বাংলা একাডেমির তিনটি পুরস্কার ঘোষণা

আগের সংবাদ

মহাসড়কে পদে পদে মরণফাঁদ :

পরের সংবাদ

শেষ বিকেলের রোদ

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘শোনো তোমার মা তোমাকে ছোটবেলায় ভালোবাসত না। এখন ওখানে কি বলবে সেটা তোমার ব্যাপার। দিনের পর দিন অফিসের কাজের নাম করে বাইরে থেকেছে। নামি-দামি ডিগ্রি নিয়েছে কিন্তু তোমাকে সময় দ্যায়নি।’ সুবেশি ভদ্রমহিলা এই কথা বলে কিশোরীর চুল ঠিক করে দিলেন।
মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’
‘তুমি বুঝতে পারছ তো কার সঙ্গে থাকলে তোমার জন্য ভালো হবে। আমি তো থাকব তোমার সঙ্গে। আর তোমার মার সঙ্গেও তোমার দেখা হবে’।
মেয়েটি চুপ করে মাথা নাড়ল আরেকবার।
আমি বাংলা শুনে কৌতূহলী হলাম। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেটা ক্যালগেরির কোর্ট হাউসের বারান্দা। এটাকে করিডোর বলা চলে। সামনেই ট্রেন স্টেশন। ডাউন-টাউনের একটা স্টপ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।
কোর্ট হাউস জায়গাটা বেশ অদ্ভুত। এখানে নানা রকমের লোক আসে। কেউ হয়তো ট্র্যাফিক টিকেট নিয়ে হাজিরা দিতে এসেছে। কখনো সখনো অনেক অন্যরকম ব্যাপারও হয়। নেশায় চুর মানুষও দেখেছি। আসলেই এখানে হরেক রকম মানুষ।
আমি কোর্ট হাউসে আসি অনুবাদকের কাজ করতে। অনেক সময় বাংলাভাষী মানুষ ইংরেজিতে কথা চালাতে পারেন না। তাদের জন্য আমি আসি অনুবাদকের কাজ করতে। অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে এখানে আমার। আমি একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। ব্যাপার কি জানতে হচ্ছে।
এই চাকরিতে যে টাকা আসে তা মন্দ নয়। আমি একজন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট। আমি বিভিন্ন জায়গায় পার্ট টাইম কাজ করে আমার থাকা খাওয়ার খরচ ওঠানোর চেষ্টা করি। ছোটবেলায় মা বাংলা শিক্ষার ব্যাপারে জোর দিয়েছিলেন তার ফল পাচ্ছি।
মেয়েটির বয়স ১০-১১ এর আশপাশে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। লম্বা চুল। সেই লম্বা কালো চুলে কয়েক জায়গায় নীল রং। সে আশপাশে বেশি তাকাচ্ছে না। তার সমস্ত মনোযোগ হাতের ফোনের দিকে। যেন এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করলেই প্রলয় ঘটে যাবে।
এই বয়সটাই অদ্ভুত। একটা অস্তির চঞ্চল সময় কাটে সবার। নিজেকে আবিষ্কার করার সময়। তবে অস্তিরতার আড়ালে এই মেয়েটির চোখে অন্য একটা গল্প আছে। ওর চোখে একটা অদ্ভুত শূন্যতা আছে যা সচরাচর এই বয়সি মেয়েদের চোখে অনুপস্থিত। চোখের ভাষা অনুবাদ করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দ্যাননি। তাই মেয়েটি কি ভাবছে বোঝার উপায়ও নেই।
কেন যেন মেয়েটার কথা আমার মাথায় কিছুদিন ঘুরতে থাকল। এর পরের বার কাকতালীয়ভাবে মেয়ের বাবাকে আমি দেখলাম এক বাঙালি গেট টুগেদারে। এখানকার ছাত্রছাত্রীরা প্রায়ই একসঙ্গে কারোর বাড়িতে ওয়ান ডিশ পার্টি করে। আমি তক্কে তক্কে রইলাম মেয়ের বাবার পরিচয় খুঁজতে।
ভদ্রলোক চুপচাপ ধরনের মানুষ। কথা কম বলেন। হুট করে কাউকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা বড় ধরনের অসভ্যতা। আমার সঙ্গে পরিচয় হলো টেবিলে রসুন ভর্তা নামক একটা অদ্ভুত আইটেম নিয়ে। উনি নিয়ে এসেছেন।
আমি বললাম, ‘এই ভর্তা আসলেও খুব মজার। আপনি না বললে বুঝতে পারতাম না এটা কিসের ভর্তা।’
‘এটা আমার বানানো। তবে রেসিপি আমার মায়ের। তুমি এখানে পড়াশুনা করছো কোন সাবজেক্টে অবনী?’
‘জি। কম্পিউটার সায়েন্স।’
‘বাহ্। আমার মেয়ে সিয়েরার ও কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে খুব আগ্রহ।’
‘বয়স কত আপনার মেয়ের? দেখবেন বড় হতে হতে ঠিক পছন্দ বদলে যাবে।’
‘হাহাহাহা। এটা ঠিক বলেছি তুমি। ছোটবেলায় আইসক্রিম ট্রাকের ড্রাইভার হতে চাইত ও। বড় হতে হতে কত কিছুই বদলায়।’
উনি চলে যাবার পরেও আমরা ঘণ্টা তিনেক আড্ডা দিলাম। আমাদের মাঝে আনুশকা আপু ওনাকে ভালো চেনেন। ভদ্রলোকের নাম জাহিদ।
‘বুঝেছ। জাহিদ ভাই বেচারা খুব মুষড়ে পরেছেন। ওনার ডিভোর্স ফাইনাল। এখন চিন্তায় পড়েছেন কার কাছে থাকবে মেয়ে সিয়েরা।’
আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? মায়ের কাছে থাকার নিয়ম না?’
‘নাহ। এই দেশে এমন ব্যাপার নেই। আসলে দুঃখজনক হলেও সত্য এখানে একটা আর্থিক ব্যাপার জড়িত আছে। যার কাছে থাকবে তাকে অন্য পেরেন্ট একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দেবেন। ঠিক এই জন্যই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে।
আপুর কথা বার্তা খুব চাছা ছোলা। উনি বললেন, ‘দেখবে বাংলাদেশে ঠিক উল্টো চিত্র ঘটে। কার ঘাড়ে সন্তান গছানো যায় এটাই ব্যাপার।’
আমার মাথায় তেমন জটিল হিসাব-নিকাশ ঢোকে না। আমি শুধু চিন্তা করলাম মেয়েটার কি হবে।
পাশে থেকে একজন বললেন, ‘আরে মেয়ের মা অনেক ক্যারিয়ারিস্ট। কে জানে কি হয়েছে! জাহিদ ভাই তো এখনো বৌ বলতে পাগল।’
আনুশকা আপু কাষ্ঠ হাসি দিয়ে বললেন, ‘ক্যারিয়ারিস্ট মাকে চলুন এখুনি ফাঁসি কাষ্ঠে চড়িয়ে দেই আমরা। ল্যাঠা চুকে যাক।’
সবাই চুপ হয়ে গেল। যার বাড়িতে দাওয়াত তিনি অস্বস্তি এড়াতে কুমিল্লার রসমালাই নিয়ে আলাপ শুরু করলেন।
প্রায় দিন সাতেক পর
আমি ক্রস আয়রন মিল শপিংমলে গেছি। সিয়েরা মেয়েটিকে দেখলাম এক সুন্দরী ভদ্রমহিলার সঙ্গে হাঁটছে। আমি ধরেই নিলাম ভদ্রমহিলা ওর মা। দুজনের চেহারায় অনেক মিল আছে। মেয়ের মা শক্ত করে ওর হাত ধরে আছে। একটা হাওয়াই মিঠাই এর দোকান থেকে রংধনু রঙের হাওয়াই মিঠাই কিনল মেয়ের মা। দুজনে খুশিমনে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটি তার মায়ের হাত শক্ত করে ধরে হাঁটছে।
কিছুদিন পরে আমি ওদের কথা ভুলেই গেলাম। পরীক্ষা কেমন ঘনিয়ে আসছে। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কঠিন ব্যস্ততা। রান্না করে খাবার সময়ও নেই। এই সময়ে গেট টুগেদারগুলো এড়িয়ে চললাম। শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে ভেবে।
তবে কোর্ট হাউস থেকে আমার ডাক পড়ল একদিন। একটা কেসের অনুবাদকের কাজ করতে হবে। আমি যথা সময়ে উপস্থিত হলাম দুপুরের দিকে। যাবার পরে একজন জানালেন এখানে এমন একজন সাক্ষী আছেন যিনি ইংলিশ বলতে পারেন না। তার কথাগুলোই আমাকে অনুবাদ করে লিখতে হবে।
যাই হোক। আমি অবাক হয়ে দেখলাম জাহিদ ভাই নামের ভদ্রলোক, ওনার স্ত্রী আর কন্যাকে।
যার সাক্ষ্য আমাকে অনুবাদ করতে হবে সেই ভদ্রমহিলা জাহিদ ভাইয়ের মা। উনি বললেন যেহেতু মেয়ের মা ব্যস্ত থাকে, বাবাও চাকরি করে দুজনের অনুপস্থিতিতে উনি নাতনির দেখ ভালো করতে পারবেন। ছোটবেলা থেকেই খেয়াল রেখেছেন। গুছিয়ে বললেন মেয়ের দেড় বছর বয়সে তার মা অফিসের কাজে শহরের বাইরে গিয়েছিল উনি মেয়ের খেয়াল রেখেছেন।
এর পরে মেয়েকে ডাকা হলো। তাকে করা হলো কঠিন প্রশ্ন সে বাবা বা মা কার কাছে থাকতে চায়। এই প্রশ্নের সরল উত্তর সবাই জানে। সন্তান দুজনের কাছেই থাকতে চায়। মেয়েটি হতাশ চোখে একবার বাবা আরেকবার মায়ের দিকে তাকালো। সে সিদ্ধান্ত না দিতে পেরে বলল, ‘সপ্তাহে ভাগ করে দুজনের কাছেই থাকতে চায়।’
চোখের দৃষ্টি পড়ার ক্ষমতা না থাকলেও আমি জানি মেয়েটির শ্যনদৃষ্টির অর্থ। ওর জীবনে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন যাদের সঙ্গে ও তাদের ছেড়ে ভালো থাকবে না। ওর ইচ্ছেমতোই কাস্টডি ভাগ করা হলো। সপ্তাহে চারদিন একজনের কাছে আর তিনদিন আরেকজনের কাছে। ছুটি ছাটা দুজনে ভাগ করে নেবেন। বাড়ি ফেরার আগে একবার ওয়াশরুমে ঢুকলাম। দেখি সিয়েরার চোখ মুখ লাল। আমাকে দেখে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। আমি ঠোঁট টিপে একটা হাসি দিয়ে ওকে বললাম, ‘এখন বাড়ি যাবে?’
‘জি। কি একটা বিশ্রী ব্যাপার। আমার দাদি আমাকে খুব ভালোবাসেন। তবে নানাভাবে মায়ের সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন আমাকে। বাবা আর মা কারো মাঝে কি চুজ করা যায় বলুন?’
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। আসলেই তো খুব কঠিন প্রশ্ন।
শীতকালের বিকাল এখানে খুব ভীষণ্ন মনে হয় আমার। সেই শেষ বিকালের রোদে দেখলাম সিয়েরা সবার আগে হেঁটে যাচ্ছে পেছনে ওর বাবা আর মা। সেই রোদ কেন যেন আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়ালো না বরঞ্চ বিষাদের চাদরে মুড়ে রাখল চারপাশ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়