সরকার ৬৭ লাখ তরুণ-তরুণীকে আয়বর্ধক পেশায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে

আগের সংবাদ

১০ ডিসেম্বর কী হবে ঢাকায়? বিএনপির সমাবেশ ঘিরে উত্তাপ বাড়িয়েছে আমানের আল্টিমেটাম > রাজপথে মোকাবিলা করবে আ.লীগ

পরের সংবাদ

চনপাড়া বস্তিতে বজলুর টর্চার সেল ‘সেতুবন্ধন’! : থানায় দুই হাজার অপরাধের মামলা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : রাজধানীর উপকণ্ঠ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানাধীন চনপাড়া বস্তি সব ধরনের অপরাধীদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিতি পেলেও সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বরাবরই রহস্যঘেরা। খুন, অপহরণ, ভাড়াটে খুনি, মাদক, চাঁদাবাজি, পতিতাবৃত্তি, চোরাচালান, ছিনতাই, ডাকাতি, সুদের ব্যবসা, চুরিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা সেখানে সংঘটিত হয় না। ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, মদ, গাঁজাসহ সব ধরনের মাদক বিকিকিনি এখানে ওপেন সিক্রেট। মিছিল-সমাবেশে লোক ভাড়া থেকে শুরু করে রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আত্মগোপনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল চনপাড়া বস্তি। পাঁচ দশক আগে ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে এই বস্তি গড়ে তোলা হলেও এখন সেখানে বহুতল ভবনের ছড়াছড়ি। গত কয়েক বছরে ঘিঞ্জি এই এলাকাটি অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার ও ইউপি শাখা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রহমান সব অপকর্মের হোতা হিসেবে পরিচিত হলেও পুলিশের সঙ্গে তার বেজায় সখ্য। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ২০ বছরে চনপাড়া বস্তিতে খুন হয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় ১৫ জন। গত দেড় যুগে শুধু চনপাড়া এলাকার মাদক ব্যবসাসংক্রান্ত ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ২ হাজারের ওপরে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর র‌্যাবের সঙ্গে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার দুপুরে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন রাশেদুল ইসলাম ওরফে সিটি শাহীন নামে একজন। মাদক কারবারিদের অন্যতম হোতা শাহীন ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও চনপাড়া মাদক নির্মূল কমিটির সদস্য ছিলেন।
চনপাড়ার অপরাধ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল জানান, চনপাড়ায় লক্ষাধিক লোকের বসবাস। সেখানে মাদকবিরোধী অভিযান চলমান। পুলিশ-র‌্যাব ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা সেখানে অভিযান চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঘটনা ঘটলে সেখানে প্রশাসনের টনক নড়ে। এমনিতে সেখানে সবকিছু চলে ফ্রি স্টাইলে। আলোচিত এই বস্তির ভেতরে একটি চারতলা ভবন সবার কাছে আতঙ্কের স্থান হিসেবে পরিচিত। এই ভবনের চারতলায় বজলুর রহমান নিয়মিত সালিশ করেন। আর তৃতীয় তলায় রয়েছে তার টর্চার সেল। অন্ধকারাচ্ছন্ন তৃতীয় তলার নাম দেয়া হয়েছে ‘সেতুবন্ধন’। বিচারের নামে সেখানে লোকজন ধরে এনে পাশবিক কায়দায় নির্যাতন করে টাকা আদায় করা হয়। মাদক বিক্রির টাকা ভাগবাঁটোয়ারা চলে। রাতে বসে জুয়ার আসর। রাজধানীর মাত্র ৪ কিলোমিটারের মধ্যে রূপগঞ্জের এ চনপাড়া বস্তির অবস্থান হওয়ায় রাজধানী ঢাকার অপরাধ জগতের অনেকেই এ বস্তিকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে। ঘিঞ্জি বস্তির কারণে অপরাধীরা অপরাধ করে এখানে দিনের পর দিন নির্বিঘেœ পালিয়ে থাকতে পারে বলে এ বস্তিটা তাদের পছন্দের। চার দশক আগে ভাসমান লোকদের এখানে পুনর্বাসন শুরু হলে ১৪/১৫ হাত করে প্লট করা হয়। পরে ১২/১৩ হাত সাইজের প্লট করা হয়। শুরুতে ৪-৫ হাজার টাকায় প্লট বিক্রি হলেও এখন তা ৮-১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। ৪০-৫০ হাজার প্লটে ৪০-৪৫ হাজার ঘরের বাসিন্দা লক্ষাধিক। এখানকার ভোটার প্রায় ২২ হাজার। বজলু ও তার ঘনিষ্ঠ স্বজনদের মিলিয়ে ৫৫টি প্লট রয়েছে এখানে। অপকর্মের সর্বেসর্বা বজলুর পাঁচভাই দেলু, মিজু, হাছেন, হোসেন, কাশেম, বজলুর দুই মেয়ে, দুই শ্যালক জাহাঙ্গীর ও জাকির সবকিছু তদারকি করেন। জাকির মলম পার্টির নেতা, জাহাঙ্গীর হেরোইন ও ইয়াবার ডিলার। আরেক শ্যালক রিপনের ছত্রচ্ছায়ায় এই বস্তি

অটোরিকশা ছিনতাইচক্রের আশ্রয়স্থল। বস্তির ভেতরে রয়েছে অনেকগুলো বহুতল ভবন। ডেমরা, স্টাফ কোয়ার্টার রোডের ছিনতাইকারীরা এখানে থাকে নিরাপদে।
বস্তির একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, বজলু বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। সেই হিসেবে পুলিশ ও প্রশাসন তার সঙ্গে ভাব রেখে চলে। প্রতিটি সভা-সমাবেশে বজলু বাস ও নৌকাযোগে ১০-১২ হাজার লোক দিয়ে থাকেন। তবে, বস্তির কোনো কিছুতেই বজলু সামনে থাকেন না। সবকিছু তার ভাই, মেয়ে ও শ্যালকরা মিলেমিশে করেন। তাদের অপকীর্তি সামাল দেন বজলু। সামান্য একজন ইউপি সদস্য হলেও তার আছে তিনজন গানম্যান, পিএস, এপিএস। চলাচল করেন বিশেষ প্রটোকল নিয়ে। গুঞ্জন আছে- বজলু মানুষ খুনের কন্ট্রাক্টও করেন বস্তিতে বসে। রূপগঞ্জ পুলিশের তিনজন সদস্য জানিয়েছেন, বজলু কাউকে পাত্তা দেন না। অজানা আতঙ্কে সবাই তাকে সমীহ করে চলে। একজন মেম্বারের কত ক্ষমতা হতে পারে তা বজলুকে কাছ থেকে না দেখলে বোঝা দুষ্কর। পুলিশ ও প্রশাসনের সবাই তার দাপটের কাছে অসহায়।
অভিযোগ প্রসঙ্গে বজলুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেছেন, সেতুবন্ধন বাড়ির মালিক তার বাবা। সেখানে কোনো টর্চার সেল নেই। নির্যাতিত কোনো ভুক্তভোগী নেই দাবি করে তিনি বলেন, সব জায়গাতেই ঘটনা ঘটে। ঘটনা ঘটলে মামলা হবেই। মামলা হলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, মন্ত্রীর নজরদারির কারণে বস্তির মধ্যে রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট হয়েছে। সিকিউরিটি কোম্পানির মাধ্যমে তিনি দুইজন গানম্যান নিয়েছেন দাবি করে বজলু বলেন, ‘আমি মেম্বার, আমার কোনো অস্ত্রের লাইসেন্স নেই। গানম্যানদের নিজস্ব দুটি অস্ত্র রয়েছে’।
সূত্র মতে, নানাবিধ অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের অন্যতম জয়নাল, শমসের, স্বপন, শাওন, নাজমা, বজলুর ভাই বোতল মিজু, সাদ্দাম হোসেন স্বপন, শাহীন মিয়া ওরফে সিটি শাহীন, রাজু আহমেদ রাজা, রায়হান, ইউসুফ, সায়েম, নাজমা, রিপন, শাওন, রেহান মিয়া, জাকির হোসেন, আনোয়ার হোসেন, শাহীন, হাসান, মিজু, রাজা, রুমা ও শ্যালক জাকিরসহ অন্যরা চনপাড়াকে অপরাধের স্বর্গরাজ্য বানিয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে ১ নং ওয়ার্ডের হোমা, মনির, বিলকিস, চিকা মনিরের ভাই পিচ্চি আনোয়ার, আসলাম, নুর হোসেন, স্বপনের সেলসম্যান রাসেল, আয়নাল, জনি ও হাসি। ২ নং ওয়ার্ডে জুয়েল, মোহাম্মদ আলী, কয়লারানী, ফারুক, শামীম ও শিল্পী। ৩ নং ওয়ার্ডের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে সাহাবুদ্দিন ওরফে সাবু, কালাম, আবুল, বাবুল, আরিফ ও শহিদুল। ৪ নং ওয়ার্ডের মুজাহিদ, নুর জামাল, জনি, কদবানু ও শামসুন্নাহার করছেন ইয়াবা ও হেরোইনের ব্যবসা। ৫ নং ওয়ার্ডের মিল্লাত, ৬ নং ওয়ার্ডের মাদকের প্রধান ডিলার বজলু মেম্বারের ছোট ভাই মীজান ওরফে বোতল মিজু, সেলিম, কামাল সামলাচ্ছেন মাদক ব্যবসা। ৭ নং ওয়ার্ডের আলম, চানপুইরা লিটন, ৮ নং ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর, রাজিব, মোকলেছ এবং ৯ নং ওয়ার্ডের শাহ আলম, রোশনী, ল্যাংড়া শাহিন, শামীম, অপু ও মাইগ্যা রাজু বর্তমানে সক্রিয়ভাবে মাদক ব্যবসা করছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া মাদক সম্রাট রাজু ওরফে রাজা চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকার মাদক নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বলে জানা গেছে।
২০ বছরে যত খুন : ২০০৩ সাল থেকে চনপাড়া এলাকায় মাদক ব্যবসার আধিপত্য আর এতে বাধা দেয়ার কারণে এক ডজনের বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৩ সালে এখানে খুন হন ফিরোজ সরকার, ২০০৪ সালে ফারুক মিয়া। ২০০৫ সালে খুন হন পুলিশের এএসআই হানিফ মিয়া ও ক্রিকেটার ফালান মিয়া। ২০০৮ সালে খুন হন আব্দুর রহমান, ২০১১ সালে হত্যার শিকার হয় র‌্যাবের সোর্স খোরশেদ মিয়া। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ প্রজন্ম লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে হত্যার শিকার হয় আসলাম হোসেন নামে এক স্কুলছাত্র, ওই বছরের ২৯ নভেম্বর থানা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক হাসান মুহুরিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চানমিয়া, আনোয়ার, সামসু হত্যা এবং ২০১৯ সালের জুন মাসে নিহত হাসান মুহুরির স্ত্রী ও সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য বিউটি আক্তার কুট্টিকেও হত্যা করা হয়। চলতি বছরের ১৭ জুন ২ গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারে টানা ২ দিনের সংঘর্ষে খুন হন সজল মিয়া নামের এক যুবক ও গুলিবিদ্ধ হন ১০ জন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়