পুণ্যস্নানে শেষ হবে সুন্দরবনের রাসমেলা

আগের সংবাদ

মিলছে আইএমএফের ঋণ > বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো : রাহুল আনন্দ

পরের সংবাদ

প্রাযুক্তিক ছুরি ও একটি জাতির আত্মহত্যা

প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৯, ২০২২ , ৪:৩০ অপরাহ্ণ

বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় “অ্যাপেল” কোম্পানির “আধখাওয়া আপেল”-এর কথা বলছি না; যদিও এর সাথে আমার আলোচনার বিষয়ের বেশ যোগাযোগ রয়েছে; আমি বলছি আপেল কাটার ছুরির কথা; আর সে ছুরি কোন ঝকঝকে ধারালো ইস্পাতের ছুরি নয়; সে ছুরি এমন এক জনপ্রিয় কিন্তু ভয়ানক আর মোহময় ও ঐন্দ্রজালিক ছুরি যা প্রায় সকলের হাতেই রয়েছে; আর যে ছুরি দিয়ে ইচ্ছে করলেই নিজেকে অথবা অন্য কাউকে খুব সহজেই অদৃশ্যভাবে আর রক্তপাতহীনভাবে হত্যা করা যায়।

আপেল কাটতে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ হাত কেটে যাওয়া একটি নির্দোষ ও সাধারণ ঘটনা যা কষ্ট হলেও মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু আপেল কাটার ছুরি দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা কোনক্রমেই কেউ মেনে নিতে পারেন না; এটি একটি সচেতন অপরাধ; অথচ আমরা একেকজন এই ছুরি দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়ে চলেছি প্রতিদিন প্রতিমূহুর্তে নির্বিচারে।

এই হত্যাযজ্ঞটি ঘটে চলেছে অতি ধীরে; খুবই সঙ্গোপনে এবং অতি সন্তর্পনে; সবার চোখের সম্মুখে অথচ কাউকে না জানিয়ে; এমনকি কোন ধরণের ভয়ভীতি প্রদর্শন ব্যাতিরেকেই; বলা চলে স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রিদ নামক এক ধরণের ভয়ংকর মাদক যেভাবে নীরবে নির্দ্বিধায় নিজের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে তুলে দেয়; তেমনিভাবে এসব স্বীয় হত্যাকারী এবং ক্রমান্বয়ে নিহত হতে যাওয়া ব্যাক্তিরাও তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিচ্ছে অন্যের হাতে তাদের নিজেরই অজান্তে; আর এই ভয়ংকর মাদক গ্রহণ না করেই এরচেয়েও ভয়াবহরকম নেশায় আসক্তদের কেউই বুঝতে পারছেন না যে তারা নীরবে প্রতিমূহুর্তে এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছেন; আর এভাবে এই হত্যাকাণ্ড একটি সুস্থ সবল তেজোদ্দীপ্ত জাতিকে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে অপরিণামদর্শী আত্মহত্যার দিকে! পৃথিবীর ইতিহাসে কোন দেশে কোন কালে এমন জাতিগত আর মর্মান্তিক আত্মহত্যার উদাহরণ বোধকরি আর নেই!

এই ভয়াবহতম মারণাত্মক নেশাটি এখন গ্রাস করে চলেছে এমনকি শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ সকল মানুষকে; এর কোন জাত-ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ নেই; এমনকি এর কোন নির্দিষ্ট দেশ-কাল-সীমানাও নেই; এর এমনকি কোন শিক্ষিত-অশিক্ষিত বিচার বিবেচনাও নেই; এ এক অন্ধ আর শীতল মাদক; এর ভয়ংকর থাবা থেকে যেন কারোরই মুক্তি নেই। পতঙ্গ যেমন মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঝাপ দেয় অগ্নিশিখায়; তেমনি আমরা পুরো একটি জাতি পতঙ্গের মতোই ঝাঁপ দিয়েছি এক লেলিহান অগ্নিশিখায় এবং প্রতি মূহুর্তেই আমরা এক অজানা আনন্দে আর অচেনা আগ্রহে ঝাঁপ দিয়ে চলেছি পরম মমতায় অমোঘ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে।

সকলেই একমত হবেন যে, বর্তমান সময়টি প্রযুক্তির উতকর্ষের সময় শুধু নয়; বলা চলে পৃথিবী এখন মানবসভ্যতার ইতিহাসের চরমতম উতকর্ষের এক সোনালী সময় অতিক্রম করছে। ইতিহাসের কোন সময়েই প্রযুক্তির এতো বিস্ময়কর উতকর্ষের ঘটনা ঘটেনি। বিশেষ করে ইন্টারনেটের আবিষ্কার বিশ্বের সাতশো কোটি মানুষের সামনে প্রযুক্তির এক আশ্চর্য দুয়ার উন্মোচন করে দিয়েছে; বিপুল বিশাল জনবহুল এই পৃথিবীকে পরিণত করেছে এক বিশ্বগ্রামে; মানুষ দুরতিক্রম্য দূরত্বকে জয় করতে সক্ষম হয়েছে; ঘরে বসে বাইরের বিশ্বকে এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে এই বিস্ময়কর প্রযুক্তির কল্যাণে। এই প্রযুক্তি এখন পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষের সাথে অপর প্রান্তের চির অপরিচিত মানুষের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে এবং তাদের পরস্পরের মাঝে গড়ে তুলেছে গভীর সখ্যতা; তথ্য আদান প্রদান থেকে শুরু করে বহুকিছুই; যেটি একসময় আমাদের কল্পনায়ও ছিল না; বস্তুজগতের এমন প্রায় সকল কিছুর আদান প্রদানই সম্ভব ও বাস্তব করে তুলেছে এই তথ্যপ্রযুক্তি; অল্প সময়ের ভেতর শুধু নয়; অল্পমুল্যেও; এমনকি ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলের সাধ্যের মধ্যেই।

এমন বিস্ময় নিয়ে যার সগর্ব উত্থান ঘটেছে এই পৃথিবীতে আধুনিক সভ্যতার এই অনন্যসাধারণ সময়ে; তার হাত ধরেই আরও অন্যান্য অনেক বিস্ময়ের সঙ্গে সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের কলিতে কীটের মতোই যেন চলে এসেছে সে; যেটিকে আমি তুলনা করতে চাই খাবার টেবিলের আপেল কাঁটার সেই ঝকঝকে ধারালো সুদর্শন ছুরিটির সাথেই; যেটি দিয়ে আপেল কাটা যায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে; কিংবা অসাবধানে আর অসচেতনভাবে কেটে ফেলা যায় নিজের বহুমূল্য আর অনবদ্য আঙ্গুলটিও; অথবা চাইলে তারচেয়েও নির্মমভাবে হত্যা করা যায় কোন সুস্থ সবল সতেজ মানুষকে; কিংবা করা যায় মর্মান্তিক আত্মহত্যাও। আপনার চারপাশে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে তাকালেই আপনি পরিষ্কারভাবে অনুধাবন পারবেন কিভাবে একজন দু’জন মানুষ শুধু নয়; গোটা একটি জাতি কিভাবে একইসাথে ধীরে ধীরে আত্মহত্যা করে চলেছে।

পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষে মানুষে মেলবন্ধন ঘটানোর লক্ষ্যে অভূতপূর্ব যোগাযোগ স্থাপন সহ তথ্য আদানপ্রদান ও অন্যান্য আনন্দ-বিনোদনের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে যে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম; বিশেষ করে বহুলব্যবহৃত ফেসবুক ও ইউটিউব; সেটি আজ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে ডেভিলস ব্রিদের চেয়েও ভয়ানক, তীব্র আর মারাত্মক এক নেশা; আর এই মারাত্মক নেশায় আসক্ত হয়ে আমরা হয়ে পড়েছি এক কাল্পনিক জগতের বাসিন্দা। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের পরস্পরের সাথে পরস্পরকে যুক্ত করে দিয়েছে ঠিকই; কিন্তু তারচেয়েও যেন অধিকতরভাবে আমরা পরস্পরের থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়েছি ধীরে ধীরে এবং আশ্চর্যজনকভাবে নিজেদের অজান্তেই; ফলে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে আমরা হয়ে পড়েছি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর; বহু মানুষের সাথে প্রাযুক্তিকভাবে সংযুক্ত থেকেও যেন আজ আমরা হয়ে পড়েছি একেবারেই একা ও নিঃসঙ্গ।

লক্ষ্য করলে দেখবেন, দশজন কিশোর-কিশোরী কিংবা দশজন যুবক-যুবতী একসাথে বসে আছে এক চমৎকার রোদেলা বিকেলে; কিন্তু কোন কথা নেই তাদের পরস্পর-পরস্পরের সাথে; কোন গল্প নেই তাদের পরস্পরের ভেতরে; তারুণ্যের কোন উচ্ছ্বাস নেই; হাসি আনন্দ কিছুই নেই; তবে যা আছে তার সব তারা ঢেলে দিয়েছে মোবাইলের নেশাতুর রঙিন পর্দায়; সবার হাতেহাতে দামী মোবাইল ফোন আর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ সেই মহামূল্যবান বস্তুটিতে; তারা একসাথে থেকেও বড্ড একা আর নিঃসঙ্গ ভেতরে ভেতরে! সকল অন্তঃসারশূন্য দুর্ভাগা বন্ধুরা পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু তাদের কোন আড্ডা নেই; ণেই কোন রোমান্টিক দৃষ্টিপাত; এমনকি কোন বিষয় নিয়ে পারস্পরিক বিতর্কও নেই; জ্ঞানের প্রতি কোন অভীপ্সা নেই; তাদের চিন্তায় কোন গভীরতা নেই; দেশ কিংবা বিদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-শিল্প-সাহিত্য কোন কিছু নিয়েই তাদের কোন আগ্রহ নেই; এ এক অদ্ভুত অগভীর চিন্তাশক্তিহীন প্রজন্ম প্রসব করছে এই ততোধিক অদ্ভুত সময়; এই নতুন স্বপ্নহীন প্রজন্ম এই দেশ এই জাতি এই পৃথিবীর প্রতি তাদের কোন দায় আছে বলে বোধ করে না; এক ভোগসর্বস্ব প্রজন্ম বোধহীন আর স্বপ্নহীনভাবে বেড়ে উঠছে দিনে দিনে; তারা তো ভবিষ্যতের বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়!

ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের কন্টেন্টে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কোমলমতি কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে যে কোন বয়সের নারী পুরুষের মোবাইল কিংবা টিভির পর্দায় চলে আসছে অনাকাঙ্ক্ষিত আপত্তিকর পর্ণো ভিডিও ক্লিপ; যা দর্শন করে অনেক কিশোর কিশোরী যুবক যুবতী আজ বিপথগামী হয়ে পড়ছে। কিংবা টিকটকের নামে দেশে- বিদেশে তৈরি হচ্ছে অশ্লীল ও আপত্তিকর ভিডিও আর এসব ভিডিও অযাচিত ও নিয়ন্ত্রনহীনভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে তাদের মোবাইল কিংবা টিভির পর্দায়। উঠতি বয়সের তরুণতরুণীরা এসব বিনোদনে আকৃষ্ট হয়ে বখে যাচ্ছে এবং এসব আশ্লীলতা নিজেদের জীবনে প্রয়োগের চেষ্টার ফলে বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক অপরাধ। তরুণ-তরুণীরা পড়াশুনার বদলে উদ্দীপ্ত হইয়ে উঠছে অবাধ যৌনতার হাতছানিতে; এমনকি বিবাহিত-অবিবাহিত পুরুষ-রমণীরা লিপ্ত হয়ে পড়ছে পরকীয়া নামক অনিয়ন্ত্রিত ও সামাজিকভাবে অস্বীকৃত এক অসুস্থ সম্পর্কে; ফলতঃ বহু দম্পতির মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস এবং দাম্পত্য কলহ; স্বপ্নভঙ্গের করুণ বেদনার স্রোতে ভেঙ্গে যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে বহু সোনার সংসার; স্বামী স্ত্রী সন্তান সন্ততির সুন্দর ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে; আর প্রযুক্তির এই নেতিবাচকতার প্রবল প্লাবনে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের স্বপ্নের ভবিষ্যৎ।

বিচ্ছিন্নতাই শুধু অর্জিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে; এমনটি হয়তো আপাতঃ সত্য হতে পারে; কিন্তু পুরোপুরি সত্য নয়; কেননা এর বিপুল উপকারী ও ইতিবাচক দিক রয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য বিষয় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে; কারণ পৃথিবীর সকল মানুষই এগুলোকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে অর্জিত ইতিবাচক বিষয়গুলো যেন ক্রমেই হেরে যাচ্ছে তার ভয়ংকর আর নেতিবাচক প্রভাবের কাছে।

ফেসবুক ও ইউটিউবের প্রতি আমাদের অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত মাত্রায় আসক্তি যে কোন ভাবেই হোক না কেন কাটিয়ে উঠতে হবে আর গ্রহণ করতে হবে তার ইতিবাচক বিষয়গলো; এবং সেজন্যে আমাদের টেবিলের আপেল কাটার ছুরি দিয়ে আমাদেরকে আপেলই কাটতে হবে; এবং তা কাটতে হবে অবশ্যই সচেতনতা ও সতর্কতার সাথে; আর তা না হলে ঘটে যেতে পারে আঙ্গুল কেটে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা; এমনকি অপব্যবহারের কারণে বর্ণিতভাবে ক্রমেই বেড়ে যেতে পারে হত্যা কিংবা আত্মহত্যার মতো মারাত্মক ঘটনাও।

চেয়ে দেখুন; আজ মানুষে মানুষে কোন গল্প নেই; পারস্পরিক ভালোবাসার স্পর্শ নেই; সুন্দর সুন্দর কথার ফুলঝুরি নেই; আমাদের সকলের সমস্ত সম্পর্কই যেন হয়ে উঠেছে অস্তিত্বহীন এক কল্পিত বাস্তবতা। আমরা সবাই সবাই সবাইকে চিনি; আমরা সবাই সবার; কিন্তু কেউ কারো নই। আমরা গান শুনি; কবিতা পড়ি; আর ঘুরে বেড়াই কিন্তু সেসবের অন্তর্গত সৌন্দর্য যেন আমাদের আর স্পর্শ করে না; এ যেন এক মায়া; এক সুদূর সুন্দর বিভ্রম। আমরা আমাদের সম্পর্কের উষ্ণতা হারিয়ে ক্রমান্বয়ে সরে যাচ্ছি একজনের কাছ থেকে আরেকজন; দূরে-বহুদূরে; যেখানে গেলে আর অন্য কারো উপস্থিতির অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। এভাবে দূরে সরে যেতে যেতে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে আমাদের পারস্পরিক ও পারিবারিক বন্ধন; আমাদের সামাজিক বন্ধন; আর ক্রমেই আমরা হয়ে উঠেছি একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা; অথচ আমাদের স্বপ্ন ছিল আমরা থাকবো পরস্পর একসাথে ঐক্যবদ্ধ ও এক দৃঢ় ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ; যার জন্যে আমরা বিস্ময়কর প্রযুক্তির কল্যাণে আবিষ্কৃত ফেসবুকের মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরের সাথে একদিন যুক্ত হয়েছিলাম। আমাদের সারাদিনের কাজকর্ম এখন আর যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই; যাদেরকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা উল্টো তারাই আমাদেরকে এখন নিয়ন্ত্রণ করছে; দিনদিন আমাদেরকে আরও বেশী করে নিয়ন্ত্রণের জালে আবদ্ধ করে ফেলছে ফেসবুক আর ইউটিউব; আমরা এদুটো ছাড়া পাঁচ মিনিটও এখন আর স্থির হয়ে বসতে পারি না; প্রয়োজনে আমাদের দুবেলার খাবার বাদ দিয়ে দিতে পারি আমরা দ্বিধাহীনভাবে; কিন্তু ফেসবুক কিংবা ইউটিউববিহীন পাঁচটি মিনিট আমরা এখন কল্পনাও করতে পারি না!

আজ দুগ্ধপোষ্য শিশুকে পর্যন্ত হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মোবাইল আর তাতে সে উপভোগ করছে ইউটিউবের বিনোদন; কারণ এখন সে এতে এতোটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, ইউটিউবে ভিডিও না দেখলে কিংবা গান না শুনলে সে এখন আর খেতে প্রবৃত্ত হয় না; অথচ মোবাইলের পর্দা থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মিতে শিশুকাল থেকেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার দৃষ্টিশক্তি। আবার, এমনকি বাচ্চার কান্না থামাতে তার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মোবাইল ফোন আর তাতে সে উপভোগ করছে বিভিন্ন রকমের বিনোদন যা তার দৃষ্টিশক্তির জন্য ভয়ানকভাবে ক্ষতিকর; আর সে এখন এটি উপভোগে এতোই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে সে আর কারো সাথে কথা বলছে না; কারো সাথে খেলা করছে না; তার দৃষ্টি সবসময় নিবদ্ধ থাকে ওই মোবাইলের আকর্ষণীয় আর রঙিন পর্দায়; সে তার একাকী এক নিঃসঙ্গ জগত তৈরী করে নিয়েছে তার নিজের মতো করে; জীবন্ত মায়াভরা মানুষ আর প্রকৃতি কিংবা তার চারপাশের অন্য কোনকিছুর প্রতিই তার আর কোন আগ্রহ জন্মে না; এমনকি সে কোন আগ্রহ বোধ করে না মোবাইল ব্যাতীত এই পৃথিবীর অন্য আর কোনকিছুতেই; সে ক্রমেই বেড়ে উঠছে এক আপাতঃ সত্য পৃথিবীতে; বাস্তব পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ আর সৌন্দর্য তার জানা নেই; আর এভাবে তার হাতে মোবাইল আর ইউটিউব তুলে দিয়ে তার মৌলিক মানসিক বিকাশকে আমরা মর্মান্তিকভাবে হত্যা করে চলেছি প্রতিদিন। আমরা ভুলে গেছি যে, সকল কিছুরই একটা সীমা রয়েছে; আর সীমা অতিক্রম করলেই যা ছিল মঙ্গলজনক তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভয়াবহ আরেকটি দিক হলো আমরা যা নই, তা প্রদর্শনের জন্য আমরা এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছি আর তা আমাদের ভেতরে জন্ম দিচ্ছে এক পরশ্রীকাতরতার এবং হীনমন্যতার। আমার অমুক ফেসবুক বন্ধু চার তারকা হোটেলের রেস্টুরেন্টে নৈশভোজ শেষ করে তার ছবি পোস্ট করেছে ফেসবুকে; আর সেটি দেখামাত্র আমার ভেতরেও আমি এক হীনমন্যতা অনুভব করছি; কেননা আমারও অমন একটি তৃপ্তিকর নৈশভোজ শেষ করে তারচেয়েও অধিক স্ফীত আর দন্তবিকশিত একখানা হাসি দিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু সেটা চার তারকা হলে চলবে না; কমপক্ষে পাঁচ তারকা হতে হবে; তাই যে কোন ভাবেই হোক না কেন; পকেটে অর্থ না থাকলে ধার করে কিংবা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে বিল দিয়ে হলেও; এমনকি আমার কোন প্রয়োজন না থাকলেও; শুধু আমার ফেসবুক বন্ধুদেরকে দেখানোর জন্যে হলেও ওই পাঁচ তারকা হোটেলের রেস্টুরেন্টে নৈশভোজ করে একটা পোস্ট আমাকে দিতেই হবে ফেসবুকে; তা সে যে কোন ভাবেই হোক না কেন; তা না হলে এই সমাজের কাছে আমি ক্ষুদ্র হয়ে যাবো; আমার কোন মূল্যই আর অবশিষ্ট থাকবে না কারো কাছে; আর সেটা ভেবে আমিও চলে যাই অবশেষে এক পাঁচ তারকা হোটেলের ঝকঝকে রেস্টুরেন্টে; কেননা নৈশভোজ শেষ করে ওই বন্ধুর চেয়ে ভালো একটি ফেসবুক পোস্ট দিতে না পারলে আমার জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে; প্রয়োজনে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের বিল অফিস থেকে অগ্রিম ধার নিয়ে শোধ করবো! ব্যাংকগুলোও যে আমাদেরকে এ ধরনের কাজে প্রায়শঃ বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করছে না; তাও কিন্তু সঠিক নয়; তাই তারাও কিন্তু এই পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারে না। নিজেকে প্রদর্শনের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে আর তা না হলে আমরা এই গোলকধাঁধার ভেতরেই বিচরণ করতে থাকবো দিনের পর দিন; মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর; আর ধীরে ধীরে এর আসক্তি কেবল বাড়তেই থাকবে; এ থেকে মুক্তি আমাদের সুদূর পরাহতই রয়ে যাবে।

আরেকটি বিষয় হলো; বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষ; বিশেষ করে তরুণ-যুবারা কেন যে ফেনসিডিল-গাজা-ইয়াবা ইত্যাদির মতো নেতিবাচক নেশাগুলোতে আকৃষ্ট হয়; কেন পড়াশুনা গবেষণা কিংবা আবিষ্কারের নেশায় তাদের কোন আকর্ষণ তৈরী হয় না; তাদের দুর্নিবার আকর্ষণ কেন শুধু সমস্ত নেতিবাচকতার দিকেই ধাবিত হয়; আর আমাদের প্রতিবেশী দেশের তরুণ যুবারা কেন এর বিপরীতে অবস্থান করছে; ফেনসিডিল-গাজা-ইয়াবার নেশায় আমাদের তরুণ-যুবাদের মতো নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকছে না কিংবা হয়ে পড়ছে না কর্মবিমুখ আর বিষাদে বিষণ্ণ; সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতে পারে এবং হওয়া প্রয়োজন বলেও বোধ করি আমি; তবে এখন আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে ফেসবুক আর ইউটিউবের এই ভার্চুয়াল ডেভিলস ব্রিদ নেশা থেকে তাদেরকে নিবৃত্ত করার উপায় অনুসন্ধানের; কেননা তা করতে ব্যর্থ হলে একটি বোধহীন মেধাহীন অটিস্টিক প্রজন্ম তৈরি হবে যারা কিছুদিন পরেই পরিবার ও সমাজ তথা রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে; বিলীন হয়ে যাবে আমাদের উতকর্ষ এক অন্ধকারের অচেনা গভীর গহবরে।

সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সহ ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদির ব্যবহার যেন আমরা অপব্যবহারের দিক থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি সেজন্যে আমাদের সকল ব্যবহারকারীদেরকেই সতর্ক হতে হবে এবং এসব ব্যবহারের ইতিবাচক বিষয়গুলোই কেবল গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতার পাশাপাশি সরকারেরও দায় রয়েছে এবং আশা করি সদাশয় সরকার এ বিষয়টি গুরত্ব দিয়ে ভেবে দেখবেন এবং প্রযুক্তিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী সহ সংশ্লিষ্টদের পরামর্শে একটি উপায় বের করবেন যেন এই বিষাক্ত নেশার ঐন্দ্রজালিক মোহ থেকে এই জাতি সহজেই বেরিয়ে আসতে পারে এবং জাতি গঠন তথা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নে তারা ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা যদি নিজের এবং পরিবারের সকলের ক্ষেত্রে এই বিস্ময়কর প্রযুক্তির সুফল পেতে চাই, তাহলে পরিবারের সকলকেই গভীর সচেতনতার সাথে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; অর্থাৎ আপেল কাটার ছুরি দিয়ে শুধু আপেলই কাটতে হবে, অন্য কিছু নয়; আর তাহলেই আমরা একটি সম্ভাবনাময় জাতির আত্মহত্যা ঠেকিয়ে নিজেরা সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারবো।

ড. মোঃ মামুন আশরাফী : কবি, রাষ্ট্রচিন্তক ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়