জামায়াত আমিরের ছেলেসহ দুজন ফের রিমান্ডে

আগের সংবাদ

জামায়াত-জঙ্গি নতুন সমীকরণ : দলটির আমির ডা. শফিকের ছেলে ডা. রাফাতকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে নতুন তথ্য ও যোগসূত্র

পরের সংবাদ

গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন : তদন্ত রিপোর্ট পেশ > সাঘাটা-ফুলছড়ির ইউএনও পুলিশ ও ভোটকর্মীরা দায়ী

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে অনিয়ম বন্ধে সাঘাটা ও ফুলছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শতাধিক কর্মী, শতাধিক ভোটকর্মী, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীকে দায়ী করে রিপোর্ট পেশ করেছে ইসির তদন্ত কমিটি। এতে সাঘাটার ইউএনও সরদার মোস্তফা শাহীন ও ফুলছড়ির ইউএনওর দায়িত্বে থাকা কামরুল ইসলাম এ উপনির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন, তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জোর করে ‘ভোটে কোনো অনিয়ম হয়নি’ এমন লিখিত দিতে বাধ্য করেছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। যদিও রিটার্নিং কর্মকর্তা গাইবান্ধার ডিসি এবং আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা এসপিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত কমিটি। তাদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ এসেছে রিপোর্টে। গত সোমবার গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে মোট ১৪৫টি কেন্দ্রের তদন্ত করে রিপোর্ট পেশ করেন ইসির যুগ্ম সচিব আশোক কুমার দেবনাথের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি।
প্রথমে ৫১টি কেন্দ্রের তদন্ত করার নির্দেশ দেয় কমিশন, সেই অনুযায়ী গত মাসে তদন্ত কমিটি ৩ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের ৮৭৭ পাতার রিপোর্ট ও সুপারিশ পেশ করে। পরে এ রিপোর্ট আংশিক মনে করে সিইসি পুরো গাইবান্ধা-৫ সংসদীয় আসনের সব কেন্দ্রের তদন্তের নির্দেশনা দেন। গত ৭ নভেম্বর বাকি ৯৪টি কেন্দ্রের তদন্ত শুরু করে ইসির একই তদন্ত কমিটি। তবে আগে গাইবান্ধা-৫ এ গিয়ে সরজমিন তদন্ত না করে তদন্ত কমিটিকে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখে তদন্ত করার নির্দেশ দেয় ইসি। গত সোমবার ৯৪টি কেন্দ্রের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন বলে জানান তদন্ত কমিটির প্রধান অশোক কুমার দেবনাথ।
গতকাল মঙ্গলবার তিনি ভোরের কাগজকে জানান, আমরা প্রথমে ৫১টি কেন্দ্রের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিই, গতকাল বাকি ৯৪টি কেন্দ্রের

১৭ পাতার মূল রিপোর্ট ও একটি সিডি জমা দিয়েছি। তদন্ত রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা (ডিসি), গাইবান্ধার এসপি, সাঘাটা ও ফুলছড়ির ইউএনও, ৪০ জন প্রিসাইডিং অফিসার ও ২৭৮ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারসহ মোট সাড়ে ৬শ জনের বক্তব্য রয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই বলেছেন, কোনো একটি দলের নেতাকর্মী জোর করে ভোট দেয়ার চেষ্টা করেন। আবার ভোট কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য অনেকেই তাদের ওপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, তদন্ত কমিটি নির্বাচন কর্মকর্তাদের ওপর চাপ দেয়নি। বরং তারা চাপমুক্ত হয়ে প্রকৃত চিত্র ও নির্বাচনের দিন কী ঘটেছিল সেটাই জানিয়েছেন। তবে কত জনের শাস্তি হবে বা কী ধরনের অপরাধ করেছেন তা তিনি জানাতে চাননি। এ বিষয়ে ইসিই সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, বন্ধ ঘোষিত ভোটকেন্দ্রে সংঘটিত অনিয়মগুলো চিহ্নিত করতে সরেজমিন গাইবান্ধার সাঘাটা ও ফুলছড়িতে যান কমিটির ৩ সদস্য। দুই উপজেলার ১৪৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে সাঘাটায় ৮৮টি এবং ফুলছড়িতে ৫৭টি কেন্দ্র ছিল। কমিটির পক্ষ থেকে তদন্তের সময় ৭ শতাধিক ব্যক্তিকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়। তদন্ত কমিটি বিভিন্ন অনিয়মের ভিডিও ফুটেজ দেখে এদের সাক্ষ্য নেন।
তবে অধিকাংশ কেন্দ্রের পিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন ও এজেন্টরা গোপন কক্ষে ঢুকে ভোটারদের হাতের ছাপ নিয়ে নিজেরা ভোট দিচ্ছিলেন, তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহযোগিতা চেয়েও পাননি। এ সময় নীরব ভূমিকা পালন করেছে পুলিশ। ম্যাজিস্ট্রেটরাও বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি বলে অভিযোগ নির্বাচন কর্মকর্তাদের। প্রিসাইডিং অফিসাররা বলেন, সেদিন ভোটগ্রহণ স্থগিত হওয়ার পর কেন্দ্রে কেন্দ্রে সরকারদলীয় নেতাকর্মী আসেন। পরে জোর করে ভোটের পরিবেশ ভালো ছিল, এমন স্টেটমেন্ট সাদা কাগজে লিখে নেন। তারা তা দিতে না চাইলে হুমকি-ধমকি দেয়া হয়। প্রায় ৮৮ জন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে গত ১২ অক্টোবর ভোটের দিন বহিরাগত যুবকদের কাছে ‘সুষ্ঠু ভোট হয়েছে’ লিখে দিতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এভাবে তদন্ত কমিটির কাছে নির্বাচনের নানা অনিয়ম ও ভোট ডাকাতির বিষয়ে চিত্র তুলে ধরেন সংশ্লিষ্টরা।
তদন্তে অভিযোগ এসেছে, সহকারী রিটার্নিং অফিসার সাঘাটার ইউএনও সরদার মোস্তফা শাহীন ও ফুলছড়ি উপজেলার ইউএনওর দায়িত্বে থাকা এসিল্যান্ড কামরুল ইসলাম ৮৮টি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারদের একপ্রকার লিখিত বক্তব্য দিতে নির্দেশ বা বাধ্য করেছেন। সাঘাটার জুমারবাড়ি আদর্শ ডিগ্রি কলেজের প্রিসাইডিং অফিসার একে এম জুলফিকার হায়দার, সাঘাটার বারকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার বিষ্ণু পদ সিংহ, সমরপাড়া দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মশিউর রহমান, সন্ন্যাসদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং অফিসার মাজেদুল ইসলাম, সাঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. সামসুজ্জোহা, একই ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামসহ অধিকাংশ কর্মকর্তা তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, ভোটের দিন শুরুটা ভালো হলেও বেলা ১২টার দিকে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জোর করে বুথে ঢুকে নিজেরাই ভোট দিতে থাকেন। এবং তাদের কাছ থেকে জোর করে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা তারা পাননি। পরে ইউএনওর নির্দেশমতো তারা ‘ ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে’ এ কথা লিখতে বাধ্য হন।
এদিকে তদন্ত কমিটির কাছে বাতিল হওয়া ওই ভোটকে সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে দাবি করেছেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার। জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারের সার্বিক কার্যক্রম কমিটির কাছে সন্তোষজনক বলে প্রতীয়মান হয়নি। সেটিও প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে তদন্ত কমিটি। তাদের বিরুদ্ধেও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ ওঠেছে।
অভিযোগের জবাবে সাঘাটার ইউএনও সরদার মোস্তফা শাহীন তদন্ত কমিটিকে বলেন, আমি এ ধরনের কোনো লিখিত দেয়ার নির্দেশনা দিইনি। যদিও প্রায় সব প্রিসাইডিং অফিসার প্রত্যেকটা চিঠিতে সহকারী রিটার্নিং অফিসার সাঘাটার ইউএনও এবং ফুলছড়ির ইউএনও (চলতি দায়িত্বে) মো. কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় ভোটবন্ধের কথা উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে কামরুল ইসলাম বলেন, প্রিসাইডিং অফিসাররা লিখিতভাবে আমাদের কোনো চিঠি দেননি। তবে স্থগিত কেন্দ্রের ব্যাপারে প্রিসাইডিং অফিসাররা যে চিঠি দিয়েছেন সেখানে ভোটের পরিবেশ না থাকায় নির্বাচন বন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও রিটার্নিং কর্মকর্তার (ডিসি) নির্দেশমতো তারা কাজ করেছেন বলেও জানান এ দুই ইউএনও।
এদিকে তদন্তে দোষী প্রমাণ হলে নির্বাচনী কর্মকর্তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হবে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, যারা কথা শোনেননি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পুরো এখতিয়ার ইসির রয়েছে। এক্ষেত্রে অপরাধের ধরন অনুযায়ী চাকরিচ্যুতিও হতে পারে। ইসি দুই মাস পর্যন্ত বরখাস্ত করতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যে শাস্তির সুপারিশ করব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করে আমাদের জানাবে। আর বাস্তবায়ন না করলে সেই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারি। কার কেমন অপরাধ সেটা তদন্ত প্রতিবেদন দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, আগে ৫১টি কেন্দ্রের সরজমিন তদন্ত রিপোর্ট ইসিতে জমা দেয় তদন্ত কমিটি। পরে বাকি ৯৪টি কেন্দ্রের রিপোর্ট গতকাল সোমবার জমা দিয়েছেন তারা। তবে এখনো আমরা রিপোর্ট পড়ে দেখিনি। রিপোর্ট পর্যালোচনা করে কারা কারা দোষী তা আমরা নির্ধারণ করে শান্তির ব্যবস্থা করব।
গত ১২ অক্টোবর উপনির্বাচনে সব কেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে ঢাকার নির্বাচন ভবনে বসে পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশন। এ সময় নানা ধরনের অনিয়মের কারণে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন বন্ধ করে ইসি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়