প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশে এসএসসি, এইচএসসি, পাবলিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষা সব মহলেরই জানা ও আলোচনার বিষয়। লাখ লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় বসে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষাতেও এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের বসতে হয়। নানা ধরনের সরকারি চাকরিতে এখন নিয়োগ পরীক্ষার বিধান রয়েছে। এমনকি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েই কর্তৃপক্ষ এই পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মুদ্রণ এবং পরীক্ষার দিন সরবরাহের ব্যবস্থা করে থাকে। কিন্তু প্রায় বছরই কোনো না কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটে। সব মহল থেকে বলা হয়ে থাকে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণে নিñিদ্র ব্যবস্থা করা থাকে। তারপরও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা যেন কোনো পরীক্ষারই পিছু ছাড়ছে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং সেন্টার পরীক্ষার সময় বন্ধ রাখে। তাতেও ফাঁসের ঘটনার ইতি টানা যায়নি। এবার দিনাজপুর বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষার কয়েকটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে কেন্দ্র সচিব, শিক্ষক জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বিমান বাংলাদেশে জুনিয়র পর্যায়ের মাত্র ১০টি পদে নিয়োগ পরীক্ষা নিতে গিয়েও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে বিমান বাংলাদেশে কর্মরত কয়েকজন জড়িত থাকার অভিযোগে আটক হয়েছেন। লাখ লাখ টাকার অর্থের বিনিময়ে ওইসব কর্মকর্তারা শুধু এবারেই নয় আগেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা হাতেনাতে ধরা পড়লে জানাজানি হয়। আবার অজানাও থেকে যায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের গোপনে চলে আসা দীর্ঘদিনের এক বিস্ময়কর ‘চর্চা’! আমরা কজনই বা জানি অজানা সেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের রহস্য কাহিনী? শুধু যে কটা ঘটনা হাতেনাতে ধরা পড়ে সেগুলো নিয়ে তদন্ত কমিটির দৌড়ঝাঁপ, প্রতিবেদন আর ধৃতদের নামধাম নিয়ে চলে আলোচনা, সমালোচনা। কিন্তু এর চেয়ে ভয়াবহ ফন্দিফিকিরের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং পরীক্ষার্থীদের ‘সহযোগিতার’ হাত বাড়িয়ে দেয়ার নামে যা ঘটে তা এক ভিন্ন অপকৌশল। সেটির সঙ্গেও অনেকেই যুক্ত থাকেন। অনেক স্বার্থ এর সঙ্গে গোপনে যুক্ত হয়ে আছে। সে সম্পর্কে আমরা বাইরে খুব কমই জানি।
পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যারা প্রণয়ন করেন কিংবা যাদের প্রণয়নের জন্য শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে নিযুক্ত করা হয়- তাদের বিষয়ে কজনইবা বা খোঁজ-খবর রাখেন? অভিযোগ আছে গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখেন। কোন কোন শিক্ষক প্রশ্ন প্রণয়ন এবং মডারেশনের দায়িত্ব পালন করবেন তাদের নাম আর কেউ না জানলেও গাইড বইয়ের ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তারা জানতে পারেন। কোন গাইডবই থেকে কতটা প্রশ্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ও মডারেটাররা বাছাই করবেন সেটি যদি রক্ষিত হয় তাহলে গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যারা যুক্ত থাকেন তাদের ‘খুশি’ করার একটি গোপন ব্যবস্থা চলে আসছে বলে শোনা যায়। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং মডারেশনের ক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের প্রশ্নের চাইতে গাইড বইয়ের প্রশ্নের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার ‘সুফল’ ভোগ করেন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা, প্রশ্নপ্রণেতা, মডারেটর এবং গাইড বই ব্যবসায়ীরা। বলা হয়ে থাকে প্রতিটি বিষয়ে একাধিক প্রশ্নপ্রণেতা ও মডারেটর থাকেন। ফলে বাইরে ধারণা দেয়া হয় যে কার কোন প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবে সেটি প্রণেতা ও মডারেটরদেরও জানার সুযোগ নেই। কিন্তু‘ বাস্তবে এই সরল বিশ্বাসের ওপর আস্থা স্থাপনের ব্যত্যয় অনেক আগেই ঘটে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকার গাইড বই ব্যবসা তো আর এমনি এমনি চলে না। যত শিক্ষা বোর্ড, তত আলাদা প্রশ্নপত্র, তত প্রশাসনিক আলাদা ব্যবস্থা। ফলে অনেক ব্যক্তি, শিক্ষক, কর্মকর্তা এমনকি সহকারীও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। সে কারণে প্রশ্নপত্রে নিñিদ্র নিরাপত্তা বিধান করা মোটেও সহজ কাজ নয়, এটি সবারই বোধগোম্য। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও চূড়ান্তকরণেই নানা ধরনের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক কিছু বের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ প্রশ্নপত্রের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অনেকেই। অনেকেরই ভাগ্যের চাকা সামান্যতেই ঘুরে যেতে পারে।
পরীক্ষাকেন্দ্রে বাহ্যত পরীক্ষা হয় খুবই শান্ত পরিবেশে। তবে যেসব শিক্ষক কোচিং সেন্টার কিংবা ব্যাচে শিক্ষার্থীদের পড়ান তারা শিক্ষার্থীদের ‘সহযোগিতার’ নামে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও নজর রাখেন। দৃশ্যত এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার্থী অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিলেও উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এখন আর খুব বেশি গোপনীয় ব্যাপার নয়। আবার ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকও শিক্ষার্থীদের প্রতি ‘সুদৃষ্টি’ দেয়ার জন্য প্রতিবেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রে ছুটে যান। মূলত নিজের শিক্ষার্থীদের দেখভাল করার দায়িত্বটা এভাবেই এক শ্রেণির শিক্ষক করে থাকেন। বিশেষত নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়ার দায়িত্ব অনেকটা শিক্ষকরাই নিয়ে থাকেন। প্রশ্ন হতে পারে এটি শিক্ষকরা কেন করেন? উত্তরে শুধু একটা কথাই বলার আছে তা হচ্ছে পরের বছরের ব্যাচটা নিশ্চিত করার জন্য। যে শিক্ষক নিজের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সময় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন সেই শিক্ষকের কপালে ভাগ্যল²ীর ছাপ ভালো পড়ে। এ কারণেই এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক সেটি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় খুব একটা প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা যে আনন্দ প্রকাশ করেন তা শেষ পর্যন্ত অনেকের ক্ষেত্রেই স্থায়ী হয় না। অনেক শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবক পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে যে আতঙ্কে থাকেন- সেটি আসলে এক ধরনের অদৃশ্য শক্তির আতঙ্ক। পাবলিক পরীক্ষাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ পরীক্ষা থেকে আলাদা করে দেখার বিষয়টি অনেকটাই প্রচার-প্রচারণা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কল্পিত সৃষ্টির চেষ্টামাত্র। যেসব শিক্ষার্থী নিয়মিত লেখাপড়া করে থাকে তাদের পরীক্ষা ভীতি থাকার কোনো কারণ নেই। পাঠ্যপুস্তক থেকে যা পড়ানো হয়ে থাকে বা পড়ানোর কথা তার বাইরে কিছুই পরীক্ষায় থাকার কথা নয়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বইয়েরই কোনো না কোনো অংশ থেকে প্রশ্ন করা হয়। এমনকি গাইড বই থেকে প্রশ্ন নেয়া হলেও সেগুলোও পাঠ্যবইয়ের নির্ধারিত সিলেবাসের বাইরের কিছু নয়। সুতরাং পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে যে ভীতিটা দেশে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে সেটা একেবারে অবাস্তব ও কাল্পনিক। কিন্তু বাস্তবে যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নে সব মানের পরীক্ষার্থীর কথা বিবেচনায় রেখেই প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। মূলত প্রশ্নপ্রণেতারা মধ্য মানের শিক্ষার্থীদের অবস্থানকেই বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। সুতরাং পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে ভীত হওয়ার বা আতঙ্কিত হওয়ার যথার্থ কোনো কারণ নেই। কিন্তু‘ আমাদের অভিভাবকদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে নিজেরাই বেশি আতঙ্কিত থাকেন। এর জন্য তারা অর্থকড়ি ব্যয় করতেও কার্পণ্য করেন না। সারা বছর কোচিং কিংবা ব্যাচে বাড়তি অর্থ খরচ করে সন্তানদের পড়ানোর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে সন্তানটি যেন পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল করে অভিভাবকের মুখ উজ্জ্বল করে। আবার কিছু কিছু অভিভাবক আছেন যারা সন্তানের ভালো ফল দেখার প্রত্যাশায় ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের পেছনে ছোটেন কিংবা অর্থ ব্যয় করেন। এটিও প্রশ্নপত্র ফাঁসের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন তারা চড়া মূল্যেই সেটি বিক্রি করেন। এই মানসিকতা থেকে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিভাবক মুক্ত হতে পারছেন না। অথচ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই শ্রেণিপাঠ ও বাড়ির লেখাপড়া স্বাভাবিক নিয়মে পরিচালিত হলে একজন শিক্ষার্থীর পিছিয়ে পড়ার কোনো কারণ থাকে না, পরীক্ষাভীতিও ঘটার কারণ থাকে না। নিয়মিত লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী নিজের মেধা, দক্ষতা এবং যোগ্যতা তৈরি করার মাধ্যমে পরীক্ষাসহ যে কোনো যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যম সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরে মানের সংকট বিরাজ করায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মেধা ও যোগ্যতার বিকাশে প্রত্যাশিত মানে উন্নীত হতে পারে না। সে কারণেই শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধাদ্ব›দ্ব ও অনিশ্চয়তা কাটে না। পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে তারা থাকেন অতিমাত্রায় আতঙ্কিত। সে কারণে প্রয়োজন হচ্ছে নিচের শ্রেণি থেকে ওপর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পাঠদান, মূল্যায়ন এবং উন্নীত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সেটি করা সম্ভব হলে পাবলিক পরীক্ষার প্রয়োজন পড়বে না। উন্নত দুনিয়ায় এজন্য এখন আর পাবলিক পরীক্ষা নেই। আমাদের পাবলিক পরীক্ষা এখন যেন এক ঢাল-তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি করে রেখেছে। পাবলিক পরীক্ষায় যে ফলাফল শিক্ষার্থীরা করেন তাতে অধিকাংশেরই নানারকম ঘাটতি থাকে। এ কারণেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এসএসসি এবং এইচএসসির জিপিএ সর্বোচ্চ নিয়েও ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। চাকরির বাজারেও এখন যেহেতু নিয়োগ পরীক্ষা দিতে হয় তাই সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার সঙ্গে অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ওঁৎ পেতে থেকে। বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা থেকেই তারা এ কাজ করে থাকে। আবার চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যেও যে কোনো মূল্যে চাকরি পাওয়ার জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবরে তারা ভীষণভাবে তা পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের পেছনে ছুটছে অনেকেই। এর পেছনে থাকে মোটা অঙ্কের অর্থলাভ করা, আবার অনেকের থাকে যে কোনো উপায়ে একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এসব নিয়েই আমাদের পরীক্ষা কিংবা নিয়োগ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ইতিবৃত্ত।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।