সাগর-রুনি হত্যা মামলা : তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পেছাল ৯৩ বার

আগের সংবাদ

গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ায় শঙ্কা : ৩৮০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে বিতরণ ২৬০ কোটি ঘনফুট

পরের সংবাদ

বিএনপির হুমকি বনাম ওবায়দুল কাদেরের নাটকের পর নাটক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিএনপি সরকারের প্রতি একের পর এক হুমকি দিয়েই চলেছে। সরকারের পতন ছাড়া বিএনপি এখন আর কিছুই চায় না। তারা শেখ হাসিনার সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ নাকি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথায় চলবে। এমন হুমকি বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। তবে এসব হুমকিতে সরকার বিচলিত হয়েছে, এমন কোনো খবর কি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন? বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে সরকারের নানা বাঁকা উপায়ে বাধা দেয়া এবং তা সত্ত্বেও সমাবেশগুলোতে বিপুল জনসমাগমকে বিএনপি হয়তো তাদের অনুকূলে মানুষের সমর্থন হিসেবে ধরে নিচ্ছে। কিন্তু কয়েকটি সমাবেশে কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতি কি সরকার পতনের একটি বড় উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যায়?
বিএনপি সরকারের পতন চাইলেও সেটা কীভাবে ঘটবে, সেটা স্পষ্ট করে বলছে না। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকি, হুঙ্কার দিয়ে চলেছে এবং এতে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। সংঘাত ও সংঘর্ষের রাজনীতি ফিরে আসে কি না, তা নিয়ে মানুষ কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছে। বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের ঘোষণা দিয়েও এখন পর্যন্ত তা গড়ে তুলতে পারেনি। আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাল্টা যেসব উদ্যোগের কথা শোনা যায়, তারও তেমন কিছু এখনো দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। তবে উভয় পক্ষ যে তৎপর রয়েছে, অন্তত পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে তা প্রতিদিনের খবরের কাগজের পাঠকদের জানা।
দেশের রাজনীতি নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করা সহজ নয়। কারণ রাজনীতি যেমন কোনো নিয়ম মেনে চলছে না, তেমনি রাজনৈতিক দলের নেতারাও যা বলেন, সেটা তাদের মনের কথা বা বিশ্বাসের কথা নয়। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে, আবার টানা ক্ষমতায় থাকার যন্ত্রণায় ভুগছে আওয়ামী লীগও। পরিস্থিতি কোন দলের অনুকূলে তা এক কথায় বলাও কঠিন। কারণ আমাদের দেশটি রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। এখানে আওয়ামী লীগের যেমন ব্যাপক জনসমর্থন আছে, তেমনি বিএনপিও সমর্থকশূন্য নয়। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির মধ্যে ভোটের ব্যবধান খুব বেশি হবে না, তা যে দলই জিতুক না কেন!
বিএনপি মনে করছে, সরকার টিকে আছে বিভিন্ন বাহিনীর জোরে। পুলিশকে মাঠে না নামালে সরকার নিরাপদ থাকতে পারবে না। যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই তো দেশ উন্নয়নের পথে চলছে। বিএনপি শাসনে কি এখনকার চেয়ে মানুষ সুখে-শান্তিতে ছিল? তুলনামূলক আলোচনা এলে মানুষ আমতা আমতা করবে, নির্দিষ্ট করে কিছু বলবে না। মানুষের বক্তব্য যেহেতু স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়, সেহেতু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্দিষ্ট বা স্পষ্ট কথা বলবেন কেমন করে?
কিন্তু একটি বিষয় অনেকের কাছেই স্পষ্ট যে, আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব শান্ত থাকবে না। দুপক্ষের যখন যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে, তখন ছোট হোক বড় হোক যুদ্ধ একটি হবেই। কে জিতবে, কে হারবে তা এখনই না বলা ভালো। দেশ যেহেতু রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সেহেতু বিভক্ত মতামত থাকাই স্বাভাবিক। যারা বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চান, তারা বলবেন, আগামী যুদ্ধে বিএনপি জিতবে। আবার যারা ক্ষমতায় আরো এক মেয়াদে আওয়ামী লীগকেই দেখতে চান, তারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগকে হারায় এমন শক্তি কার! তবে এটাও ঠিক যে, বিএনপি সম্ভবত আগাম শক্তিক্ষয়ের ভুল পথে হাঁটছে। রাজনৈতিক কৌশলে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি যে কাঁচা তা বহু প্রমাণ তারা দিয়েছে। এটা কোনো বানানো গল্প নয় যে, আওয়ামী লীগের মুখোমুখি হয়ে জেতার অভিজ্ঞতা বিএনপির নেই।
হয়তো বলা হবে, দিন কি সব সময় সবার একরকম হয় বা যায়? না চিরদিন আওয়ামী লীগ অনুকূল পরিবেশ পাবে আর বিএনপি প্রতিকূলে দাঁড় টানবে তা হতে পারে না। আগামী দিনের আন্দোলনের করণীয় নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করেছে বিএনপি। রবিবার এমন একটি বৈঠক হয়েছে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সঙ্গে। আলোচনা শেষে দুই দলের নেতারা বলেছেন, আগামী দিনে আন্দোলনে বড় চমক আসছে। রাজনীতিটা কি আসলে কোনো ‘চমকে’র বিষয়? কল্যাণ পার্টি তো বহু বছর ধরে বিএনপির সঙ্গেই আছে। এই পার্টির বদৌলতে বিএনপির যদি কিছু কল্যাণ হতো তাহলে এত বছরে কেন হলো না? কল্যাণ পার্টির শক্তি বা জনসমর্থনই বা কতটা? সৈয়দ ইবরাহিম সাহেবের ব্যক্তিগত ক্যারিশমাই বা কতটুকু? তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের অভ্যুত্থানের সময় তিনি যে ‘চমক’ দেখিয়েছিলেন তা সংশ্লিষ্টদের নিশ্চয়ই মনে আছে। তারপর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে দল গঠন করে কতটুকু সফল হয়েছেন, যার জোরে বিএনপি এখন চমক দেখানোর কথা বলছে? এ ধরনের অযথা কথা বলে বিএনপি কি তার শুভাকাক্সক্ষীদের কাছেও হাস্যকর হয়ে উঠছে না?
বিএনপির মধ্যে নানামুখী টানাপড়েন আছে। দলটি ঐক্যবদ্ধ ও সংহত নয়। দলের প্রধান দুই শীর্ষ নেতা রাজনীতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারছেন না। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হতে পারবেন না। সরকার আবার হামলা-মামলা বাড়িয়ে দিলে দলের অনেকই আবার গর্তে লুকাবে। বিদেশি মিত্রদের ওপর ভর করে বিএনপি যতই আস্ফালন করুক তা যে কাজের মুহূর্তে নিষ্ফল হয়, তাও দলের ভুক্তভোগীদের অজানা নয়। বর্তমান সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার জেদ যদি বিএনপি অব্যাহত রাখে তাহলে দলটি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়তে পারে।
আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক, সেটা অনেকেই চাইছেন। কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থাকা কোনো দল যদি নিজেদের মতো করে মাঠ সাজাতে না পারে, নির্বাচন থেকে দূরে থাকে তাহলে কী হবে? আওয়ামী লীগের সামনে যেমন সমস্যা আছে, তেমনি বিএনপির সামনেও আছে। আওয়ামী লীগের বড় সম্পদ দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগের জন্য বড় মুশকিল আসানের ভূমিকা পালন করে। বিএনপির দলে বা মিত্রদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার ওপর মানুষের ভরসা আছে। তাহলে কীভাবে বা কিসের জোরে বিএনপি আগামী নির্বাচনের আগে রাজনীতির মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার আসা করছে?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেই জানা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নানা প্রস্তুতির কথা। সরকার বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সামনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সচেতন নেই, সেরকম ভাবারও কোনো কারণ নেই। বর্তমান অর্থনৈতিক টালমাটাল বিশ্বে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, কর্মসংস্থান নিরাপদ রাখা, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জনমনে স্বস্তি সমুন্নত রাখাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে পারলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমস্যা হবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় লাঠির মাথায় পতাকা বেঁধে মিছিল সমাবেশ বা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি রাজধানীর হাজারীবাগে এমন একটি মিছিলে বিএনপি-আওয়ামী লীগ এবং পুলিশের ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হন। সমাবেশ থেকে ‘বিএনপি যুদ্ধে নেমেছে’ বলে সরকারকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন দলটির নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগের বছরই রাজনীতি সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে- এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে ‘বিএনপির এসব হুমকি-ধমকিসহ সব ষড়যন্ত্র’ খতিয়ে দেখে এবার আটঘাট বেঁধেই মাঠে নামছে ক্ষমতাসীনরা। বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে চলতি মাসেই রাজনীতির মাঠ দখলের পরিকল্পনা করেছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগও নিয়েছে দলটি। সেই সঙ্গে সারাদেশে সরকারের উন্নয়ন সাফল্য তুলে ধরে বিএনপির অপপ্রচারের জবাব দিতে নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ডিসেম্বরে বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার ঘোষণাও প্রকাশ্যেই দেয়া হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ। যুবলীগ বলেছে, তারা ওই দিন রাস্তায় থাকবে। বড় সংঘর্ষের সূচনা কি ওই দিন থেকেই?
আওয়ামী লীগের সামনে বড় সমস্যা দলটি ক্ষমতায় থেকে গত ১৩ বছরে অনেকটাই এলোমেলো হয়ে পড়েছে। সম্মেলনের মাধ্যমে দল গোছানোর কাজে হাত দেয়া হয়েছে। রাজনীতি ঘনিষ্ঠ অনেকেই মনে করেন, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। জেলা-উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়ায় নতুন নেতৃত্ব আসার পথ বন্ধ। এমপি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগে দ্ব›দ্ব চরমে। ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে ঠাঁই দেয়া হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের। এভাবে বিশেষ ব্যক্তির বলয় তৈরি করাসহ নানা কারণে তৃণমূলনির্ভর দলটির সাংগঠনিক অবস্থা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তৃণমূলের অনেক অভিযোগ জমা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে। অভিযোগের ভিত্তিতে নেয়া হচ্ছে ব্যবস্থাও। বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। এটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই যে, তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই আওয়ামী লীগের শক্তি। তৃণমূলকে গুছিয়ে এবং নির্বাচন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে পারলে বিএনপি বড় চাপ তৈরি করতে পারবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন না। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন হবে আগামী ২৪ ডিসেম্বর। সম্মেলনের পরই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতি ও বিএনপি মোকাবিলা দৃশ্যমান হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপি বর্তমান সংসদের বিলুপ্তি চায়। বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছেন বলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে হুমকি সম্প্রতি দিয়েছেন, তাতে কি সরকার পক্ষ খুব বিচলিত? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘তাদের হুমকির কী আছে? তাতে কি সংসদ অচল হয়ে যাবে? তারা কয়জন? সাতজন। সাতজন পদত্যাগ করলে সংসদ কি অচল হয়ে যাবে?’ বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না- এ ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এখনো নির্বাচনের এক বছর বাকি। অনেক সময়। এর মধ্যে কত কিছু ঘটে যাবে। নাটকের পর নাটক।’ রাজনীতির নাটকের শেষ দৃশ্যের অভিনয় কে, কীভাবে করবে, এখন তা-ই দেখার অপেক্ষা।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়