জামায়াত আমিরের ছেলেসহ দুজন ফের রিমান্ডে

আগের সংবাদ

জামায়াত-জঙ্গি নতুন সমীকরণ : দলটির আমির ডা. শফিকের ছেলে ডা. রাফাতকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে নতুন তথ্য ও যোগসূত্র

পরের সংবাদ

শাকসবজি উৎপাদন বাড়ছে মিলছে ক্ষতিকর উপাদানও : জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি কীটনাশক > গবেষণার পাশাপাশি পদক্ষেপ নেয়াও জরুরি > জিএমও ফসল নিয়েও রয়েছে উদ্বেগ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : দেশে শাকসবজি উৎপাদনে বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে। এই খাতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। প্রায় ১শ ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে দেশে। সবজি উৎপাদনে শীর্ষস্থানে থাকলেও উৎপাদিত সবজিতে প্রায়ই মিলছে ভারী ধাতুসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের বিষয়টিও নতুন নয়।
জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার ২০টি এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা বেগুন ও মাটির নমুনা নিয়ে দুই বছর ধরে গবেষণা করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন বাকৃবির কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই গবেষণায় বেগুনে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে। এই ভারী ধাতুর মধ্যে রয়েছে- লেড বা সিসা, নিকেল ও ক্যাডমিয়াম। এসব ভারী ধাতু খাবারের সঙ্গে বছরের পর বছর নিয়মিত গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। এর কারণ খুঁজতে ফসলের মাটি পরীক্ষা করে সেখানেও ওই সব ভারী ধাতুর উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি থাকার প্রমাণ মিলেছে। ওই মাটিতে চাষ করা অন্যান্য ফসলেও এসব ভারী ধাতুর উপস্থিতি থাকতে পারে। মাটিতে এসব ভারী ধাতুর পরিমাণ কেন বাড়ছে- এ বিষয়ে গবেষণা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন ওই গবেষণার কাজে যুক্ত গবেষকরা।
এর আগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) করা গবেষণায়ও বেগুন, ফুলকপি, শিম ও বরবটি- এই ৪ সবজির নমুনায় ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছিল। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত সবজিতে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক তুলনামূলক বেশি মিলেছিল ওই গবেষণায়। এছাড়া আম, পেয়ারা ও পানে রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পেয়েছিলেন গবেষকরা। যেসব ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান মিলেছিল সেগুলো হলো- সাইপারমেথ্রিন, ক্লোরোপাইরিফস, ডাইমেথয়েট, অ্যাসিফেট ও কুইনালফস। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বারির কীটতত্ত্ব বিভাগের বালাইনাশক গবেষণা ও পরিবেশ বিষতত্ত্ব শাখার তৎকালীন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রধান।
তারও আগে ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির এক গবেষণায় ফুলকপি, বেগুন, লালশাক ও শিমে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছিল। এসব কীটনাশকের মধ্যে ছিল ম্যালাথিয়ন, ক্লোরোপাইরিফস, প্যারাথিয়ন মিথাইল, কুইনালফস, কীটনাশক ডাইমেথয়েট, মেটালাক্সিল।
শাকসবজি ও ফলমূলে এসব ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতির কারণ সম্পর্কে কৃষি গবেষকরা বলছেন, দেশে আগাম জাতের সবজি ও ফল বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এসব কৃষিপণ্য চাষের সময়ে পোকার আক্রমণও বেশি হয়। এর সহজ সমাধান হিসেবে কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশক বেশি ব্যবহার করেন। অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে শাকসবজি, ফলমূলে ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশক পাওয়া যাচ্ছে। রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নিয়ম রয়েছে। ফসলে কীটনাশক প্রয়োগের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, যাতে ফসল সংগ্রহ করলে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের মাত্রা ক্ষতির পর্যায়ের নিচে নেমে আসে। যেমন অর্গানোফসফরাস কীটনাশক ব্যবহারের ১০ থেকে ২০ দিন পর ফসল তুলতে হয়। সিনথেটিক পাইরিথ্রয়েডের ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হয় ৪ থেকে ৭ দিন। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা নিয়মগুলো অনুসরণ না করেই ফসল সংগ্রহ করেন। ফলে ক্ষতিকর উপাদানটি থেকে যায়।
বারির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নাজিমুদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে সবজির উৎপাদন

বেড়েছে। বেড়েছে উৎপাদনের পরিধিও। উৎপাদন বাড়ানোর নানা কৌশল আছে। বেশি উৎপাদন করতে গিয়ে সেখানে যদি অতিমাত্রায় কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় তাহলে তা অবশ্যই ক্ষতিকর। প্রযুক্তি অবশ্যই ভালো। কিন্তু প্রযুক্তি যিনি ব্যবহার করছেন তিনি অপব্যবহার করছেন। কৃষক সঠিকমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করছে কি না তা মনিটরিং করা জরুরি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা আছে। কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তার মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে। আর তাই কৃষক কোনো সমস্যায় পড়লে তা সমাধানের জন্য কৃষিকর্মকর্তার কাছে যাচ্ছেন না। তারা স্থানীয় দোকানদার বা ডিলারের কাছে যান। আর দোকনদার যে কোম্পানির পণ্য বিক্রি করতে পারলে লাভবান বেশি হবেন কৃষককে সেই পণ্যটি কেনারই পরামর্শ দেন। দোকানদার বা ডিলার যেহেতু বাজারেই থাকেন; তাই তাদের কাছে কৃষক যে কোনো সময়ই যেতে পারছেন। তাদের সহযোগিতা নিতে পারছেন। ফলে কৃষি কর্মকর্তার কাছে তারা যেতে চান না।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা গবেষকের গবেষণার বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়ে ড. নাজিমুদ্দিন বলেন, গবেষণাগুলো চলমান থাকতে হবে। ধারাবাহিকভাবে যদি এসব তথ্যগুলো তুলে না ধরা হয় তাহলে মানসম্মত উৎপাদনে যেতে পারব না। এসব গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান বানানো উচিত। ২০১৮ সালে আমাদের দেশে যে কৃষি নীতি হয়েছে তার প্রথম শর্ত হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্য স্বাস্থ্যসম্মত বাণিজ্যিক কৃষি। এর মানে খাদ্য যে নিরাপদ নেই সেটি সরকারও স্বীকার করেছে। তাই এক্ষেত্রে জোর দেয়া হয়েছে। বারবার অতিমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশ, জলবায়ু নষ্ট হচ্ছে। মাটির গঠনও নষ্ট করে দিচ্ছে।
অতিমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিনা- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২০১২ সালে বায়োটেকনিক্যাল রুলস হলো। সেখানে বলা হলো, জেনেটিক্যালি মোডিফাইড (জিএমও) ফসল বিক্রি করা হলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও ৫ বছরের জেল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কাউকে এই শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে নজির নেই। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে যে আইনগুলো রয়েছে সেগুলোর প্রয়োগ নেই। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সক্ষমতাও তেমনভাবে গড়ে উঠেনি।
মানবদেহে এসব ক্ষতিকর উপাদানের প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব রাসায়নিক ক্যান্সার, চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা এসব রাসায়নিকযুক্ত খাবার নিয়মিত খেলে স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হতে পারেন। শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভের সন্তানের নানা ধরনের সমস্যাও হতে পারে। শুধু তাই নয় মৃত্যুর ঘটনাও আছে। ২০০৯ সালে ধামরাইয়ে ৩ জন এবং ২০১৩ সালে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে রহস্যজনক কারণে ১৪ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, এসব মৃত্যুর কারণ ছিল খাদ্যে ব্যবহৃত কীটনাশক।
জানা যায়, কীটনাশকের বিষের মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ব্যবসায়ীদের তা আমদানির অনুমতি দেয়া না সরকার। তবে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কৃষক ওই কীটনাশক কিনছেন। ফলে পরিমাণের দিক থেকে কীটনাশকের আমদানি কমলেও তাতে বিষের পরিমাণ কত, তার কোনো পরীক্ষা হচ্ছে না।
এ মুহূর্তে কীটনাশক একটা বড় হুমকি বলে মনে করছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, যেসব কীটনাশকের উপস্থিতি মিলছে সেগুলো যদি দীর্ঘদিন ধরে যদি পেটে যায় তাহলে শ্বাসকষ্ট, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া, চুলকানি, বমি, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, হাঁপানি থেকে শুরু করে হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুস, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুরা বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে জটিল রোগে ভুগছেন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।
এদিকে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড (জিএমও) ফসল নিয়েও রয়েছে উদ্বেগ। এ প্রসেঙ্গ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, জিএমও খাদ্য সাধারণত জীবে বিদ্যমান জেনেটিক মেটারিয়াল (ডিএনএ) বিভিন্ন পদ্ধতিতে রূপান্তরের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়। ওই পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাদ্য জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনির্য়াড, ট্রানজেনিক ও বায়োটেক পণ্য নামেও পরিচিত। এর মূল উদ্দেশ্য পৃথিবীতে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে; সেই হারে খাদ্য উৎপাদনও বাড়াতে হবে। পরিসংখ্যানগত দিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্বে জিএমও খাদ্য উৎপাদনের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় জিএমও খাদ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। বর্তমানে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, জিএমও ফসল খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পুষ্টি চাহিদা পূরণেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তবে জিএমও খাদ্য জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনির্য়াড হওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। জিএমও খাদ্য গ্রহণে মানবদেহে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, জিএমও খাদ্য গ্রহণে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা কমে যায়। বিশ্বের অনেক দেশে অনেক মানুষ নৈতিকতার কারণে ধার্মিক ও কালচারাল দিক বিবেচনায় জিএমও খাদ্য খাওয়া থেকে নিজেদের দূরে রাখছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়