বাংলা একাডেমির তিনটি পুরস্কার ঘোষণা

আগের সংবাদ

মহাসড়কে পদে পদে মরণফাঁদ :

পরের সংবাদ

মিলু শামসের মুক্তগদ্য স্ন্যাপশট : টুকরো কথার চিত্র

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মিলু শামস একাধারে কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। কোভিড-১৯ আক্রান্ত সময়ে নিজের জীবনের বিভিন্ন সময়ের উপলব্ধি সাহিত্য-ফর্মে সৃজন করেছেন। আর তা করতে গিয়ে নিজের জীবনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনার অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত অনুভূতি, সাহিত্য দর্শন, পাঠ মূল্যায়ন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরের নানান পর্যবেক্ষণ, চেনা-অচেনা জগতের নানা বিষয় তিনি ছোট ছোট গদ্যে লিপিবদ্ধ করেন। লিপিবদ্ধ গদ্যের অনেকই তিনি নিজের ফেসবুক বুক স্ট্যাটাসেও শেয়ার করেছেন।
ফেসবুক বুক স্ট্যাটাসে দেয়া গদ্যসহ মোট ৬০টি গদ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বই, ‘স্ন্যাপশট টুকরো কথার চিত্র’। লেখক মুখবন্ধে সে কথা স্বীকার করেছেন এভাবে : ‘সে সময় একঘেয়েমি কাটাতে ফেসবুকে নানান ধরনের ‘চ্যালেঞ্জ’ আহ্বান করা হতো। ওরকমই এক চ্যালেঞ্জে সাড়া দিয়ে নির্ধারিত শব্দে দুটো গল্প লিখেছিলাম- ‘দাফন’ ও ‘দণ্ডকারণ্য’ নামে। দণ্ডকারণ্য বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘লেখকের এই ভূমিকা থেকে স্ন্যাপশটের বিভিন্ন লেখার অনুপ্রেরণা, কার্যকারণ ও অন্তর্নিহিত বিষয় স্পষ্ট হয়। এই যে নির্দিষ্ট সময় ও শব্দের ভিতর একটি গল্প বিনির্মাণ সহজ কথা নয়। লেখক শর্ত মেনে শৈল্পিক মান অক্ষুণ্ন রেখে গল্প বিনির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে দাফন গল্পে করোনাকালে সামাজিক সুবিধাবাদ, স্বার্থপরতা, নিজের অন্ধ বিবরে আটকে থাকা একটি ফাঁপা সমাজের অন্তঃসার বিকট রূপ প্রকাশ্যে এনেছেন। গল্পে দেখা যায় করোনা আক্রান্ত হয়ে একজন মানুষের মৃত্যু হয়। লাশের দাফন কাফন করার জন্য মসজিদের ইমাম, মসজিদ কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ সমাজের কাউকে পাওয়া যায়নি। এমনকি বাধ্য হয়ে একজন দিনমজুর পিতা আসমত মিয়া নিজের ছেলের দাফন ভুগু করালের সাহায্য নেয়। সমাজ কোনো দায়িত্ব নেয়নি উপরন্তু লাশ দাফনে ভুগু করালের অংশগ্রহণেও তাদের আপত্তি। শেষ মুহূর্তে দেখা যায় করোনা আক্রান্ত লাশ দাফনের সমস্ত কৃতিত্বও সমাজ চুরি করে। লেখকের ভাষায় : ‘আসমত মিয়া এবং ভুগু কেউই খবরের কাগজ পড়ে না। নইলে দেখত, পরদিন স্থানীয় সংবাদপত্রে দলিল উদ্দিনের মৃত্যু এবং দাফনের সংবাদ ছাপা হয়েছে এভাবে-
‘বানুডাঙ্গা গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে করোনা আক্রান্ত রোগীর দাফন সম্পন্ন। [পৃ: ১২৩, মিলু শামস, স্ন্যাপশট : টুকরো কথার চিত্র, কাকলী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০২২, ঢাকা]
স্ন্যাপশট পড়লে পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। লেখক একজন ভ্রমণপিপাসু অর্থাৎ একজন পর্যটক। বিভিন্ন সময় পৃথিবীর দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন অর্থাৎ ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণকালে অ¤ø মধুর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা এক কথায় অমূল্য অভিজ্ঞতা। তিনি সেই অভিজ্ঞতা স্ন্যাপশটের বিভিন্ন ভ্রমণ গদ্যে ব্যক্ত করেছেন। লেখকের ভ্রমণ কয়েকটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা :
ক. ‘যাচ্ছি আসোয়ান থেকে লুক্সর। চারদিনের যাত্রা। জার্নিটা ভালো লাগছে ভীষণ। বেশ বাড়ি বাড়ি ভাব। সকালে স্নান খাওয়া সেরে ডেকে গিয়ে বসা, নানা দিক থেকে নদী দেখা, শেডের নিচে বসে বই পড়া। আবার ইচ্ছে হলে রুমে গিয়ে খানিক গড়িয়ে নেয়া। মনে হয় না চলন্ত পথে আছি। ঝাঁকুনি নেই চলার শব্দ নেই সেরকম। দিনে মূলত জাহাজ চলে ধীরে। গতি বাড়ে রাতে।’ [পৃ: ১০, নীলনদে ভ্রমণ ২০১৭, পূর্বোক্ত]
খ. ‘ভূমধ্যসাগরকে প্রথম দেখেছিলাম ফ্রান্সের মার্সেই শহরে। বিভিন্ন দিক থেকে। অপরূপ সৌন্দর্য তার। সে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হই এখনো। একদিন শহর দেখতে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই শান্ত এক প্রাকৃতিক পার্কে।’ [পৃ: ২৭, গ্রেট ওশান রোড, পূর্বোক্ত]
গ. ‘সেই কবে স্কুল পাঠ্যবইয়ে পড়েছি রাইন নদীর কথা। উৎস সম্ভবত জার্মানিতে। এখানে জুরিখে এসে সৃষ্টি করেছে জলপ্রপাত। অপরূপ সুইজারল্যান্ডের অপরূপ রাইন ফলস। সূর্যের আলো গায়ে মেখে আমরা একদল বাঙালি ছুঁয়ে এলাম রাইন ফলস। সকালে উঠেছিলাম হিল ট্রেনে। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। ‘[পৃ: ৯৭, রাইন ফলস-২০১৫, পূর্বোক্ত]
লেখক শুধু ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখেছেন তা নয়, দেশ বিদেশের বিখ্যাত লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, নাট্যজনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাত্রাও পরিমিতভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাদের মধ্যে শিল্পী এস এম সুলতান, মহাশ্বেতা দেবী, সাইদা, আব্দুল আহাদ, তারেক মাসুদ, নীলিমা ইব্রাহীম, ডলি আনোয়ার, কবি সাজ্জাদ কাদির, ড. করুণাময় গোস্বামীসহ বহুজনের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটি সংযত ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। এরকম একজন রোমেনা আফাজের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হওয়ার ঘটনা উপস্থাপন করেছেন এভাবে : ‘দস্যু বনহুরের স্রষ্টা রোমেনা আফাজের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একবার। নব্বই দশকে কী এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। উঠেছিলেন ইংলিশ রোডের আশপাশে খুবই সাদামাটা এক হোটেলে। অনেক কষ্টে খুঁজে পেতে হোটেলে পৌঁছে তার দেখা পেলেও যে উদ্দেশ্যে যাওয়া তা অপূর্ণই থাকে। রহস্যময় লেগেছিল তার আচরণ। আগে থেকে যোগাযোগ ও সময় নির্ধারণ করে সাক্ষাৎকার নিতে গেলেও সঙ্গে আসা তার ছেলে তখন উপস্থিত না থাকায় সাক্ষাৎকার দেননি। বলেছিলেন, ‘ও না এলে আমি কথা বলতে পারব না।’ এ কথাটুকু বলতে বলতেই যেন আড়াল খুঁজে নিলেন। তার সাংবাদিক ভীতি ছিল কি? জানি না ‘[পৃ: ১৮, শার্লক হোমস, বেকার স্ট্রিট, পূর্বোক্ত]
লেখক মিলু শামস মূলত ভ্রমণ ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি প্রকাশের পাশাপাশি রাজনীতি, প্রকৃতি, অর্থনীতি, সমাজ জীবনের চালচিত্র মেলে ধরেছেন। তার ভাষা, সহজ-সরল ও অনবদ্য। খুব সাদামাটা ভাষায় তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি ও জীবন-রাজনৈতিক দর্শন এবং মনীষা ব্যক্ত করেছেন। সহজ বাক্যে গূঢ় কথা লিখেছেন, যার তাৎপর্য গভীর ও বিস্তৃত।
২০২০ সাল থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র পৃথিবী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে স্থবির হয়ে পড়েছিল। ব্যক্তি ও সমাজজীবনে দেখা দেয় চরম বন্ধ্যত্ব। মানুষ প্রত্যক্ষ করে হৃদয়হীন, আত্মপর, স্বার্থপর সমাজ ও জীবন ব্যবস্থা। কেউ কারো নয়, প্রত্যেকেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। পৃথিবী এতটাই হৃদয়হীন ও স্বার্থপর হয়ে ওঠে যে, স্বমী-স্ত্রী, পিতা-মাতা-সন্তান, ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন প্রত্যেকেই প্রত্যেকের থেকে দূরে চলে যায়। প্রত্যেকেই হয়ে ওঠে স্বার্থপর, নিজেকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। একটা অজানা আতঙ্ক, অবিশ্বাস সবাইকেই গ্রাস করে। মহৎ ব্যতিক্রমও ছিল অনেক। অনেকেই নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে অন্যের বিপদ ও প্রয়োজনে সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে। মোটামুটিভাবে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই অবস্থা বিরাজমান ছিল।
এই বন্ধ্যা সময়ে অনেকে ঘরে বসে নিজের সাহিত্যকর্ম করেছেন। অনেকে আবার ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। ফেসবুক স্ট্যাটাস ব্যবহার করে নিজের চিন্তা শেয়ার করেছেন, অন্যের চিন্তা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে সচেষ্ট থেকেছেন। একইভাবে মিলু শামস এই বন্ধ্যা সময়কে মোকাবিলা করেছেন।
স্ন্যাপশট : টুকরো কথার চিত্র
প্রকাশক : কাকলী প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : নূরুল ইসলাম পেয়ার
মূল্য : ২৫০ টাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়