বাংলা একাডেমির তিনটি পুরস্কার ঘোষণা

আগের সংবাদ

মহাসড়কে পদে পদে মরণফাঁদ :

পরের সংবাদ

ক্ষুব্ধ সংলাপ : সমাজ ব্যবস্থার চিরন্তন রূপ

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আনোয়ারা সৈয়দ হকের ক্ষুব্ধ সংলাপ (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ২০১১) বইটি পড়ে যুগপৎভাবে আমিও ক্ষুব্ধ এবং বিস্ময়বোধ করছি। বাংলার ঘরে ঘরে নারী বধূ-মাতাদের প্রতি নিপীড়ন-নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে, যা নিয়ে মহাকাব্য লেখার মতো তথ্য উপাত্ত এ দুর্ভাগা দেশে দুর্লভ নয়। বইটির শিরোনাম আমাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছে পড়ার জন্য। এর ভেতরে এমন কী যন্ত্রণা, এমন কী মর্মবেদনা রয়েছে- যা বইটির নামের আড়ালে ফুটে উঠেছে!
বইটি আত্মজীবনীমূলক। কোনোরকম রাখ-ঢাক না করেই নিজ জীবনের সমস্ত গøানি কষ্টকর দিকগুলো অকপটে তুলে ধরেছেন। পিতা কর্তৃক মাতার নিপীড়ন নির্যাতনের নির্মম কাহিনী লেখিকার জীবনকে যেমন বেদনায় বিক্ষুব্ধ করেছে পাঠকের চিত্তকেও ঠিক তেমনি ক্ষত-বিক্ষত করে তুলেছে। মাতার প্রতি পিতার এরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি প্রায় প্রতিনিয়তই লেখিকাকে দেখতে হয়েছে, যা তার হৃদয়কে বারবার ব্যথাতুর করেছে। তথাপি জীবন চলছে জীবনের গতিতেই। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে চলতে চলতে লেখিকা এমন সব বাধা অতিক্রম করে খ্যাতিমান সাহিত্যিক খ্যতিমান চিন্তাবিদদের তালিকার আপন স্থান করে নিয়েছেন। মৈত্রেয়ী দেবীর আত্মজীবনীমূলক বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস ন হন্যতে পড়ে পাঠক-পাঠিকার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটেছে কিন্তু তার পরেও তার চারপাশের জগৎ ও জীবনের সমগ্রতা বইতে ফুটে ওঠেনি। এখানেই আলোচ্য লেখিকার সঙ্গ তার পার্থক্য। ‘ক্ষুব্ধ সংলাপ’ বইটিতে লেখিকার সমগ্র জীবনের ছোট বড় সমস্ত অনালোচিত অনালোকিত ঘটনাবলি বিধৃত হয়েছে। ন হন্যতে বইটি পড়ে আমার উপলব্ধি আমার চিত্ত বেদনার কথা মৈত্রেয়ী দেবীকে জানিয়েছিলাম। তিনি জবাবে লিখেছিলেন ‘একজন পাঠকের কাছ থেকে এ ধরনের একটি চিঠি পাওয়া ঈশ্বরের আর্শিবাদ বলে মনে করি।’
লেখিকা তসলিমা নাসরিন তার নির্বাচিত কলাম বইতে পিতা কর্তৃক মাতাকে উপেক্ষিত অবহেলিত করার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আছে। মাতার অসুস্থতায় এক পোয়া দুধ সংসার থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়নি। মেয়ে মানুষ বলেই মাতার সুচিকিৎসা, সুখাদ্য জোটে নাই। হাঁস-মুরগির জন্য কিছু বরাদ্দ রেখে বাকি যেটুকু খাদ্যই অবশিষ্ট থাকে তা খেয়েই মাতাকে রাতযাপন করতে হতো। এমনকি তসলিমা নাসরিন নিজে চাকরি করে মাকে দুধ খাওয়াবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেও পেরে ওঠেননি।
লেখিকা বাল্যবয়সে ’৪৭-এর দেশ ভাগের করুণ পরিণতি দেখে ব্যথিত হয়েছেন যার মর্মস্পর্শী চিত্রও তিনি তুলে ধরেছেন। এই ঘটনাবলি আমাকেও নিয়ে যায় সেই দূর অতীতের রোমহর্ষক দিনগুলোতে। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। কাজেই সেই সব দিনের দুঃসহ স্মৃতি আমার হৃদয় থেকে মুছে যায়নি। ১৪ আগস্ট ’৪৭ এর এক প্রভাতে আমার প্রিয় হিন্দু সহপাঠীরা দেখল যে দেশে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম হলো যাদের অনুকম্পায় তাদের বাঁচা-মরা নির্ভরশীল। একই স্কুলে একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে ক্লাস করেছি। পূজা-পার্বণে তাদের বাড়ি গিয়ে আনন্দ কোলাহলে মেতে উঠেছি। সেই বন্ধুরা আজ কোথায়? মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত বিরল। একবার দিল্লি থেকে কলকাতা আসার পথে ট্রেনে হরিদাস বাবুর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বললেন বাংলাদেশে ফরিদপুর তার আদি নিবাস। আমার বাড়িও ফরিদপুর জেনে আনন্দে উচ্ছ¡াসে বিগলিত হয়ে উঠলেন। ভারতব্যাপী ’৪৬, ’৪৭-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে আর্তনাদ করে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন- ’৪৭-এ জীবনের মায়ায় জন্মভূমি ত্যাগ করে এসেছি কিন্তু পরিতাপের বিষয় জন্মভূমির মায়ায় জীবনের ঝুঁকি নিতে পারিনি। আমি বললাম, ‘একবার চলুন মাতৃভূমি দেখে আসবেন’। উত্তরে বললেন, ‘হাজার বছরের পিতৃভূমিতে যেতে হবে পাসপোর্ট ভিসা করে। এরচেয়ে বেদনা বিড়ম্বনা আর নেই। যদি পুনর্জন্ম হয় ফরিদপুরেই যেন জন্মি, ফরিদপুরেই যেন মরি। সে মৃত্যু যদি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের কারণে হয় তবুও। মাতৃরূপী মাতৃভূমি তখন বলবে ‘সন্তান আমার কোলে মাথা রেখে মরেছে, আমাকে ছেড়ে যায়নি’।
এত বড় মাপের লেখিকার লেখা নিয়ে কিছু বলা আমার সাজে না। আমি সাহিত্যিক নই। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী একজন পাঠকমাত্র। চিত্তের অনুভূতি প্রকাশে, ভাষামাধুর্যে, সাহিত্যশৈলীতে লেখিকা এত বেশি পারদর্শী, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। বইটির ৭৪ পৃষ্ঠার ক’টি লাইন আমাকে মুগ্ধ করে রোমান্টিক অনুভবে আচ্ছন্ন করে। একটু উদ্ধৃতি দেয়া যায়- ‘দেশ কি বিদেশ কি, এই বয়সে দেশ এবং বিদেশ আমার আঁচলের নিচে এসে যেন খেলা করে। আমি পৃথিবীর রাস্তায় হেঁটে যাওয়া একজন পথিক- এই রকম এক মহৎ এবং রোমান্টিকভাবে আমায় হৃদয় হয়ে ওঠে উদ্বেলিত।’ জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার একটি চরণের মতো যেন ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।’
বাংলা একাডেমির গাছতলায় গুণীজনদের দেখার জন্য তাদের কথা শুনবার দর্শকের সারিতে লেখিকা সতৃষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখতেন এবং শুনতেন তখনকার খ্যাতিমান সাহিত্যিক শিল্পীদের আলাপচারিতা। প্রচণ্ড ভালো লাগত তার এই গুণীজন-সাহচর্য। লেখিকার ভাষায় ‘আমার শিল্প পিপাসু বুভুক্ষ মন যেন এদের চারপাশ ঘিরেই আবর্তিত হতো। আমার মনে হতো তারা কতদূরের মানুষ। যেন আকাশে তাদের বসবাস, অথচ তবু কত স্বাচ্ছন্দ্যে তারা বাক্যালাপ করছেন মাটির মানুষের সাথে।’- লেখিকার এই উপলব্ধির মাঝে কোনো অতিশয়োক্তি নেই। গুণীজনদের চিন্তা-চেতনা এবং তাদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাবোধের আড়ালে তার বড় মাপের লেখিকা হওয়ার চিন্তাবিদ হওয়ার অপূর্ব ভাষা মাধুর্যের চঞ্চল খেলার কথামালার জাদুকরী গাঁথুনি, তার কাক্সিক্ষত অনাগত জীবনের গতিশীলতা তাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেই। সাহিত্যজগতে তো বটেই, কলামিস্ট হিসেবে পত্রপত্রিকায় স্থায়ী আসন করে নেবেন তা জানতে পাঠকের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এই সময়টা ছিল তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবার উন্মেষকাল।
এক বৃদ্ধার ভিক্ষা চাইবার পর চালের মটকা শূন্য দেখে ঘরের সারা হাঁড়িপাতিল খুঁজে দেখবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ভিক্ষুকের দৃষ্টি এড়াইনি। ভিক্ষুক হলেও তার হৃদয়বৃত্তির ঔদার্য অসামান্য। বৃদ্ধা ভিক্ষুক মুগ্ধ হয়ে দেখলেন লেখিকার ভিক্ষা দেয়ার অদম্য আগ্রহ আকুতি এবং ভাঁড়ার শূন্য বলে ব্যর্থতার গøানি বৃদ্ধা ভিক্ষুকের চিত্ত স্পর্শ করেছে। তারই প্রকাশ ঘটেছে বৃদ্ধার হৃদয়ে নিঃসৃত আশীর্বাদবাণী ‘মা তুমি রাজরাণী হবে, মা’। আমাদের দেশে কন্যা বধূদের প্রতি প্রতীকী আশির্বাদ-বাণীর উত্তম ভাষা হলো ‘মা তুমি রাজরাণী হবে’, এক মুষ্টি ভিক্ষা দেয়ার অক্ষমতার আড়ালে লেখিকা বৃদ্ধার কাছ থেকে যে অনাবিল আশির্বাদ লাভ করলেন তারই ফলশ্রæতিতে হয়তো লেখিকার জীবনপ্রবাহে নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করতে অজান্তে প্রেরণা জুগিয়েছে।
বইটির ৯৭ পৃষ্ঠার প্রথম প্যারায় একটি সহিংস যুগের মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন ফুটে ওঠেছে। এই একটিমাত্র সংক্ষিপ্ত প্যারায় সংক্ষেপে তার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে সে ইতিহাস যন্ত্রণাকাতর বেদনাবিধুর। আমরা যারা সে যুগের প্রত্যক্ষদর্শী এখনও বেঁচে আছি তারা কখনো ভুলতে পারব না সেই বর্বরতার নিষ্ঠুরতার ইতিহাস। হিন্দু মুসলমান রায়ট। ‘পাকিস্তান আমলে একতরফাভাবে হিন্দু নিধনের উৎসব। ছোটবেলা থেকে হিন্দু কাফেলাকে সীমান্তের ওপাড়ে পাড়ি দিতে দেখা।’ কোনো যৌক্তিক কারণে নয় কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক রোষানলে পরে অখণ্ড ভারতের অখণ্ড দুটি প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবের বুক চিরে সীমান্তরেখা টানা হলো যার ফলশ্রæতিতে সীমান্তের এ পাড়ের এক কোটি হিন্দু জনগোষ্ঠী স্ব স্ব গৃহ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে কৃত্রিম সীমান্ত পাড়ি দিল কেবলমাত্র জীবনরক্ষার কারণে। অনুরূপভাবে সীমান্তের ওপারে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটেছিল। জেমস সোজলে তার খধংঃ ফধুং ড়ভ ইৎরঃরংয ঊহঢ়রৎব বইতে লিখেছেন ’৪৬-এর আগস্ট থেকে ’৪৭-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় লাখ মানুষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মৃত্যুবরণ করেছিল। সে বছর ছিল শকুনীদের ইঁসঢ়বৎ ুবধৎ! শকুনের উদর পূর্তি হয়েছিল গলিত মানবদেহ ভক্ষণ করে।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট জিন্নাহর ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’ দিবসে কলকাতার বুকে রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হয়েছিল যার ফলশ্রæতিতে পরবর্তী বছর ১৪ আগস্ট পৃথিবীর বুকে একমাত্র কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হলো। একই সঙ্গে মৃত্যুর ঘণ্টাও গলায় ঝুলিয়ে আন্দোলন অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বীজ তখনই রোপিত হয়েছিল। এই বীজ ধাপে ধাপে বেড়ে উঠল। এবং ‘৭১-এ চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে।
‘মা’ এই এক অক্ষরের শব্দের চেয়ে মোহময় মায়াময় আর কিছু পৃথিবীতে নেই। লেখিকার বড়মা বাবার প্রথম স্ত্রী (লেখিকার গর্ভধারিণী মাতা পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন) এই বড়মার স্নেহস্পর্শ লেখিকার জীবনকে স্নিগ্ধ এবং মুগ্ধ করেছে। পূর্ণিমার চন্দ্রালোকের মতো তার সমস্ত দেহমন অপূর্ব আনন্দে ভরে তুলেছে। এই আনন্দাভূতির বর্ণনা শব্দের খেলায়। ভাষার মহিমায় মোহনীয় করে তুলেছে, যা পাঠকের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে এক অপূর্ব মোহাবেশ রচনা করেছে। সামান্য উদ্ধৃতিতে তা উপলব্ধি করা যায়- ‘তার স্পর্শের ভেতর দিয়েই যেন আমি আমার মৃত মায়ের স্পর্শের পরশ পাই। আমার মাতৃহীনা খাঁ খাঁ অস্তিত্বের ভেতর আমার বড়মা যেন এক মুঠো বৃষ্টি দিয়ে আমাকে সর্বদা স্নেহের মায়া ভিজিয়ে রেখেছেন।’
২১৮ পৃষ্ঠার শেষ প্যারাটি চমৎকার মধুমাখা শব্দের গাঁথুনি জড়িত। শৈশবের স্বপ্নিল দিনগুলোর কথা স্মৃতিপটে এঁকেছেন যেন রবীন্দ্রনাথের ছন্দে ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।’ শৈশবেই লেখালেখিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন- ‘আর আমার চিন্তা-চেতনায় চলত জগতের আবিলতাকে ধুয়ে মুছে কৌটায় ভরে তোলার আকুলতা। একটি বিদগ্ধতার জলে ধোয়া পরিবেশের খোঁজে আমার সারাটা জীবনেই প্রায় ব্যয় করলাম। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন ‘কিন্তু তা কি খুঁজে পেলাম?’ নিশ্চয়ই পেয়েছেন। তার উপন্যাসসমগ্র, কলামিস্ট হিসেবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কী সুচিন্তিত লেখনী এবং ভিন্নধর্মী আলোচ্য ক্ষুব্ধ সংলাপ গ্রন্থটি তাকে স্থান করে দিয়েছে বড় মাপের সাহিত্যিকদের, চিন্তাবিদদের সারিতে।
পিতার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে লন্ডন থেকে বাকি টিকিটে তড়িঘড়ি করে আসবার অদম্য প্রয়াস লক্ষণীয়। এসে সুচিকিৎসার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও পদে পদে ব্যর্থতা ইত্যাদি লেখিকার মতো অসীম ধৈর্যশীলা নারীর হৃদয়কে বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে। বেদনার গুরুভার বক্ষে ধারণ করা সাধ্যাতীত হয়ে উঠেছিল। তিনি নিজেও ডাক্তার হয়ে সব বুঝতে পেরেছিলেন। সঠিক রোগ নির্ণয়পূর্বক ওষুধ প্রয়োগ করতে এ দেশের প্রায় ডাক্তারই অক্ষম। তথাপি ভুল চিকিৎসা করে ভুল ওষুধ দিয়ে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত করতে তারা সক্ষম। ডাক্তারের নির্দেশে মুহূর্তের ভেতর নার্স এন্ডিনালিন সিরিঞ্জে দেয়ার মাঝপথেই বাবা মঞ্জু মঞ্জু চিৎকার করে উঠলেন। তারপর মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন, তারপরের দৃশ্য বেদনাবিধুর। লেখিকা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলেছেন রাস্তা দিয়ে মাকে বাবার মৃত্যুসংবাদ জানাতে। এ শোকের দৌড় যেন অনন্তকালের শেষ হওয়ার নয়। এই শোক এই দৌড়ের দৃশ্য তাকে তাড়িত করবে যতদিন না তিনি তার জীবনের শেষ খেয়া পাড়ি না দেন। পিতা পিতাই- তার বাহ্যিক আচরণ যত রূঢ়ই হোক সন্তানের প্রতি স্নেহের ফল্গুধারা নিরন্তর তার অন্তরে বইতে থাকে। তার বেঁচে ওঠার একান্ত আশা ভরসা ছিল ডা. মেয়ে মঞ্জুকে ঘিরে। সে যখন এসেছে তখন নিবু নিবু জীবনপ্রদীপ আবার আলোকোজ্জ্বল হবে। মৃত্যুর কিনারা থেকে আবার জীবনে উত্তরণ ঘটবে। কিন্তু সে আশা ধোঁয়াশায় পরিণত হলো ‘মূর্খ আত্মম্ভরী একজন ডাক্তারের হঠকারী সিদ্ধান্তে’।
সমুদ্র ভাসমান মানুষ খড়কুটোয় আশ্রয় খোঁজে সে ক্ষেত্রে স্বীয় কন্যা ডাক্তার মঞ্জুকে দেখে তার বাঁচবার আশা শতভাগ জেগে উঠেছিল কিন্তু ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ পেয়ে বারবার ‘মঞ্জু মঞ্জু’ বলে আর্তনাদ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
আলোচ্য বইটি পড়ে লেখিকার জীবনের অনেক দুঃখ-বেদনার কথা জানা যায়। শুধু তার আত্মকথনের মাঝেই বইটির বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ নয়। এতে পাঠকের অনেক কিছু জানার আছে। সমগ্র সমাজব্যবস্থার চিরন্তন রূপ বইটিতে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে অবহেলিত-উপেক্ষিত-নির্যাতিত-নিপীড়িত নারীসমাজের প্রতি আবহমান অবিচারের কথা উঠে এসেছে। সাম্প্রদায়িকতার উগ্ররূপ চল্লিশের দশকের শেষের দিকেই চরম আকার ধারণ করে এবং ’৪৭ এ দেশের বুকের উপর দিয়ে সীমান্তরেখা টানার পরবর্তী দুর্গতির মর্মান্তিক কাহিনীর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু তার পরও পাকিস্তানি প্রেতাত্মা আমাদের ছেড়ে যায়নি। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ আমাদের কাঁধে পাকিস্তানিদের চেয়েও বেশি ভর করে আছে। কিছু কিছু চিকিৎসকের হঠকারী ভুল চিকিৎসার ফলশ্রæতি অনাকাক্সিক্ষত অনিশ্চিত মৃত্যুকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিয়েছে। এসব কথা অকপটে বইটিতে স্থান করে নেয়ায় পাঠকের দৃষ্টিপথে তৎকালীন ও বর্তমান কালের সমাজ-ব্যবস্থার নানা কদর্য দিক উন্মোচিত হয়েছে, যা বইটি না পড়লে বোধগম্য হবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়