পুণ্যস্নানে শেষ হবে সুন্দরবনের রাসমেলা

আগের সংবাদ

মিলছে আইএমএফের ঋণ > বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো : রাহুল আনন্দ

পরের সংবাদ

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে ছয় বছরেই বাস্তুহারা ৫৭ লাখ : জলবায়ু পরিবর্তন

প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** ২০৫০ সাল নাগাদ বাস্তুচ্যুত হবে এক কোটি ৩৩ লাখ ** অভিযোজনে প্রতি বছর ব্যয় ১০০ কোটি ডলার ** ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার তহবিল নিয়ে সংশয় **

ঝর্ণা মনি : লবণাক্ততা বাড়ছে। বাড়ছে নদীভাঙন। প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাস্তুচ্যুত, কর্মহীন মানুষ শহরে ছুটছেন কাজের খোঁজে। অধিকাংশের ঠাঁই হচ্ছে বস্তিতে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনে ২০৫০ সাল নাগাদ বাস্তুচ্যুত হবেন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ। আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন নামক গবেষণা সংস্থার গাণিতিকি পদ্ধতিতে করা ওই গবেষণায় বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর গ্রাম ছেড়ে শহরবাসী হচ্ছেন চার লাখ। প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই হাজার। এদের শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু। জলবায়ু অভিযোজনে প্রতি বছর রাজস্ব খাত থেকে ১০০ কোটি ডলার ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত গেøাবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি থেকে ৪৩টি প্রকল্পে ১৬ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান পেয়েছে বাংলাদশে। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে পেয়েছে নয় কোটি ৪৭ লাখ ডলার, ক্লাইমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড থেকে ১১ কোটি ডলার। এর বাইরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে অনুদান পেয়েছে ১০৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনাকে বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় নব্বইয়ের দশকে প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যানে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা- সবগুলো দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ১৯ জেলা ও ১৪৭টি উপজেলায় মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি ৪৮ লাখ। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ওই অঞ্চলে জীবন-জীবিকা, কৃষি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ¡াস নিয়মিত ঘটনা। গত কয়েক দশক ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে নি¤œাঞ্চল নিমজ্জিত ও লবণাক্ত পানি বাড়ছে। সেইসঙ্গে কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগতসহ জীবন-জীবিকাজনিত বিভিন্ন সমস্যার কারণে বাধ্য হয়ে এ জনপদের মানুষ পেশা পরিবর্তন করছে, কর্মসংস্থানের খোঁজে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে গত ছয় বছরে বাংলাদেশে বাস্তুহারা হয়েছেন ৫৭ লাখ মানুষ। জার্মান ওয়াচ গেøাবালের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই-২০২১) অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের একটি। ঝুঁকি ও ক্ষতিগ্রস্তের বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এ ব্যাপারে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ভোরের কাগজকে বলেন, জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। খরা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বাড়ছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন বলেন, পরিবেশ উন্নয়নে বৃক্ষরোপণ, উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি ঝুঁঁকিতে থাকা মানুষজনের জন্য নানা প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা বাড়ানো ও সহায়তা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।
১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার তহবিল নিয়ে সংশয় : বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর চেষ্টা এবং জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগ কমাতে তহবিল আসবে মূলত ধনী এবং শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি, ২০৩০ সাল নাগাদ জলবায়ু সংকট নিরসনে বছরে তাদের জন্য ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল করতে হবে। এর সিংহভাগই খরচ হবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজে। তবে এই

তহবিল সংগ্রহই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে উন্নত ও ধনী দেশগুলোর অনীহার পাশাপাশি জবাবদিহিতামূলক পরিকল্পনাকে বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে তহবিল সংগ্রহে স্বচ্ছতা, জবাবদিতিহার পাশাপাশি সুপরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, যারা অন্যায় করছে, তারা দায় নিচ্ছে না। তারা কার্বন নিঃসরণ কমাবেও না, আবার টাকাও দেবে না। কার্বন না কমানোর কারণে আমাদের সমুদ্রের তলদেশ বেড়ে যাচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ। অভিবাসী হচ্ছে। জমির ওপর চাপ পড়ছে। একটা সমস্যা থেকে আরেকটা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু ও বৈশ্বিক সমস্যার কারণে যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা তখন বৃষ্টি হচ্ছে না, আবার অকাল বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে। নগর ও কৃষির ওপর চাপ পড়ছে। অভিযোজনজনিত চাপ বাড়ছে। পৃথিবীর তিনটি গেøসিয়ারের তলে আমরা। বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে বরফগলা নদীর পানি প্রবাহিত হবে, যা সামাল দেয়া যাবে না। ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে সংশয় রয়েছে।
আশার আলো কপ২৭ : গত কয়েক মাসে পাকিস্তান-নাইজেরিয়ায় ব্যাপক বন্যা, আফ্রিকা-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে তীব্র খরা, ক্যারিবীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় এবং তিন মহাদেশ জুড়ে নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টে অনুযায়ী, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে দশকের শেষ নাগাদ কার্বন দূষণ ১০ শতাংশ বাড়বে এবং পৃথিবী পৃষ্ঠের উষ্ণতা ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস নির্গমন ৪৫ শতাংশ কমানো জরুরি। এর বাইরে উষ্ণায়ন হলে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য একটি হটহাউসে পরিণত হবে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করেই ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় মিসরের শার্ম আল শেখ নগরীতে কপ২৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছে বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এবার জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বিষয়ে নতুন তহবিল গঠন এবং ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন নিশ্চিতে আলোচনা করা হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা, বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুতদের জরুরিভাবে পুনর্বাসনের দায়িত্ব উন্নত বিশ্বকে নিতে জোরালো দাবি জানাবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া অভিযোজন ও প্রশমন, সবুজ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে উন্নত বিশ্বকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হবে। এবারের সম্মেলনে ‘লস এন্ড ড্যামেজ’ বিষয়ে শক্ত অবস্থান তুলে ধরবে বাংলাদেশ। বলা হবে, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার যথেষ্ট নয়। এ জন্য বিকল্প অর্থায়নের দাবি জানানো হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে স্পষ্ট পরামর্শ থাকবে। একই অভিমত জাতিসংঘেরও। জাতিসংঘ বলছে, বছরে ১০০ কোটি ডলারও গরিব দেশগুলোর প্রকৃত চাহিদার চেয়ে অনেক কম। শুধু অভিযোজনের ব্যয় হিসেবেই ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে কপ২৭ এ যোগ দেয়ার আগে পরিবেশবিদ ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে এবারের মূল বক্তব্য থাকবে, দয়া করে যুদ্ধটা বন্ধ করুন, একে অপরকে ধ্বংস করার পরিবর্তে সবাই মিলে পৃথিবীটাকে রক্ষা করুন। আমরা যারা জলবায়ু পরিবর্তনের অসহায় শিকার, আমাদের দেয়া প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, সবাইকে নিয়ে ভালো না থাকতে পারলে একা ভালো থাকা অসম্ভব। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এর জ¦লন্ত প্রমাণ আমেরিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। টাইফুন, ঝড়, দাবানল হচ্ছে। বিশ্বের কিছুটা হলেও বোধোদয় হয়েছে। মনে হচ্ছে- কপ২৭ এ বাস্তবসম্মত সূচনা হবে। আশাব্যঞ্জক পথে হাঁটবে। তবে দাবি আদায়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হওয়ার বিকল্প নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়