পুণ্যস্নানে শেষ হবে সুন্দরবনের রাসমেলা

আগের সংবাদ

মিলছে আইএমএফের ঋণ > বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো : রাহুল আনন্দ

পরের সংবাদ

গণতন্ত্র কি সত্যি মুক্তি পেয়েছে?

প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল ১০ নভেম্বর। আমাদের দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে আরো অনেক দিনের মতো ১০ নভেম্বরও একটি। তবে সূচনায় এই দিনটি যতটা ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছিল, এখন সম্ভবত ততটা উজ্জ্বল নেই। আমাদের অর্জন ও বিজয় যেমন আছে, তেমনি বিজয় হাতছাড়া হওয়ার ঘটনাও কম নয়। আমরা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করি, পাই; আবার পেয়ে হারাইও। এটা বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ হলো আন্দোলনের দেশ, প্রতিবাদের দেশ, আত্মদানের দেশ। বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আন্দোলনে বিজয় অর্জন করি। কিন্তু অর্জিত বিজয়কে আমরা সংহতও করতে পারি না, ধরেও রাখতে পারি না। আমাদের ত্রæটি কোথায়, কেন আমরা পেয়েও হারাই, তা নিয়ে আমাদের গভীর কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। আমরা সাধারণত কোনো কিছুর গভীরে না গিয়ে তাৎক্ষণিকতায় মেতে উঠি।
১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেনের কথা মনে করেই উপরের কথাগুলো বলা হলো। প্রতি বছর ১০ নভেম্বর আমরা নূর হোসেন দিবস পালন করি। তার সাহসী আত্মদানের কথা বক্তৃতায় বলি। কিন্তু নূর হোসেন যে সেøাগান বুক-পিঠে লিখে মিছিলে নেমেছিলেন, সেই লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে- এ প্রশ্নের সম্ভবত এক রকম জবাব পাওয়া যাবে না। এক পক্ষ বলবেন, হ্যাঁ, স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের মাধ্যমে নূর হোসেনের এক দাবি ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ পূরণ হয়েছে। অন্যরা হয়তো বলবেন, পোশাক পরা স্বৈরাচারের পতন হলেও দেশের ওপর চেপে বসেছে ছদ্মবেশী স্বৈরাচার অথবা একটু নমনীয় করে বললে কর্তৃত্ববাদী শাসন।
নূর হোসেনের আরেক দাবি ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। তো, গণতন্ত্র কি সত্যি মুক্তি পেয়েছে? এখানেও এক রকম জবাব পাওয়ার আশা করা বাতুলতা হবে। এক পক্ষ বলবেন, গণতন্ত্র এখন পুরো মুক্ত অবস্থায় আছে। শেখ হাসিনা হলেন ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’, তিনি যেহেতু টানা তিন মেয়াদে দেশের শাসনভার পেয়েছেন, সেহেতু গণতন্ত্র অবশ্যই মুক্ত অবস্থায় আছে। এর বিরুদ্ধে বলা মানুষের সংখ্যা দেশে কম নেই। আওয়ামী লীগ বা সরকারবিরোধীরা দিবানিশি ক্লান্তিহীনভাবে বলে চলছেন, দেশে আসলে গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রের মূল সৌন্দর্য হলো বহু দলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। নানা মত ও পথের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করবেন। সবাই তার বিশ্বাস বা মত বিনা বাধায় প্রকাশ করবেন। ভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে দেশ শাসনের অধিকার কোন দলের। যে দল শতকরা ৫১ ভাগ ভোটারের সমর্থন সংগ্রহ করতে পারবে, দেশ শাসনের হক সেই দলের। আর যারা শতকরা ৪৯ ভাগ ভোটারের মন জয় করতে পারবে, তাদের বসতে হবে বিরোধী দলের আসনে। বিরোধী দলও আসলে সরকারের অংশ। সরকার ভুল করলে, জনবিরোধী কোনো নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তার বিরোধিতা করবে। শুধু বিরোধিতা করলেই হবে না, সরকারের ভুলটা কী বা কোথায় এবং কী করলে, কীভাবে করলে ভালো হতো, সেটাও খোলাসা করে বলতে হবে। মাঠ গরম করা বক্তৃতা নয়, জনচিত্ত জয় করার মতো কাজ করতে হবে। এসব আসলে আমাদের দেশে কষ্টকল্পনার বিষয়। তাহলে কি বলা যায়, আমরা মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে বসবাস করছি? এরশাদ ক্ষমতায় বসেছিলেন বিচারপতি সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে সামরিক বাহিনীর সহায়তায়। তিনি ক্ষমতা দখলের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল বিরোধিতা। এরশাদ যত বছর ক্ষমতায় ছিলেন, দেশ তত বছর আন্দোলন মুক্ত ছিল না। সামরিক শাসকরা ক্ষমতা দখলের সময় নির্বাচন দিয়ে দ্রুত ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার প্রতিশ্রæতি দিলেও পরে সেটা আর রক্ষা করে না। ফলে এরশাদের শাসনকালজুড়েই ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের কখনো যুগপৎ, কখনো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকে আন্দোলন। এরশাদ চেষ্টা করেছেন বিরোধী দলের ঐক্যে ভাঙন ধরাতে। কিছু সফলতা পেলেও মোটাদাগে তিনি ব্যর্থই হয়েছেন। ১৯৮৬ সালের ৭ মে দেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮-দলীয় জোট অংশ নিলেও বিএনপির নেতৃত্বের ৭-দলীয় জোট এবং বাম দলগুলোর ৫-দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। আবার বিএনপি ঘেঁষা জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিলে ওই নির্বাচনেই এরশাদের বিদায় নিশ্চিত হতো। বিরোধী দলের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ব্যাপক ভোট ডাকাতির মাধ্যমে এরশাদের জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে জয় পায়। এরশাদ ভোটে জিতেও বিরোধী দলের বিরোধিতা থেকে রেহাই পাননি।
নির্বাচনের এক বছরের মধ্যে আবার বিরোধীদলীয় জোটগুলো একযোগে আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশে তৈরি হয় টানটান উত্তেজনা। এরশাদ কঠোর অবস্থান নিয়েও মানুষকে ঘরে রাখতে পারেননি। পুলিশ-বিডিআর নামিয়ে, যানবাহন চলাচল বন্ধ করিয়েও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঠেকানো যায়নি। বিক্ষুব্ধ মানুষের সমাবেশ-মিছিল বন্ধ করতে গুলি বর্ষণ করতেও দ্বিধা করেনি এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া সশস্ত্র পোশাকি বাহিনী। গুলিতে নিহত হন অন্তত দুজন। একজন নূর হোসেন, অন্যজন সৈয়দ আমিনুল হুদা। নূর হোসেন ঢাকাতেই থাকতেন। আর আমিনুল হুদা টিটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে ক্ষেতমজুরদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগঠিত করতে নিজ উপজেলা কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে চয়ে যান। সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার জন্য টিটো বাজিতপুর থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে ঢাকা এসেছিলেন। কারণ বিরোধী জোটগুলোর ডাকা কর্মসূচি ব্যর্থ করতে এরশাদ সারাদেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টিটো আর তার বাড়ি ফিরে যেতে পারেননি। এমনকি তার মরদেহটিও গায়েব করেছিল এরশাদের পেটোয়া বাহিনী।
টিটোর মৃত্যুর খবর তাৎক্ষণিকভাবে জানতে না পারায় তার ব্যাপারটি অনেকেরই গোচরে আসেনি। কিন্তু নূর হোসেনের মৃত্যু মানুষকে বেশি আবেগতাড়িত করেছে। ১০ নভেম্বর সমাবেশ বা মিছিলে তার উপস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমীভাবে। নূর হোসেন তার বুকে-পিঠে সেøাগান লিখে রাস্তায় নেমেছিলেন। পিঠে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ আর বুকে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। বুকে-পিঠে সেøাগান লিখে আগে আর কেউ মিছিলে নেমেছিলেন বলে জানা নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি। আবার এভাবে তিনি শত্রæ পক্ষের নিশানার মধ্যে ছিলেন। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে টার্গেট করেই গুলি ছোড়া হয়েছিল। যারা এই টার্গেট করেছিল তাদের নিশানা ব্যর্থ হয়নি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনারও নজরে পড়েছিলেন নূর হোসেন। শেখ হাসিনা একটি হুড খোলা গাড়িতে করে সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। গাড়িতে চড়ে জনতার মধ্য দিয়ে চলার সময় তার চোখ গিয়েছিল নূর হোসেনের গায়ে ওই লেখা স্লোগানের দিকে। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল তার মন। নূর হোসেনকে কাছে ডেকে তাকে সতর্ক করেছিলেন। ‘ওরা টোকাই কেন’ বইতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘মনে পড়ে আমি তাকে বলেছিলাম, জামাটা গায়ে দাও, একি সর্বনাশ করছ, ওরা যে তোমাকে গুলি করে মারবে।’ নূর হোসেন মাথাটা এগিয়ে দিল আমার কাছে। বলল, ‘জান দিয়া দিমু আপা, আপনে শুধু মাথায় হাত বুলাইয়্যা দেন।’ শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমার হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ নূর হোসেন গাড়ির পাশে হাঁটল। তারপর কখন যেন জনতার স্রোতে হারিয়ে গেল।’ এর কিছুক্ষণ পরেই গুলির শব্দ। সেøাগান অঙ্কিত বুক-পিঠ ঝাঁজরা হয়েছিল মুহূর্তে। রক্তে ভেসেছিল রাজপথ। তাকে হাসপাতালে নেয়ার সময় পুলিশ তার গুলিবিদ্ধ দেহ জোর করে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে অতি গোপনে জুরাইন কবরস্থানে নিয়ে তড়িঘড়ি সমাহিত করেছিল। তার মৃত্যু দেশের মানুষকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান তাকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা- ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। কবিতার শেষ কটি লাইন : উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে/ বুকে-পিঠে রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য সেøাগান/বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ শহরে টহলদার/ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা/নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়। বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে /তার বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে। নূর হোসেন, টিটো, তাজুল, সেলিম, দেলোয়ারসহ অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে? না। এরশাদ পতনের পর দেশে ৬টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্ত ভিত্তি পায়নি। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত বা সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া ছাড়া গণতন্ত্রের আর কোনো চিহ্ন দেশ শাসনে কিংবা রাজনৈতিক দল পরিচালনায় দেখা যায় না। বিএনপি-জামায়াতকে গণতন্ত্রের মিত্র মনে করেন না অনেকেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন দাবিদার হলেও দেশ এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলছে বললে গণতন্ত্রকেই লজ্জায় ফেলা হয়। প্রতি বছর এখনো নূর হোসেন দিবস পালন করা হয়, তার সাহসিকতার প্রশংসা করা হয়। কিন্তু পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে, সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে, মানুষ নির্ভয়ে অবাধে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারলে নূর হোসেনকে স্মরণ করা প্রকৃতপক্ষে একটি তামাশা ছাড়া আর কিছু হয় না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত থাকে বলে এক সময় যারা স্বস্তি বোধ করতেন, এখন তারাও বর্তমান সরকারের অনেক কাজকর্মে অস্বস্তি বোধ করছেন। শেখ হাসিনার সরকার দেশের অনেক উন্নতি করেছে, অনেক কিছুতেই উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ আর শূন্য ঝুলির দেশ নয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার সক্ষমতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এক দিনে প্রধানমন্ত্রী ১০০ সেতু চলাচলের জন্য খুলে দিয়ে নতুন এক বাংলাদেশের চিত্রই তুলে ধরেছেন। কিন্তু এত সাফল্যের পরও মানুষের মনে কিন্তু সুখ ও স্বস্তির অভাব রয়েছে। ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য মানুষের যে আকুতি, তা যদি অপূর্ণই থাকে, তাহলে নূর হোসেনের আত্মদানও কি মূল্যহীন হয় না?

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়