মিরপুর শপিং সেন্টারে এসি বিস্ফোরণে আহত ২

আগের সংবাদ

নির্বাচন ঘিরে জাপায় অস্থিরতা : নিকট অতীতে নেতিবাচক অবস্থান জানালেও হঠাৎ করেই সংবিধান মেনে ৩০০ আসনে নির্বাচন করার ঘোষণা

পরের সংবাদ

কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ নিয়ে প্রশ্ন : কোড অব কন্ডাক্ট মানছেন না কূটনীতিকরা, কূটনৈতিক ‘শালীনতা’ যেন লঙ্ঘন না হয়

প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব নির্বাচন বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে সবসময়ই উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকরা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিজেদের আশাবাদের কথা ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি এসব লক্ষ্য অর্জনে নানান পরামর্শও দিয়ে থাকেন তারা। সব সরকারের আমলেই চাপে থাকা বিরোধী দলগুলো সেসব বক্তব্য-পরামর্শকে স্বাগত জানায়। অন্যদিকে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়া নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তোলে ক্ষমতাসীনরা। তবে এবার জাতীয় নির্বাচনের প্রায় বছর দেড়েক আগে থেকেই বিদেশি কূটনীতিকদের জাতীয় রাজনীতি, গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য নানামহলে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ মানছেন না কূটনীতিকরা। আর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে কূটনীতিক শিষ্টাচার পালনের আহ্বান জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১’-এর কারণে কোনো দেশের কূটনীতিকরা যদি ‘শিষ্টাচার’ বহির্ভূত কোনো কাজ করে থাকেন, তবে এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। অবশ্য কোনো কূটনীতিক শিষ্টাচার বহির্ভূতকাজে জড়িয়ে পড়লে তাকে বহিষ্কার করা বা প্রত্যাহার করার জন্য আহ্বান করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রদূতদের যথেষ্ট সম্মান করা হয়। বাংলাদেশের মতো এত আদর-যতœ কেউ করে না। সেটা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু আতিথেয়তা মানে এই নয়, কেউ এটির সুযোগ নিয়ে বাড়াবাড়ি আচরণ করবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপের প্রবণতা দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে পশ্চিমারা এটি করে থাকে। কূটনীতিকদের রাজনৈতিকভাবে যুক্ত হয়ে যাওয়া, আবার হস্তক্ষেপ করা- এসব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু

এসব প্রবণতা সব দেশে আমরা দেখি না। আমাদের দেশের চেয়ে অনেক দেশেই গণতন্ত্র অনেক বেশি চ্যালেঞ্জে রয়েছে, রাজনৈতিক সংকট রয়েছে- সেসব দেশে দাতা দেশগুলো এ ধরনের ভূমিকা পালন করে না বা কথা বলার সাহস পায় না। আবার অনেক সময় বিরোধী দল ক্ষমতায় আসার জন্য বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়, এটিও ভালো লক্ষণ নয়।
ভোটের আগে দৌড়ঝাঁপ : দেড় বছরের মতো বাকি নির্বাচনের। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছে ইসি। সাড়া দেয়নি বিএনপি। নির্বাচন নিয়ে সরব হয়েছেন বিদেশিরাও। বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ছাড়াও সাতাশ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত। তাদের অবস্থান স্পষ্ট; অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান পশ্চিমারা। বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে নয়। বাংলাদেশে অন্তর্ভূক্তিমূলক, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়, এটি সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের। সহিংস রাজনৈতিক অবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয় এবং আগামী নির্বাচনে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় মনিটরিং করবে। গত সোমবার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হোমসের মন্দিরে দুর্গাপূজা পরিদর্শনে গিয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ব্রিটেন। চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগমুক্ত নয় তারা। তবে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে কোনো ধরনের সহিংসতা নয়; বরং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখতে চান তারা। ডিকসন বলেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা রাস্তাঘাটে রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটেছে। আমরা সংঘর্ষ নয়, শান্তি দেখতে চাই।
যদিও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে না ভারত, তবে বাংলাদেশে কোনো ধরনের অস্থিরতা দেখতে চায় না প্রতিবেশী দেশটি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সাভার জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো শেষে সাংবাদিকদের বিদায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে চায় ভারত সরকার। তিনি বলেন, এদেশের নির্বাচন নিয়ে নাক গলাবে না নয়াদিল্লি। বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে ভারতে তার প্রভাব পড়ে। নিজেদের স্বার্থেই স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় তারা।
‘কোড অব কন্ডাক্ট’ মানছেন না কূটনীতিকরা : ২০২০ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ ছিল চোখে পড়ার মতো। ওই বছরের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তÍর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কূটনীতিকদের ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ মেনে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। আর তা না হলে বিদেশি কূটনীতিকদের বাংলাদেশ ছাড়ার হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, দুঃখের বিষয় এখানে কিছু বিদেশি মিশন আমাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করছে। নিজ নিজ দায়িত্বের বাইরে অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। ডিপ্লোম্যাটরা ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ মেনে কাজ করবেন। আর যারা মানবেন না, তাদের বলবো- দেশ থেকে চলে যান।
কূটনীতিকরা নির্বাচন প্রভাবিত করার মতো কথা বলবেন না- মন্তব্য করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ডিপ্লোম্যাটরা অত্যন্ত প্রশিক্ষিত। নির্বাচন নিয়ে প্রভাবিত করার মতো কোনো কথা কখনো বলেননি এবং বলবেনও না। আমাদের সঙ্গে অন্তত বলবেন না।
অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, কূটনীতিকদের ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ যেটা বলা হচ্ছে, কূটনৈতিক যে নিয়মকানুন আছে, বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্য আছে, তা অনেক সময় মেনে চলা হয় না। ভিয়েনা কনভেশন অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয় না। এতে ডিপ্লোমেটিক আচরণে সার্বিকভাবে ব্যত্যয় ঘটে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, কূটনীতিকরা পরামর্শ দিতে পারেন, ছবক নয়। কূটনীতিকদের মধ্যে কূটনৈতিক আচরণ থাকবে, শিষ্টাচার থাকবে। গণতন্ত্র নিয়ে ভিন্ন মত থাকবে তবে তারা তাদের অভিমত চাপিয়ে দিতে পারেন না। হস্তক্ষেপ নিন্দনীয়। কূটনীতিকদের ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ নিয়ে ভিয়েনা কনভেনশনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
কূটনৈতিক ‘শালীনতা’ যেন লঙ্ঘন না হয় : ক্ষমতাসীনরা বলছেন, বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা অবশ্যই আমাদের নির্বাচন নিয়ে পরামর্শ দিতে পারেন, সেটি যেন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মতো না হয়। কূটনৈতিক শালীনতা যেন লঙ্ঘন না হয়। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য যারা রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতরাও নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। আমরাও স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন চাই। স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক শুধুমাত্র সরকারি দলের দায়িত্ব নয়; সব দলের দায়িত্ব। বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নির্বাচন নিয়ে পরামর্শ দিতে পারেন, সেটি যেন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মতো না হয়। একই সঙ্গে কূটনৈতিক শালীনতাও যেন লঙ্ঘন না হয়।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ শফিউল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নানা অজুহাতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের শরণাপন্ন হয়। নিজেরাই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকদের কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। রাষ্ট্রদূতরা তাদের দেশের কথা বলবে। তাদের নীতির কথা বলবে। প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, হাই অফিসিয়িালসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলবে। কারণ এসব বিষয় তাদের দেশে জানাতে হয়। কূটনীতিকরা যে রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন, এটি নিয়েও বিভিন্ন মহলে কথা হচ্ছে। সব বিষয়ে মনিটরিং করে নিজ দেশে জানানোই তাদের কাজ। কিন্তু তারা হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সীমারেখা কতটুকু এটি দেখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, তবে এর কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। প্রতিটি সরকার চায় দেশে বাইরের বিনিয়োগ আসুক। বিদেশি বিনোয়োগ আসার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা রয়েছে। সংঘাতপূর্ণ দেশে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। মূলত এসব কারণেই কূটনীতিকরা কথা বলে। সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুস্থ রাজনীতি থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে, এটিই স্বাভাবিক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়