা ভারী মিষ্টি, মনকে ভালো করে দেয়। একসময় আলতাবানু মৃদু স্বরে বলে ওঠে, বেশি কাছে আসাটা ঠিক নয়, অতো বেশি হাসাহাসিও ভালো নয়, তাছাড়া বড় আপাও কিন্তু মাইন্ড করতে পারে।
-মাইন্ড করার কী আছে, আমার শালিকাকে ভালো-ভালো…
– ওই হয়েছে তবে, জাহানারাবাগে আমার আর থাকা চলবে না—-
-কে-কে তাড়াবে তোমাকে, কার ঘাড়ে কতোটা মাথা আছে যে আমার কলজেতে হাত দেবে।
-বাব্বা শালিকার জন্য এতো দরদ যখন, এতোকাল ছিলেন কীভাবে…
ইয়াজুদ্দি অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। সত্যি তো এতোদিন কেনো এমন সরস জিনিসটার কথা মনেই ছিল না। আসলে তা নয়, সে ভাবতেই পারেনি রোজিনার ছোট বোন আলতা এতটা ডাগর এমনটা মনোহরি পদের একটা আপাদমস্তক জিনিস হয়ে উঠেছে, সেই কোনকালে দেখেছিল, এখন সে কথাও মনে নেই। আলতার কথায় কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। শেষমেশে কানের কাছে মুখ এনে বলেই বসে, কে জানতো আমার শালিকাটি একটা মাল হয়ে গেছে…
-সত্যিই আপনিও পারেন ওইসমস্ত স্কুলের মোড়ে দাঁড়ানো পোলাপানদের মতো…
-কেনো আমারও তো একদিন ওমন বয়স ছিল। ওরা জানবে আর আমি জানব না।
-বুঝেছি অনেক পাকা জিনিস আপনি।
-তুমি বুঝলে ঠিকই কিন্তু তোমার বোন তো কিছুই বুঝলো না আজো…
-খুব আফশোস তার জন্য বুঝি!
-তা আছে বৈ কি…
-ঠিক আছে আমাকে বলার থাকলে বলে ফেলেন।
-হ্যাঁ তা তো বলবোই, আর শালিকা মানে তো আধা-ঘরওয়ালী।
-ওরে বাব্বাহ, একেবারে ঘরের মালিকিন বানায়া দিলেন যে…
রোজিনা মাথায় ঘোমটা দিয়ে মুখ টিপে হেসে বলে, কে নিষেধ করে, আধা ঘরওয়ালী কেনো পুরোপুরি ঘরওয়ালী করে নিলেই তো হয়—-
সুযোগ পেয়ে ইয়াজু এক চোখ মেরে আলতাবানুকে শুধোয়, কি সখী এমন ঘর-বর কিন্তু পাবে না গো!
রাঙা পাপড়ি ঠোঁট বাঁকিয়ে আলতাবানু ওমনি উত্তর দেয়, বাব্বাহ সখ কতো, ঘর-বর দেখে কী হবে, মনের মিল না হলে পারানির কী থাকে?
-বাব্বাহ জানো তবে কথা বটে…
-কেনো কথা বুঝি আপনাদেরই ঘ’টে থাকে।
-না-না বাবা তা বলেনি, ঘাট মানছি, তুমিও পারো বটে রাধিকা!
কয়েকদিন পরে এক বিকেলে আলতাদীঘির ভাঙা বিধ্বস্ত দীঘির পাড়ে দুজনকে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দেখা যায়। আলতাবানুর সঙ্গে আলতাদীঘির যে গভীর সম্পর্ক, তা যেন পৃথিবীর অন্য কেউ-ই জানে না, শুধু জানে ইয়াজুদ্দি, কিন্তু সে আরো জানতে চায়, যে জানার কোনো পরিসমাপ্তি নেই, তারপরও মানুষ কতো কিছু জানার বাসনায় মত্ত হয়। নতুন বানের পানির মতো কলকল-ছলছল করে উঠলেও একটা সীমারেখা নির্মিত হয়, সেই সাজানো সীমার মধ্যে মুখ গুঁজে থাকতে হয়, থাকাটাই কর্তব্য। ইয়াজু তার একমাত্র শালিকাকে সাত তল্লাটে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায় বাইকে চড়িয়ে, বাইকের পেছনে বসে আলতাবানু নিজেকে রানি ভাবে, ভাবে উত্তম-সুচিত্রা, এই পথ যদি না শেষ হয়…গানটি গুনগুনিয়ে গেয়ে সে দিন কাটিয়ে দেয়। রোজিনার কোনো বারণ নেই।
ফাল্গুনের মিষ্টি সকালে ইয়াজু একদিন শুনতে পায় আলতাবানু মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে যেন গল্প করছে আর হাসাহাসি তো আছেই, অনেকটা সময় এভাবেই শোনে ওর কথা, নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, রোজিনাকে ঘটনা বলতেই সে যেন খেঁকিয়ে ওঠে, এমন বিপরীত ফল হবে বুঝতে পারেনি। মূল ঘটনা শুনতে পায়, রোজিনা একসময় বুঝিয়ে বলে তাকে, আলতাবানু প্রেম করে ওরই খালাতো ভাই সোহেলের সঙ্গে, যা পারিবারিকভাবে সবাই জানে। সোহেল ডিভিতে আমেরিকা গেছে, সেখানে সেটেল্ড হয়েছে, দু’তিন বছর পর দেশে ফিরলে আলতাবানুর সঙ্গে বিয়ে হবে এবং চিরস্থায়ীভাবে আলতাকে আমেরিকায় নিয়ে বসত গড়ে তুলবে তারা। কথাটা শুনে ইয়াজুর মাথা গরম হয়ে যায়, তার সে আগের রূপে পৌঁছে যায়, কড়াভাবে রোজিনার দিকে তাকিয়ে রুক্ষভাবে শাসন করে বলে ওঠে, তোমার বাপকে ডেকে পাঠাও, ভিন যাওয়াচ্ছি, কিসের আমেরিকা, ওখানে গেলে জাত-ধর্ম বলে কিছু কি থাকবে? থাকবে না।
রোজিনা কিছু যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে আবার জানায়, বিয়ে-শাদী খোদার দান, দেশে বিয়ে হওয়াটাই ভালো, দেশে কতো ভালো ছেলে আছে…
-কিন্তু আলতা তো পছন্দ করে…
-কিসের পছন্দ!
-না মানে পারিবারিকভাবে।
-রাখো তো ওসব, আমি ভেবেছি, আলতাকে বিয়ে করবো…
রোজিনার মাথায় যেন কেউ বাঁশ মেরে অজ্ঞান করে দেয়, কী বলে মানুষটা, মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি বয়সের তফাৎ বোধ, কি এভাবে লোপ পায়, মানুষ এভাবে এতটা নিচে নামতে পারে তা রোজিনা ভাবতেই পারে না। ভাবনাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে, আলতার কথা কীভাবে সে ভাবতে পারলো, রোজিনার সঙ্গেই তো তার বয়সের পার্থক্য কুড়ি/বাইশ, আর আলতা তো রোজিনার থেকেও প্রায় পনেরো বছরের ছোট, ইয়াজু কীভাবে এমন চিন্তা মাথায় আনতে পারে, ভেবে কুল পায় না। টাকার গরমে সাপের পা যেন দেখে ফেলেছে, মুহূর্তে রোজিনা স্তব্ধ হয়ে যায়।
ইয়াজু সেদিন মোকামে বসে মোতালেব মাওলানাকে ডেকে কথাটা বলতেই, তোবা-তোবা বলে ওঠেন তিনি।
-কী হয়েছে এতো তোবা-তোবা করার, বিয়ে করতে তো দোষ দেখছি না…
-দোষ না, কী বলছো মিয়া, দোষ-গুণ কী বোঝ, শরীয়তের বিধান আছে না।
-তা শরীয়তে বিয়ে করতে নিষেধ কোথায়…
-নিষেধ তো আছে, আলবত আছে, আপন মায়ের পেটের দু’বোন এক স্বামীর ঘর করতে পারবে না, এটাই শরীয়তের বিধান-কানুন!
-বিয়ে করা যাবে না বলছেন।
-হ্যাঁ বিয়ে হবে, যদি প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়ে…
ইয়াজু নিশ্চুপ হয়ে যায়। এরপর কী বলতে হয় সে জানে না। দূরে কোথায় একটা নাম না জানা পাখি ডেকে ওঠে। ইয়াজুর মন কেমন স্থির হয়ে যায় মুহূর্তে, ভাবনাগুলো ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের মতো এদিক-সেদিক ছুটে যায়, রোজিনাকে সে ভালোবাসে, তাই সে কোনোভাবেই রোজিনাকে ফেলতে যেমন পারবে না, তেমনি আলতাকে ভুলতে কি পারে? একটা দগদগে ঘায়ের মতো তামাম শরীরে ওর স্মৃতি হয়তো সারাটি জীবন বয়ে বেড়াতে হবে, এর মধ্যে একটা দ্বিধা এবং সংকোচ তাকে খাবলে খায় যেন। বাইকের গতি কমিয়ে ইয়াজু ভাবতে থাকে, ভাবনাটা একসময় থেমে যায়, রোজিনাকে বউ করে আনা কতো বছর হলো, অথচ রোজিনা তাকে এতটুকু অশ্রদ্ধা-অপমান করেনি, যেমন যেভাবে রেখেছে, সেভাবেই থেকেছে, তাকে কি কোনোভাবে পায়ে ঠেলা যায়! শারীরিক অক্ষমতার কথা জেনেও রোজিনা তো ছেড়ে যায়নি, তবে কেনো সে আজ তাকে দূরে সরিয়ে দেবে, আলেয়ার পেছনে ছুটে লাভ নেই, সে তো মরীচিকা, সত্য চিনতে ভুল হলে অপরাধ তো তারই। ভাঙা কুলো যে অসময়ে কতো কাজ দেয় তা তো গেরস্থই বোঝে ভালো, ইয়াজু একসময় বাইক থামিয়ে দাঁড়ায় সড়কের পাশের উন্মুক্ত মাঠের ধারে সেগুন গাছের নিচে, নরোম রোদে মানুষ উষ্ণতা নিয়ে যে যার মতো ঠিকানায় ফিরছে, তাকে আর বেশি সময় নষ্ট করলে চলবে না, দোকানে অনেক খদ্দের, দোকানের ছেলেরা সামলাতে পারবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়