সাগর-রুনি হত্যা মামলা : তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পেছাল ৯৩ বার

আগের সংবাদ

গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ায় শঙ্কা : ৩৮০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে বিতরণ ২৬০ কোটি ঘনফুট

পরের সংবাদ

দেশে ফিরে ভুক্তভোগীর লোমহর্ষক বর্ণনা : লিবিয়ায় টর্চার সেলে দেয়া হয় ইলেকট্রিক শক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে দালালদের ৭ লাখ টাকা দিয়ে দুবাইয়ের বিমান ধরেন এক সময়ের সৌদি প্রবাসী শফিউল ইসলাম। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দুবাই, সিরিয়া হয়ে পৌঁছান লিবিয়ার মিসরাত শহরের একটি বাসায়। মাঝপথে অনাহারে কাটলেও মিসরাতের বাসাটি যে টর্চার সেল সেটি স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। একটি ফ্ল্যাটের ছোট ছোট রুমে রাখা হয় তার মতোই ইতালিগামী ৪২ জনকে। কিছু সময় পরপর একেকজনের ডাক পড়তে থাকে টর্চার সেলে। সেখান থেকে ভেসে আসে চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ। ডাক পড়ে শফিউলেরও। টর্চার সেলে ঢুকতেই শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। চড়-লাথি-কিল ঘুষিতে মিলিয়ে যায় তার ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন।
শফিউল বুঝতে পারেন তিনি পাচারকারী চক্রের খপ্পড়ে পড়েছেন। মার খেয়ে কাঁদলে নির্যাতন বেড়ে যেত কয়েকগুণ। একপর্যায়ে গ্রামের বাড়িতে ফোন করে ৫ লাখ টাকা পাঠাতে বলে টর্চার সেলের সদস্যরা। জোর করে নেয় পরিবারের সদস্যদের নম্বরও। কিন্তু পরিবারের কাছে টাকা না চাওয়ায় দেয়া হয় ইলেকট্রিক শক। চুলের মুঠি ধরে দেয়ালে আঘাত করা হয়। এভাবে টর্চার সেলের ৩ জন নির্যাতন করতে থাকে প্রতিদিন। এরই মধ্যে চক্রের সদস্যরা নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে পরিবারকে দ্রুত টাকা পাঠাতে বলে। না হলে বিক্রি করে দেয়ার হুমকি দিতে থাকে। যাদের বিক্রি করে দেয়া হয়, তাদের জোর করে ধরে নিয়ে যায় অন্য একটি চক্রের সদস্যরা। অনেকের কপালে কী জোটে সেটি হয়তো জানে না কেউ।
রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে লিবিয়া ফেরত শফিউলের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। টর্চার সেলের নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন। শুধু শফিউল নন, লিবিয়া হয়ে অবৈধভাবে ইতালিগামীদের সবার কপালেই জোটে টর্চার সেলের ভয়ঙ্কর নির্যাতন। বিক্রি হওয়ার পরে অনেককে চিরকালের জন্য দাসত্ব বরণ করে নিতে হয়। শফিউলকেও বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল ১০ লাখ টাকায়। কিন্তু তাকে হস্তান্তরের আগেই মানবপাচারকারী চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে শফিউলকে দেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- বাদশা ও তার চাচাতো ভাই রাজিব মোল্লা। গত শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে ডিবির মোহাম্মদপুর জোনাল টিম। ডিবি বলছে, গ্রেপ্তার বাদশার বোন জামাই সুলতান এই চক্রের মূল হোতা। ৯ বছর ধরে তিনি লিবিয়ায় অবস্থান করছেন। তাদের এই শালা-দুলাভাই চক্র ৫ শতাধিক লোককে লিবিয়ায় পাচার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই টাকা দিয়ে আলিশান বাড়ি ও বিলাসবহুল গাড়িও কিনেছেন তারা।
পাচারের শিকার পিরোজপুরের নাজিরপুরের বাসিন্দা শফিউল ভোরের কাগজকে বলেন, ৬ বছর সৌদি আরবে ছিলাম। সেখানকার এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারি মাদারীপুরের বাদশার মাধ্যমে ইতালি যাওয়া যায়। পরে গত ২৪ মে দেশে ফিরে বাদশার সঙ্গে দেখা করে ১৩ লাখ টাকায় দুবাই সিরিয়া ও লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার চুক্তি হয়। ৭ লাখ টাকা অগ্রিম নেয়। তাদের কথা মোতাবেক ৪ অক্টোবর দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হই। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কুমিল্লা-বিক্রমপুর-চট্টগ্রাম থেকে আসা আরো ৬ জনের সঙ্গে দেখা হয়। সবাই বাদশা ও রাজীবের মাধ্যমে ইতালি যাচ্ছিল। দুবাইয়ে ১১ দিন রাখা হয়। সেখান থেকে আমাদের ২০ জনকে বিমানে সিরিয়ায় নেয়া হয়। সিরিয়ায় এই চক্রের পাঠানো মোট ৪২ জন মিলিত হই। এরপর থেকে আর আমাদের খাবার দেয়া হয়নি।
ওয়াশরুমের ট্যাপের পানি খেয়ে বিমানবন্দরে ৩ দিন কাটিয়েছি। পরে আমাদের লিবিয়ার বেনগাজি নিয়ে ২ ঘণ্টা রাখার পর মিসরাতের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে আর কেউ যেন নিজের জীবন ও পরিবারকে বেকায়দায় না ফেলেন- সেই অনুরোধ করেন শফিউল। স্বামীকে জীবিত ফেরত পাওয়ার আনন্দে পাশেই চোখের জল ফেলতে থাকা শফিউলের স্ত্রী সুমনা আক্তার বলেন, আমার স্বামী ফেরত এসেছে। কিন্তু অনেকে সবকিছু বিক্রি করে টাকা পাঠানোর পরেও স্বজনের ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছে। আর কেউ যেন এমন ফাঁদে পা না দেয়।
ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিবির প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর-রশিদ বলেন, আন্তঃদেশীয় সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের সদস্য বাদশা ও রাজিব দেশের বেকার যুবক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ইতালি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় পাচার করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া ডিবির মোহাম্মদপুর জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. আনিচ উদ্দীন ভোরের কাগজকে বলেন, গত ২৭ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী থানায় মানবপাচার আইনে দায়ের হওয়া একটি মামলার সূত্র ধরে দুজনকে গ্রেপ্তার ও ভিকটিমকে ফেরত আনা হয়েছে। এ চক্রের মাধ্যমে পাচার হওয়া আরো ১৯ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে কাজ করছে ডিবি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়