স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : আতঙ্কিত হওয়ার মতো অবস্থায় নেই বাংলাদেশ

আগের সংবাদ

সরকারি ওষুধ সিন্ডিকেটের পেটে : রোগীর ভাগ্যে জোটে যৎসামান্য, বিনামূল্যে মিলে কোন ওষুধ জানেন না রোগী, তিন স্তরে পাচার হয়

পরের সংবাদ

আইএমএফের শর্ত মেনে সংস্কারে ফিরবে শৃঙ্খলা : অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত

প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : আইএমএফের শর্ত বা সংস্কার প্রস্তাব পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হলে দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও গতি ফিরবে- এমনটাই মনে করেন শীর্ষ অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে আর্থিক খাত বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলছিল। এই খাতে সংস্কারের জন্য আইএমএফ যে শর্তগুলো দিয়েছে, তা আগেই বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। এখন ঋণ পাওয়ার জন্য হলেও কাক্সিক্ষত সংস্কারের পথে যেতে হবে।
বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য। সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য সংস্থাটির প্রতিনিধিদল ১৫ দিন ধরে ঢাকায় বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা শেষ করে ফিরে গেছে। এর মধ্যে গত ৮ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমাপনী বৈঠক ও ৯ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিনিধিদলটি। এর আগে ২৭, ৩০ ও ৩১ অক্টোবর এবং ২ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে তারা। আলোচনার ফলশ্রæতিতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পেতে সমঝোতায় পৌঁছে বাংলাদেশ; যা অর্থনীতির চলমান চাপ সামলাতে সহায়তার পাশাপাশি বিদেশি অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে নিকট ভবিষ্যতে আরো অর্থায়ন পাওয়ার সুযোগও তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র জানায়, পাঁচ দফা বৈঠকে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কারে জোর দেয় আইএমএফ। মূলত ১৭টি শর্তকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে তারা। এ সময় তাৎক্ষণিক তিনটি শর্ত মানতে রাজি হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু শর্ত পর্যায়ক্রমে মানার কথাও জানানো হয়। তবে কয়েকটি শর্ত মানার বিষয়ে কোনো ধরনের আশ্বাস দেয়া হয়নি। আর বৈঠকগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট কনসালটেন্ট ড. জাহিদ হোসেনের মতে, আইএমএফের সঙ্গে এ ধরনের ঋণচুক্তি বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঋণ প্যাকেজ থাকলে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে মাথা খাটাবে না।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, যে কোনো দেশে আইএমএফের ঋণকে মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে আইএমএফের ঋণ খুব দরকার ছিল। এ ঋণ একটি আস্থার সৃষ্টি করবে। এখন বিশ্বব্যাংক যে দেড় বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চাচ্ছে, তা দ্রুত ছাড় করবে। এডিবি, জাইকা এগিয়ে আসবে। তখন সবাই তাদের সাপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসবে।
সরকারের সঙ্গে ঢাকায় দীর্ঘ আলোচনায় আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতা সংস্থাটির এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দও মনে করছেন, বাংলাদেশ এ ঋণ পেলে তা বিদেশ থেকে আরো অর্থায়ন পাওয়া সহজ করবে। সফরের শেষদিন বুধবার সংবাদ সম্মেলনে রাহুল আনন্দ বলেন, আমরা মনে করি, যেসব সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল হবে এবং রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক অবস্থানে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ঋণ দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। নতুন ঋণ পাওয়ার রাস্তা খুলে যাবে। তিনি বলেন,

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে ছিল। তাছাড়া এই ঋণের সঙ্গে কিছু সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এসব সংস্কার বাংলাদেশের জন্য দরকার ছিল। সেগুলো এখন হবে। সেটা ভালো একটি দিক। তবে আইএমএফের সব শর্ত বাংলাদেশের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। দেখতে হবে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা। সেটার ভিত্তিতে আমরা তাদের শর্ত পালন করব। এই ঋণটি ২৬ সাল পর্যন্ত আসবে, সুতরাং সময় পাওয়া যাবে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক কর্তৃত্ব স্থাপন করতে হবে, অর্থ পাচারকারীদের নাম ও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে, বেসরকারি কোনো ব্যাংকে এক পরিবারের দুইজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না, টানা ছয় বছরের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না কেউ, বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকবে আইএমএফের পর্যবেক্ষক, সুদের হারের সীমা তুলে দিতে হবে, রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণ দেখাতে হবে, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে- এমনই একগাদা শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণ পেতে হলে পর্যায়ক্রমে এসব শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের স্বস্তি নিয়ে আসবে। যদিও অর্থের অঙ্কে এ ঋণ তেমন বড় কিছু নয়। তবে এ ঋণ বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া আইএমএফের ঋণ দেয়ার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবরের একধরনের বার্তা আছে। এটি বহুপক্ষীয় অন্য সংস্থাগুলোকে আশ্বস্ত করবে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের বাজেট সহায়তা দিতে উৎসাহিত হবে। বাজেট সহায়তাও কিন্তু রিজার্ভে যোগ হয়, সেদিক থেকে এর গুরুত্ব আছে।
ঋণের সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, জ্বালানি খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ- এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আমরা সংস্কার করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে পারলে আমাদেরই লাভ। এসব করা গেলে আমাদের খেলাপি ঋণ কমবে বা রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত বাড়বে। আমি মনে করি, আইএমএফের সঙ্গে আমাদের ঋণ আলোচনায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলো আমাদের নিজেদেরই করা উচিত। সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য এটি জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, রিজার্ভের দুটি বিষয়ে আপত্তি তোলে আইএমএফ। প্রথমত, রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতিতে সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটি মানতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদে অনুমোদন নিলেই হবে। এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, বর্তমানে নেট রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এর পরিমাণ দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার। তবে এখনই একবারে রিজার্ভ সমন্বয় করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে তা সমন্বয়ের কথা জানানো হয়।
রিজার্ভ সংরক্ষণ পদ্ধতিতে আরো একটি আপত্তি তোলে আইএমএফ। রিজার্ভের যে মুনাফা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখায় তার একটি অংশ আন-রিয়েলাইজড গেইন, সেটি বাদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আর্থিক বিবরণী মান (আইএফআরএস) অনুসরণ করা হয়নি। এ পদ্ধতি সংস্কারের শর্ত দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে বিপিএম৬ অনুসরণের কথা জানানো হয়। আইএমএফ প্রণীত এ নীতিমালা অনুযায়ী এভেইলেবল রিজার্ভকে পৃথকভাবে দেখাতে বলা হয়। সাধারণত স্বর্ণ বা বন্ডে বিনিয়োগকেও রিজার্ভের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। তবে যে কোনো তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে এ রিজার্ভকে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাই এভেইলেবল রিজার্ভে স্বর্ণ ও বন্ডে বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে নগদ রিজার্ভকে দেখাতে হবে।
জানা গেছে, গত দুই মাস ধরে অলিখিতভাবে এলসি খোলা বন্ধ রাখা নিয়েও আপত্তি তুলেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। দ্রুত তা খুলে দেয়ার শর্ত দেয়া হয়। এছাড়া মুদ্রানীতির মূল্যায়ন তিন মাস পর পর করার শর্ত দেয়া হয়, যা ৭-৮ বছর আগে অনুসরণ করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার কথাও বলা হয়েছে। যদিও তিন বছর ধরে বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। আইএমএফের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকের জন্য এক নিয়ম আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য আরেক নিয়ম, তা মানা হবে না। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ডিজিএমের ওপরের পদগুলোয় পদোন্নতি সরকার নিয়ন্ত্রণ করে, যা বাতিল করতে হবে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে।
সূত্র জানায়, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে পারেনি। এ শর্তে রাজি না হলে আইএমএফ পরবর্তীতে বিকল্প কোনো শর্ত দিতে পারে বলে বৈঠকে জানানো হয়। এদিকে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের হিসাবেও ত্রæটি রয়েছে বাংলাদেশের, যা নিয়ে আপত্তি তোলে আইএমএফ। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুধু পণ্যমূল্যকে বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এক্ষেত্রে জাহাজ ভাড়া, ফ্রেড ফরোয়ার্ড চার্জ, বিমা চার্জ প্রভৃতিও ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এগুলোও আমদানির ব্যয়ের অংশ। কিন্তু এসব চার্জ বাদ দেয়ায় আমদানি কম দেখানো হয়। এতে গত কয়েক বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় কম দেখানো হয়েছে। এ মূল্যকে আমদানির ব্যয়ের সঙ্গে যোগ করে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) সঠিক হিসাব দেখাতে বলা হয়েছে।
আইএমএফ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে আরো যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় তার মধ্যে রয়েছে- ঋণের সুদের হারের সীমা তুলে দেয়া, অভিন্ন এক্সচেঞ্জ রেট, খেলাপি ঋণ কমানো, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি কমিয়ে আনা, ব্যাংক পর্ষদ গঠনের আইনের সংস্কার, ব্যাংকের আইটি খাতের সংস্কার, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা, খাতভিত্তিক আর্থিক ইন্ডিকেটরস, বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া, ১০টি দুর্বল ব্যাংকের জন্য নেয়া উদ্যোগ, ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর সাপোর্ট প্রজেক্ট (এফএসএসপি) বাস্তবায়ন, ব্যাংক সুপারভিশন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন (সংশোধন) আইনসহ ৫টি অন্যতম আইনের সংস্কার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়