সিনহার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য পেছাল

আগের সংবাদ

জাতীয় গ্রিড আধুনিকায়নে এবার গুরুত্ব দিন

পরের সংবাদ

পাকস্থলীতে করে যে কৌশলে আসছে ইয়াবার চালান

প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কামরুজ্জামান খান : নানা কায়দায় বহন করা হচ্ছে ইয়াবার চালান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রতিদিন এর চালান ধরা পড়লেও হাতবদল থেমে নেই। কৌশল পাল্টে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে ইয়াবার চালান। সড়ক পথে কড়াকড়ি হওয়ায় আকাশপথ ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ইয়াবা পাচার শুরু হলে তাও ধরা পড়ছে। নাফ নদী পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা তৎপরতার মুখে স্থানান্তর হচ্ছে মানুষের পাকস্থলীর মাধ্যমে। এমন শতাধিক চালান ধরা পড়েছে পুলিশ-র‌্যাবের হাতে। যারা ধরা পড়ছে তারা বলছে, স্কচট্যাপ বা পলিথিনে প্যাঁচিয়ে ইয়াবা ঢোকানো হয় কলার মধ্যে। পরে ওই কলা গিলে ঢাকায় চলে আসে পাচারকারীরা। একটি দুটি নয়, পেটের মধ্যে ঢোকানো হয় তিন থেকে চার হাজার পিস ইয়াবা। কলার রস দিয়ে খেজুরের মতো ছোট ছোট পলিথিনে মোড়ানো ইয়াবার পোটলাগুলো পিচ্ছিল করে তারা গিলে ফেলে। ইয়াবা বেশি সময় ধরে পেটের ভেতরে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তারা এসব বহন করছে।
র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, অপরাধীরা অপরাধ করতে অনেক ধরনের কৌশল করে থাকে। র‌্যাব আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধীদের ধরতে কাজ করে যাচ্ছে। অপরাধীরা যতো কৌশলই করুক না কেন তারা পার পায় না। পাকস্থলীতে করে ইয়াবা আনার যে পথ বা কৌশল তারা বেছে নিয়েছে তাও ধরা পড়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে মাদক কারবারীরা কোনো কিছুতেই সুবিধা করতে পরবে না বলেও তিনি মনে করেন। অপরাধী ধরতে সব কৌশল কৌশলগত কারণে প্রকাশ করা যায় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পুলিশ হেডকোয়াটার্সের ডিআইজি (অপারেশনস) হায়দার আলী খান বলেছেন, মাদক নির্মূলে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। পুলিশ সেই লক্ষ্যে কাজ করছে। নিজস্ব সোর্স ও গোয়েন্দা

তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে। প্রাণঘাতী কৌশল করেও মাদক কারবারীদের পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাকস্থলীতে বহন করেও তারা পার পাচ্ছে না, স্ক্যানারের মাধ্যমে ধরা পড়ছে।
গত ১৬ আগস্ট বিকাল ৫টার দিকে রমনা থানার ইস্কাটন গার্ডেন সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারের ৫ নম্বর গেটের সামনে অভিযান চালিয়ে সিদ্দিক আহমেদকে (৬২) এক হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন আদালতে হাজির করার সময় তার পেট ব্যথা শুরু হলে নেয়া হয় রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে ফের আদালতে পাঠানোর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান তিনি। ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে চিকিৎসক দেখতে পান, তার পেটে কালো পলিথিনে প্যাঁচানো একটি প্যাকেট। সেখানে মেলে ৩৫ পিস ইয়াবা। ফরেনসিক বিভাগ থেকে আলামত হিসেবে ৩০ পিস ইয়াবা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি পাঁচ পিস রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য মহাখালী পাঠানো হয়।
এর আগে অভিনব কায়দায় পাকস্থলীতে করে ইয়াবা বহনের সময় ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার আমতলী বিশ্বরোড এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশিকালে ৯ শিক্ষার্থীকে আটক করে র‌্যাব-১১। ওই সময় ২৩ হাজার ৯৯০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। র‌্যাব-১১ এর কুমিল্লার কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে ৯ শিক্ষার্থীকে আটক করে র‌্যাব। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে এক্সরে করলে ওই ৯ শিক্ষার্থীর পেটের ভেতর অস্বাভাবিক বস্তু ধরা পড়ে। পরবর্তীতে চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ পদ্ধতিতে ওই শিক্ষার্থীদের পেটের ভেতর থেকে ২৩ হাজার ৯৯০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। আটকরা হলেন- কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানার চরপাড়াতলা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তোফায়েল আহমেদ (১৯), দত্তের বাজার গ্রামের আজিজুল ইসলামের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম রিফাত (২২), চরফরদী গ্রামের মাজহারুল ইসলামের ছেলে সদ্য এইচএসসি পাস করা আশিকুল ইসলাম (১৯), পটুয়াখালীর সদর থানার পশুরবুনিয়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদের ছেলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহেল (২১), নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার পিজাহাতি গ্রামের কামরুল হাসানের ছেলে ডিগ্রি পরীক্ষার্থী মিতুল হাসান মাহফুজ (২২), গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার আমবাগ গ্রামের মৃত মাছুদ ইসলামের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী সিয়াম ইসলাম (১৯), ময়মনসিংহের পাগলা থানার বাকশি গ্রামের ফখরুদ্দিন পাঠানের ছেলে ডিগ্রি পরীক্ষার্থী রিশাত পাঠান (২২), একই গ্রামের রতন মিয়ার ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী মো. সেলিম (২২) ও নয়াবাড়ি গ্রামের আসাদ মিয়ার ছেলে ডিগ্রি পরীক্ষার্থী মো. গোলাপ (২২)।
র‌্যাব জানায়, ময়মনসিংহের এক মাদক ব্যবসায়ী এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই টেকনাফ থেকে ইয়াবা বহন করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করতেন। তার গ্রুপের কয়েকজন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হয়। পরবর্তীতে তিনি এলাকার তরুণদের টার্গেট করেন। প্রথমে তিনি সেলিমকে ম্যানেজ করার পর সেলিমের মাধ্যমে রিফাত, গোলাপ, রিশাদ, তোফায়েল ও আশিককে এ কাজে আসতে বাধ্য করেন। ওই মাদক ব্যবসায়ীর মহাখালীর বন্ধুর মাধ্যমে প্রথমে সোহেলকে এবং সোহেলের মাধ্যমে মিতুল ও সিয়ামকে মাদক পরিবহনের কাজে সম্পৃক্ত করা হয়। গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রথম পেটের ভেতরে করে ইয়াবা বহন করে সফলভাবে তা ডেলিভারি দিতে সক্ষম হয় তারা। তবে তাদের প্রতিশ্রæত টাকা না দিয়ে অর্ধেক টাকা ট্যাক্স হিসেবে রেখে দেন মাদক ব্যবসায়ীরা। ফলে এই তরুণরা তাদের কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পূর্বের কাজের ধারণকৃত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে পুনরায় এই কাজ করতে তাদের বাধ্য করা হয়। ইয়াবা পেটে বহন করার প্রক্রিয়া হিসেবে প্রথমে কলার রস দিয়ে খেজুরের মতো ছোট ছোট পলিথিনে মোড়ানো ইয়াবার পোটলাগুলো পিচ্ছিল করে তারা গিলে ফেলে। এরপর নাইট কোচে তারা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। পথে সার্বক্ষণিক মাদক কারবারিরা তাদের নির্দেশনা দিতে থাকেন। মাদক কারবারীদের নির্দেশনা অনুযায়ী ইয়াবাগুলো কখনো নরসিংদী, কখনো আশুলিয়া আবার কখনো মহাখালীতে নির্ধারিত স্পটে মাদক কারবারীদের নিকট পৌঁছে দিতে হয়। আটকরা র‌্যাবকে আরো জানান, গত এক বছরে অসংখ্যবার তারা এ প্রক্রিয়ায় টেকনাফ থেকে ঢাকায় ইয়াবা এনেছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় এমন আরো কয়েকটি তরুণ শিক্ষার্থীদের গ্রুপ এ পন্থায় মাদক কারবারীদের নির্দেশনায় ইয়াবা আনা-নেয়া করে।
গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পেটে করে ইয়াবার চালানটি ঢাকায় নিয়ে আসার পর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে হারেজ নামে একজনকে। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এক্সরে করার পর পাকস্থলীতে মেলে ইয়াবার উপস্থিতি। একটি দুটি নয়, ৭৭টি ক্যাপসুল আকৃতির প্যাকেট বের করা হয়, যার প্রতিটিতে ৫০টি করে মোট তিন হাজার ৮৫০টি ইয়াবা পায় তারা। গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ রাজধানীতে আলাদা অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে আরো চার জনকে, যাদের সবার পেটেই পাওয়া যায় ইয়াবা। এ চারজনও টেকনাফ থেকে ঢাকায় পেটের মধ্যে নিয়ে এসেছে ইয়াবার চালান। তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার পিস ইয়াবা বড়ি পাওয়া গেছে একেকজনের পাকস্থলীতে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার রাজীব আল মাসুদ (লালবাগ বিভাগ) বলেছেন, গ্রেপ্তারকৃত চারজনের প্রত্যেকের পেটের ভেতর ৩০টি করে পুঁটলি ছিল, তাতে প্রায় ৭৫ হাজার করে ইয়াবা ট্যাবলেট ছিল। তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, টেকনাফের শাপলাপুর নামে একটা জায়গা আছে সেখানে একটা গহিন পাহাড়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় প্রথমে। তারপর তাদের জোর করেই কলার সঙ্গে খাইয়ে দেয়া হয় ইয়াবা। তারা মাত্র ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসছে ইয়াবা। তারপর যে সরবরাহকারী আছে তাদের কাছে দিয়ে দেয়। আসার পর ডাল-ভাত খেয়ে তা বের করে ফেলে।
গত ২০ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরার ডগাইর এলাকা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরা বিভাগ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন তৈয়্যবা বেগম (২৫), তার কথিত সন্তান পরিচয় দেয়া ১১ বছরের শিশু এবং তার ভাই আব্দুল্লাহর স্ত্রী মোসা. ইয়াসমিন। সন্দেহ হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক্স-রে করার পর ইয়াসমিনসহ শিশুটির পাকস্থলীতে বিশেষ কিছু দৃশ্যমান হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, তাদের পাকস্থলীতে দেড় হাজার ইয়াবা আছে। এরপর বিশেষ ওষুধ খাওয়ানোর পর তাদের পায়ুপথ দিয়ে ইয়াবাভর্তি প্যাকেটগুলো একে একে বেরিয়ে আসে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়