সিনহার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য পেছাল

আগের সংবাদ

জাতীয় গ্রিড আধুনিকায়নে এবার গুরুত্ব দিন

পরের সংবাদ

রাষ্ট্রের মুখচ্ছবি

প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাষ্ট্র এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি নৃশংস হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশের রাষ্ট্র ছিল উপনিবেশিক, শাসকরা রাষ্ট্রশাসনের বেশ শক্ত একটা কাঠামো তৈরি করে নিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে যারা শাসন ক্ষমতায় এসেছে তারা রাষ্ট্রের ওই কাঠামো এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা ও আইনকানুন বদলায়নি, বরং নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রকে আরো অধিক নিপীড়নকারীতে পরিণত করেছে। এই শাসনকর্তারা পুঁজিবাদী এবং পুঁজিবাদ এখন ভেঙে পড়ার দশায় পৌঁছেছে। পুঁজিবাদী শাসকরা এখন আর কোনো প্রকার ছাড় দিতে ভরসা পায় না, নিজেদের রক্ষা করতে তারা প্রতিবাদীদের কণ্ঠরোধ করে; মেরেও ফেলে।
পুঁজিবাদের সংকটটা এখন বিশ্বব্যাপী। আত্মরক্ষার স্বার্থে আগে সে ছাড় দিত; বিশেষ করে এজন্য যে প্রতিদ্ব›দ্বী সমাজতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা ছিল। এখন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসটা আর নেই; এখন তাই ছাড় দেয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু পুঁজিবাদের ভেতরের দ্ব›দ্বটা এখন প্রচণ্ড আকার ধারণ করছে। ধনীরা অবিরাম ধনী হচ্ছে, গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে। ফলে অসন্তোষ তীব্র হচ্ছে। বিরুদ্ধ মতকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রের কর্তা ও সুবিধাভোগীরা ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিবাদীরা যা করে এরাও ঠিক সেটাই করছে। পুঁজিবাদের মরণ কামড়ে মানুষ, প্রকৃতি, জীবজন্তু, মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবকিছুই এখন বিপন্ন দশায়। মানুষ তাই আগের চেয়ে অধিক বিপদে আছে। বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটা কঠিন ঠিকই, কিন্তু অসম্ভব নয়। মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা ও পরস্পরের শত্রæ বানানো পুঁজিবাদের স্বভাবের ভেতরই রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম, যার মধ্য দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়, চেষ্টা চলে মানুষ যাতে প্রধান শত্রæকে অর্থাৎ পুঁজিবাদকে চিনতে না পেরে ছোট ছোট শত্রæর মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকে। বুদ্ধিজীবীরাও বিভ্রান্ত হন এবং বিভ্রান্ত করেন। যেমন তথাকথিত উত্তর-আধুনিকতাবাদীরা করছেন। এরা বলতে চান যে ক্ষমতার দ্ব›দ্ব সর্বত্র চলছে, তাই সব ক্ষেত্রেই ক্ষমতার লড়াইটা চালানো চাই। এর ফলে আসল যে শত্রæ তার বিরুদ্ধে লড়াইটা দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিধি অবশ্যই সত্য, তাই বলে কেন্দ্র যে অসত্য তা তো নয়, কেন্দ্র আছে বলেই তো পরিধি রয়েছে। ক্ষমতার বিক্ষিপ্ত প্রকাশগুলোর বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়তে হবে, কিন্তু কিছুতেই ভুললে চলবে না যে ক্ষমতার একটা কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে। পরিধি থেকে তাই যেতে হবে কেন্দ্রের দিকেই, নইলে কেন্দ্র তার অপতৎপরতা থামাবে না। কেন্দ্রই হওয়া চাই আক্রমণের প্রকৃত লক্ষ্য। সমস্যাটা বুদ্ধিবৃত্তিক, কিন্তু ভেতরে কাজ করছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা; মানুষকে সে ছত্রভঙ্গ করে দিতে চায়, মানুষের চিন্তাকে করতে চায় বিভ্রান্ত।
ধর্ম ইতিহাসের বাইরে নয়। ধর্মমত যারা প্রচার করেছেন ইতিহাস বদলানোর জন্য তাদের ইতিহাসের ভেতরেই থাকতে হয়েছে। আদি যুগে মাতৃতান্ত্রিকতা ছিল; কিন্তু যখন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা এসেছে তখন থেকেই নতুন এক ইতিহাসের যাত্রা শুরু; আর সে ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিকতা। সম্পত্তি তৈরি ও রক্ষার দায়িত্ব পিতারই, মাতার নয়। ওই পিতৃতান্ত্রিকতা তাই ধর্মমতের ভেতরে অনুপ্রবেশ করেছে। নতুন ধর্মের আগমন অনেক নতুন কাজ করেছে, মানুষের চিন্তায় ও ধারণায় পরিবর্তন ঘটিয়েছে; কিন্তু আগের ধর্মের মতোই নতুন ধর্মও পিতৃতান্ত্রিকতার অবসান ঘটায়নি। নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দিতে চেয়েও দিতে পারেনি। ইতিহাসের বাস্তবতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মও তো একটা মতাদর্শই এবং কোনো মতাদর্শই ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারে না। আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা অত্যন্ত বাস্তবিক একটি ঘটনা ও সমস্যা। যুগের পর যুগ ধরে সাধারণ মানুষ, এমনকি সুবিধাভোগীরাও পরস্পরের পাশাপাশি থেকেছে, একই ভূমিতে, একই আকাশের নিচে। তাদের ধর্ম এক ছিল না, কিন্তু ধর্ম নিয়ে মারামারি কাটাকাটি ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা জিটিসটা ব্রিটিশের শাসনামলে এবং তাদের প্ররোচণায় ও প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ এতে জড়িত হয়ে পড়েছে, তাদের ওপর এটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। মূল ঘটনাটা ছিল দুই সম্প্রদায়ের সুবিধাভোগী ও সুবিধাপ্রাপ্তিতে আগ্রহীদের মধ্যে বৈষয়িক বিষয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতার। প্রচারণার ব্যাপারটাও ছিল খুবই কার্যকর। মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে তোলার ব্যাপারটা আসলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। ওই দুই স্বার্থেই ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে অর্থনৈতিক লাভ- লোকসানের হিসাব জড়িত; জড়িত রাজনৈতিক সুবিধা লাভের আশা। আমাদের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে যে রাষ্ট্র জড়িত থাকে সাম্প্রদায়িকতা তৈরির সঙ্গে। রাষ্ট্র-ক্ষমতায় যারা আসীন থাকে তারা জনগণকে বিভক্ত করে রাখতে চায়। চায় সংঘর্ষ বাধাতে এবং জনগণের যেসব ইহজাগতিক বঞ্চনা, সামাজিক ও রাজনৈতিক যেসব সমস্যা সেগুলো থেকে চোখ অন্যত্র ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য ধর্ম হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের ব্যাপার। বিশ্বাসকে রক্ষা করার জন্য মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকে, প্রাণ অনেক সময় দেয়ও। বিশ্বাস হয়ে ওঠে সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
ধর্মরক্ষার উন্মাদনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথাটা হলো ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। ব্যক্তির পক্ষে ধর্মচর্চার স্বাধীনতা থাকবে, রাষ্ট্র তাতে হস্তক্ষেপ করবে না, রাষ্ট্র আবার বিশেষ কোনো ধর্মাবলম্বীদের প্রতি পক্ষপাত বা বিদ্বেষ কোনোটাই প্রদর্শন করবে না। শেষ বিচারে সমস্যাটা রাজনৈতিকই। সমাধানের জন্য রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করা চাই। আর গণতান্ত্রিককরণের পয়েলা নম্বর শর্তই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ওই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রস্তুতি যেটা আবশ্যক সেটার চরিত্র হলো সাংস্কৃতিক। শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, সবকিছুর ভেতর দিয়ে চর্চা দরকার ইহজাগতিকতার এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের বিচ্ছিন্নকরণের। ইহজাগতিকতার ব্যাপারটা মতাদর্শিক এবং ধর্মনিরপেক্ষতারই অংশ। প্রশ্ন থাকে এই কাজে কারা উদ্যোগ নেবেন? উদ্যোগ নেবেন যারা হৃদয়বান ও বুদ্ধিমান। যারা হৃদয় দিয়ে বোঝেন যে বিভেদ ও সংঘর্ষে লাভ নেই, ক্ষতিই আছে এবং বুদ্ধি দিয়ে বোঝেন যে ধর্মবিশ্বাস ব্যক্তিগত ব্যাপার, বোঝেন যে একের বিশ্বাস অপরের ওপরে চাপিয়ে দেয়াটা মোটেই মানবিক কাজ নয়।
ধর্মীয় গোঁড়ামি কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জনগণকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব নিতে বামপন্থিদেরই এগিয়ে আসা উচিত সবার আগে। বস্তুত সমাজে তারাই সবচেয়ে হৃদয়বান ও বুদ্ধিমান। বামপন্থিদের লড়াইটা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পুঁজিবাদ তো অশরীরী কোনো বস্তু নয়। তার বিভিন্ন প্রকাশ ও শাখা-প্রশাখা আছে, রয়েছে দুষ্টবুদ্ধি ও অপতৎপরতা; সাম্প্রদায়িকতা তৈরি মূলত পুঁজিবাদীদেরই দুষ্ট কাজ। পুঁজিবাদীরা ধার্মিকের আচ্ছাদন নেয়, কিন্তু স্বভাবচরিত্রে তারা মোটেই ধার্মিক নয়, পুরোমাত্রায় বস্তুগত স্বার্থবাদী। কাজেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম সেটা পুঁজিবাদবিরোধিতারই অংশ এবং সেটা কোনোভাবেই পুঁজিবাদকে বাদ দিয়ে নয়; এ যুগে পুঁজিবাদই হচ্ছে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের মূল হোতা। তাকে পরাভূত করতে পারলে অন্যান্য সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাও বিদায় হবে। পুঁজিবাদ থাকলে উৎপাতগুলোও থাকবেই। পুঁজিবাদ এখন তার অস্তিত্বের শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছে, তাই সে বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, নারী-পুরুষের ব্যবধান, স্থানীয়-অভিবাসী বিরোধ এসবকে ব্যবহার করে মানুষকে আত্মঘাতী সংঘর্ষের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
হ্যাঁ, ধর্মনিরপেক্ষতার সাংস্কৃতিক চর্চার আবশ্যকতা বামপন্থিদের জন্য অবশ্যমান্য বটে; কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে গণতন্ত্রই থাকে না, সমাজতন্ত্র তো আরো দূরের ব্যাপার। তবে এ কাজ করতে গিয়ে বামপন্থিদের আবার সতর্কও থাকতে হয়। কারণ ধর্মব্যবসায়ীরা তো অবশ্যই, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষাকামীরাও এটা মহোৎসাহে প্রচার করে থাকে যে, বামপন্থিরা অধার্মিক, তারা ধর্ম মানে না, তারা নাস্তিক। নানা ঐতিহাসিক কারণে এই উপমহাদেশে নাস্তিকতাকে একটি অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে। নাস্তিক বলে কথিতরা কেবল অপরাধী নয়, তারা শত্রæ বলেও চিহ্নিত হয়ে থাকে; বলা হয় তারা ধর্মের শত্রæ, আর ধর্মের শত্রæ মানে তো ধর্মবিশ্বাসীরই শত্রæ। ধর্মের শত্রæ বলে চিহ্নিত করতে পারলে বামপন্থিদের ঘায়েল করার কাজে সুবিধা হয়। অথচ বামপন্থিরা হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র; তারা মানুষের ইহজাগতিক সমস্যাগুলোর সমাধান চায়, চায় মানুষের মানবিক অধিকার ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠা; আস্তিকতা-নাস্তিকতার প্রশ্ন সেখানে একেবারেই গুরুত্বহীন। যেজন্য তারা মানুষের নিকৃষ্টতম শত্রæতে পরিণত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিবেদিত।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়