সংসদে অনির্ধারিত আলোচনা : বাড়াবাড়ি করলে ছাড় দেয়া হবে না : কাদের

আগের সংবাদ

একগুচ্ছ শর্ত আইএমএফের : ভর্তুকি কমানোয় জোর, ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা

পরের সংবাদ

গুজব ও অপপ্রচারে সয়লাবের পরিণতি নিজেদেরই ভোগ করতে হবে

প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সমাজে মানুষের দ্বিচারিতা, আবেগতাড়িত হওয়া এবং প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ কম থাকার বিষয়টি আমাকে বেশ বিস্মিত করে। অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষও দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু সম্পর্কে যখন ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন না দেখি, তখন হতবাক না হয়ে পারি না। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষকের মধ্যেও আমাদের ন্যূনতম যে পরিমাণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না থাকতে দেখে হতবাক হতে হয়। টিভিতে মাঝেমধ্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো সম্পর্কে জানতে চাওয়া বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর যখন একেবারে ভুলভাল দিতে দেখি, তখন বুঝতে কষ্ট হয় এরা এ দেশে এত বছর বসবাস করে এই ৪-৫টা তথ্য একেবারেই জানে না- সেটি কি করে সম্ভব, তাও বুঝতে কষ্ট হয়। যেমন- ২৬ মার্চ, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ১৬ ডিসেম্বর এরকম কয়েকটি তারিখ ২৫-৩০ বছরের তরুণরা জানবে না, তা কী করে হয়? দিবসগুলো তো আমরা প্রতি বছরই পালন করে থাকি। টিভি, পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে সংবাদ ও লেখালেখিও হয়। তারা কি এর কিছুই পড়ে না? সোহেল তাজ সম্প্রতি টিভির একটি আলোচনায় বলেছেন, তার করা একটি জরিপে শতভাগ শিক্ষার্থী আমাদের জাতীয় ইতিহাসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস, কয়েকজন ঐতিহাসিক নেতার নাম ও পরিচয় সম্পর্কে সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারেননি। আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বসে অনেক সময় এমন সব প্রার্থীর উত্তর শুনে হতবাক হয়েছি- যারা মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে কোনো উত্তর দিতে পারছিল না। একজন শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, তিনি একটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স ভাইবা পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর তার থেকে বের করতে পারেননি। এ ধরনের অসংখ্য বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন জীবনে পদে পদে হয়ে এসেছি। বুঝতে পারছি আমাদের সমাজে শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান এগুলো আত্মস্থ করার কোনো মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। সমাজে যে কোনো বিষয় সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার আগ্রহ তেমন দেখা যায় না। এমনকি যারা রাজনীতি করেন বলে নিজেদের দাবি করেন তাদের মধ্যে। তাদেরও বেশিরভাগ নেতাকর্মী, সমর্থক; নিজেদের দলের ইতিহাস, জাতীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে খুব একটা জানেন, পরিষ্কার ধারণা রাখেন এমন নেতাকর্মীর সংখ্যা বিরল প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই মনে হচ্ছে এমনটিই চলছে। অথচ এই সমাজে কোনো গুজব, বিকৃত তথ্য, অপপ্রচার, বানোয়াট বিষয়াদি মুহূর্তের মধ্যেই দেশের এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্ত পর্যন্ত সয়লাব হয়ে যায়। বিষয়টা সঠিক নাকি মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাকি নিছক তামাশা এটিও অনেকেই যাচাই-বাছাই করে দেখেন না। জাতীয় ইতিহাসের অনেক বিষয় নিয়ে কল্পিত অনেক অপপ্রচার এখনো অনেকে বিশ্বাস করেন, ইতিহাস বলে চালিয়েও দেন। যে তরুণ প্রজন্ম এই সময়েরই অনেক তথ্য জানে না তাদের অনেকেই ‘৭২-‘৭৫ সময়ের অপপ্রচার, গুজব, মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য সংবলিত বানোয়াট গল্প নির্ধিদ্বায় বলে যাচ্ছে। এরকম কিছু তরুণের মুখোমুখি হওয়ার আমার দুর্ভাগ্য হয়েছে। বলতে বাধ্য হয়েছি, ‘তুমি কি বাবা কষ্ট করে সেই সময়ের পত্রপত্রিকা অথবা সিরিয়াস কোনো লেখকের বই পড়ে জানার চেষ্টা করতে পারো না? ৪০-৪৫ বছর আগের কথাগুলো তুমি না পড়ে কেন বিশ্বাস করো?’ অথচ এরা অনেকেই বেশ মেধাবী। কিন্তু মেধা চর্চায় যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেকেই খুব বেশি সিরিয়াস নয়। খুব কম সংখ্যক তরুণকেই পেয়েছি, যারা আগ্রহ ভরে জাতির ইতিহাসের নিকট অতীতের বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করে থাকে। এমন একটি সমাজমানসে সত্য এবং মিথ্যার অবস্থানটি কীভাবে সহজেই জায়গা করে নেয়- সেটি বুঝতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না। প্রতিনিয়ত দেশে অনেক কিছু ঘটে। কখনো সমাজে ঘটনাসমূহ জানার আগ্রহ তেমন একটা দেখা যায় না আবার কখনো কখনো ঘটনার চাইতে রটনা, গুজব, অপপ্রচার, বানোয়াট ও মিথ্যা বিকৃত তথ্যের ছড়াছড়ি চারদিকে বিদ্যুৎগতিতে প্রবাহিত হতে দেখে হতবাক হতে হয়। এটি প্রমাণ করে আমাদের সমাজ আধুনিকতা থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে, পরিপক্ব হওয়ার তেমন কোনো প্রক্রিয়াতেই নেই। অর্থনৈতিকভাবে আমরা অনেকেই ধনী হচ্ছি, নাদুসনুদুস স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছি, কিন্তু সমাজ, জীবন সচেতনতা, রাষ্ট্র ও বিশ্ব সর্ম্পকীয় ধারণা আমাদের খুব বেশি পরিবর্তন করতে পারছে না- এটা অনেকটাই স্পষ্ট।
সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনার নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণা, গুজব ও অপপ্রচারের অভিজ্ঞতা থেকে উপরের কথাগুলো তুলে ধরেছি। দেশে এখন বিএনপি কিছু বিভাগীয় শহরে দলীয় সভা-সমাবেশ করছে। বিএনপি নেতারা সেগুলোতে তাদের বক্তৃতায় নানা ধরনের কথা বলছেন। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নানা বিষয়ে তাদের বক্তব্য প্রদান করছেন। গোটা বিশ্বই এখন করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ অভিঘাতে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশেও এর কিছু কিছু প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েছে। কিন্তু বিএনপি নেতারা বিশ্ব অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থাকে ধর্তব্যে না নিয়ে জ¦ালানি, তেল, গ্যাস, গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেল, চাল ইত্যাদি মূল্যবৃদ্ধির বিষয়গুলো নিয়ে এমনভাবে কথা বলছে, যেন এগুলোর মূল্যবৃদ্ধি একমাত্র বাংলাদেশেই ঘটেছে তারা এমনটিও দাবি করছেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব খাদ্য সংকটের কথা বলে বিশ্বের কোথাও কোথাও আগামী বছর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলেছেন। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাও একই কথা বলেছে। তারপরও বিএনপি নেতারা জনসভাগুলোতেই শুধু নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভি টকশো এবং শহর-গ্রামের সর্বত্র বলে বেড়াচ্ছেন, আগামী বছর দুর্ভিক্ষ আসছে- এ কথা শেখ হাসিনা বলছেন, একই সঙ্গে বলছেন বাংলাদেশের রিজার্ভ গিলে খাচ্ছে, লুটপাট-দুর্নীতি করে সব টাকা পাচার করা হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাংকে কোনো টাকা নেই, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের চাইতেও খারাপ অবস্থা এসে গেছে। সুতরাং সবাইকে খাদ্যদ্রব্য, জিনিসপত্র মজুত করার জন্য তারা তাগাদা দিচ্ছে। আর আমাদের ব্যবসায়ীদের একটি বিরাট অংশ তো বসেই আছেন কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির জন্য। তারা ক্রেতাদের এখনই ফিসফিস করে বলা শুরু করেছেন, দেশে দুর্ভিক্ষ আসছে। যা পারুন কিনে রাখুন। আমরা জিনিসপত্র খুব বেশি পাচ্ছি না। বুঝাই যাচ্ছে সব শিয়ালের এক রা। সবাই এখন ‘গেল গেল সবকিছু গেল’ রব তুলে দিয়ে মজা লুটার চেষ্টা করা শুরু করেছে। মুহূর্তের মধ্যেই সব অঞ্চলে খবর ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। গুজব, অপপ্রচার ও রটনাগুলো নানারকম ডালপালা মেলে দেশে একটি বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর অবস্থা ডিসেম্বরের আগেই সৃষ্টি করার কোনো পাঁয়তারা হচ্ছে কিনা, তা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। আমার পরিচিত একজন টেলিফোনে কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, তার বাসায় পরিচিত একজন বিএনপি সমর্থক আড্ডা দিতে এসেছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে তাকে জানালেন, দেশে এখন রিজার্ভ দেড় বিলিয়নে ঠেকেছে। এটি শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের চাইতেও কম। আমার পরিচিত ভদ্রলোকের তো আক্কেলগুড়–ম। তিনি বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ যে ৩৫ বিলিয়নের ওপরে সেটিও জানেন, তাকেও শোনালেন। কিন্তু বিএনপি সমর্থক সেই ভদ্রলোক তা বিশ্বাস করেনি। আরেকজন কথা প্রসঙ্গে বললেন, এক জায়গায় আড্ডায় বলাবলি করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক কেটে দিচ্ছেন আর বাংলাদেশ থেকে সব ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। এ ধরনের কল্পকাহিনী এখন ছড়াতে ‘হিজরতে’ নেমেছে অনেকেই। সেটা গ্রামে এবং শহরে যেখানেই ছোটখাট আড্ডা হয় সেখানেই এসব বয়ানকারীরা কত কি বয়ান দেন! মনে পড়ে পদ্মা সেতু নিয়ে শিশুর মাথা বলি দেয়ার গল্পের অপপ্রচার গ্রামগঞ্জে কারা কীভাবে ছড়িয়েছিল সেসব গুজব ও রটনার কথা? পদ্মা সেতুতে শিশুর মাথা বলি দেয়ার গুজব দেশময় কয়েকবার ছড়িয়ে গিয়েছিল। সেটি থামাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠেও নামতে হয়েছিল। অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধও করে দিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে গুজব কীভাবে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে তার অসংখ্য নজির তো আমাদের জানাই আছে। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখার কল্পকাহিনী শোনা গেছে, বিশ্বাসও করানো গেছে! শাপলা চত্বরে হাজার হাজার লাশ বুড়িগঙ্গায় বা ভারতে মুহূর্তের মধ্যে পাচার করা গেছে! সে গুজবও দেশে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এখন যা প্রধানমন্ত্রী বলেননি তাও প্রকাশ্য জনসভায় বলা হচ্ছে, টকশোতে বলা হচ্ছে, সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরে ব্যক্তি পর্যায়ে ছড়ানো হচ্ছে। অথচ এখনো গ্রামে কোনো কৃষিকাজ কিংবা অন্য কোনো কাজের জন্য শ্রমিক তেমন পাওয়া যাচ্ছে না, পাওয়া গেলেও ৬০০-৭০০ টাকার নিচে মজুরিতে কাউকে পাওয়াও যাচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে, বাস্তবতা যত চোখের সামনেই থাকুক না কেন, মিথ্যাচার, গুজব রটানো এবং বানোয়াট কথাবার্তা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার ‘হিজরতে’ অনেকেই নেমেছে। এটা এক ভয়ংকর আগুন নিয়ে খেলার মতো আত্মহননের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষত বাজারকে অস্থিতিশীল করে ফেলার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর যে সংকট ও দুষ্প্রাপ্যতা তৈরি হতে পারে তাতে মানুষের কাছে আজকের গুজবই একসময় বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা টকশোতে মিথ্যা তথ্যগুলোর বিপক্ষে সঠিক তথ্য সবাই দিতে পারছেন বলে মনে হয় না। নেতাকর্মীদের মধ্যে এখনো পদপদবি নিয়েই ব্যস্ততা, টানাটানি, দ্ব›দ্ব লেগে আছে। দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে তাদের ক’জনের যথার্থ পর্যবেক্ষণ আছে বলা মুশকিল। তবে এভাবে চলতে থাকলে বিশ্ব পরিস্থিতির ভয়াবহ বিপর্যয়ের গর্তে অপপ্রচারকারীদেরও পড়তে হতে পারে। সুতরাং এ পথ নয়, বাস্তবতার পথেই সবাইকে চলতে হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়