চারুকলার বকুলতলায় ছায়ানটের শারদ উৎসব

আগের সংবাদ

রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে বড় ধাক্কা : রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রপ্তানি কমেছে, সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ৭ মাসে সর্বনিম্ন

পরের সংবাদ

শ্রেণি শোষণের অভিপ্রায়ই জাতপ্রথায়

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বজুড়ে অজস্র জাতীয়তার এবং বহু সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে; কোনো সম্প্রদায়ে জাত-বর্ণের বিভাজন-বৈষম্য না থাকলেও একমাত্র সনাতন হিন্দু ধর্মে রয়েছে এবং শক্ত-পোক্ত রূপেই। কারা এবং কী অভিপ্রায়ে এমন অমানবিক জাতপ্রথা ধর্মীয় অনুশাসনের বাতাবরণে প্রতিষ্ঠা করেছিল? একই সম্প্রদায়ের মানুষে মানুষে বিভাজন-বৈষম্য সৃষ্টির পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ অবশ্যই ছিল। সমাজের ওপর আধিপত্যবাদী শ্রেণি নিজেদের আধিপত্য বজায় ও বিস্তারে এবং শ্রেণি শোষণকে নিষ্কণ্টক ও স্থায়ী বৈধতা দানের অভিলাষেই বর্ণাশ্রম প্রথাকে ধর্মীয় অনুশাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। নিজেরা সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ সেজে সাধারণদের বিভিন্ন জাতে বিভক্ত করে জাতপ্রথা প্রতিষ্ঠা করেছিল। লক্ষ্যটি শোষণ। বর্ণাশ্রমকে ধর্মীয় অনুষঙ্গরূপে উদ্দেশ্যমূলক সমাজে প্রতিষ্ঠা শ্রেণি-শোষণকেই স্থায়ী করা হয়েছে। সংস্কৃত ভাষাটিও তথাকথিত ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা সৃষ্টি করেছিল নিজেদের নিজস্ব ভাষা রূপে। ভাষাটি সাধারণের জন্য ছিল না। ধর্মীয় অনুশাসনে পাপাচার হবে যদি ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য কেউ সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের চেষ্টা করে। জিভ খসে পড়বে। জাতপ্রথার অনাচার হাজার বছর ধরে স্থায়ী রয়েছে। সংস্কারবাদীদের আগমন ঘটেছে, চেষ্টা হয়েছে জাতপ্রথা বিলোপের; একমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে তা সফল হতে পারেনি।
মানুষের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। ইতিহাসের নানা পর্বে শ্রেণি-শোষণের মাত্রা অনেক দেশে কমেছে, অনেক দেশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু স্থায়ীভাবে নির্মূল হয়নি। শ্রেণি-শোষণ সামন্ত সমাজে যেমন ছিল, বুর্জোয়া সমাজেও তেমনি অটুট রয়েছে। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সেটির বিলোপ সম্ভব। হিন্দু ধর্মে একই সম্প্রদায়ের মানুষে মানুষে বিভাজন-বৈষম্য টিকে থাকার মূলেও বিদ্যমান শ্রেণিবিভক্ত ব্যবস্থাটিই। ভারতবর্ষের বাইরে হিন্দু ধর্মের বিকাশ ঘটেনি সম্ভবত এই জাত-বৈষম্য ব্যবস্থার কারণেই। প্রধান ধর্মগুলোর জন্ম প্রাচ্যে। অন্য সব মহাদেশে প্রাচ্যের ধর্মমত বিস্তার লাভ করেছে। হিন্দু ধর্ম প্রাচীন ধর্ম হলেও ভারতবর্ষ এবং তার আশপাশ ছাড়া অন্যত্র বিস্তার লাভ করেনি। বিপরীতে জাত-বর্ণ প্রথার নিষ্পেষণের কারণে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের অজস্র ঘটনা ঘটেছে ভারতবর্ষজুড়ে। হিন্দু ধর্মত্যাগীদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেলেও জাতপ্রথার অবসানের লক্ষণ দেখা যায়নি। এখানে শ্রেণি-শোষণের অবসান হয়নি। সমাজ বিপ্লব ঘটেনি। এ কারণে ধর্মীয় বাতাবরণে জাত প্রথায় শ্রেণি-শোষণ অক্ষুণ্ন রয়েছে।
এক সময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ভারতবর্ষ বহুকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে ছিল। তখনকার শাসকগোষ্ঠী এবং ধর্মীয় নেতারা নিজেদের মধ্যে যোগসাজশে ধর্মীয় অনুশাসনের বৃত্তে জাতপ্রথাকে সমাজে প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। ব্রাহ্মণ-পুরোহিতরা শাসকদের অনুকূলেই থেকেছে। অভিজাত ব্রাহ্মণদের নানা সুবিধা প্রদানে শাসকরা নিজেদের পক্ষে তাদের ব্যবহার করত। সে কারণে ব্রাহ্মণরা শোষণ এবং শাসক সহযোগী রূপেই সব শাসনামলে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে। এই ব্রাহ্মণদের ব্যবহার করে শাসকরা শোষণকে স্থায়ী করেছিল। পরবর্তী সময়ে সুলতানী আমল, মোগল শাসন এবং ইংরেজ উপনিবেশিক শাসনামলের চূড়ান্তে স্বাধীন ভারতে ঘৃণিত এই প্রথার বিলোপে উদ্যোগ গ্রহণের ঘটনা ঘটেনি। বরং ধর্মীয় স্পর্শকাতর এ বিষয়কে সব শাসকই সযতেœ এড়িয়ে গেছে। ১৯৪৭-এর পর ক্ষমতার হাত বদলে ক্ষমতাসীন স্বদেশি শাসকগোষ্ঠী শ্রেণি-শোষণকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ব্যবস্থাটির পরিবর্তন তো পরের কথা, একে টিকিয়েই রেখেছে, নানা উছিলায়। এমনকি নিম্নবর্ণের দলিত শ্রেণির অভিধায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নিম্নবর্ণের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করেছে, সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ভোট লাভের অভিলাষে। ভারতে বর্তমানে হিন্দু মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে। সেখানে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসেছে। সঙ্গত কারণেই ধর্মীয় অনুশাসন পরিপন্থি পদক্ষেপ তাদের কাছে আশা করা যাবে না। এর সঙ্গে সঙ্গে আছে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির প্রত্যক্ষ মদদ। ভারতের অপর সম্প্রদায়গুলোও কিন্তু এখন নিরাপদে নেই। যেমন নিরাপদে নেই তথাকথিত নিম্নবর্ণের সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, যাদের দলিত শ্রেণি নাম দেয়া হয়েছে। হিন্দু মৌলবাদীরা ধর্মকে কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার করে এসেছে। অতীত ও বর্তমানের নানা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা তার একটা প্রমাণ।
সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীদের মধ্যে পার্থক্য নেই। চেহারা ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অভিন্ন। সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে, মানুষে-মানুষে বিভাজন সৃষ্টিতে এদের জুড়ি নেই। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকের কাছে পূজনীয় গুরু ও দার্শনিক রূপে স্বীকৃত রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব পর্যন্ত জাতপ্রথাকে স্থায়ীকরণের পক্ষে কাজ করেছেন। রামকৃষ্ণের পেছনের কাহিনীটি এরকমের। দক্ষিণেশ্বরের জমিদার রাজচন্দ্র দাস তার প্রথম দুই স্ত্রীর মৃত্যুর পর রানি রাসমণিকে তৃতীয় স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন। এই রানি রাসমণি রামকৃষ্ণকে ষাট বিঘা সম্পত্তিসহ গঙ্গা নদীর তীরে দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির (ভবতারিণী মন্দির) প্রতিষ্ঠার সমুদয় অর্থ প্রদান করেছিলেন। মন্দির নির্মাণ সমাপ্তির পর মন্দিরে প্রারম্ভিক পূজা অনুষ্ঠানের জন্য কলকাতা থেকে ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ জানানো হলে ব্রাহ্মণরা একজোটে রাসমণি এবং রামকৃষ্ণের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের অভিযোগ, জেলেনির অর্থে নির্মিত এই ভবতারিণী মন্দিরে পূজায় অংশ নিলে তাদের জাত-ধর্ম কোনোটিই রক্ষা পাবে না। তাদের পক্ষে নিম্নবর্ণের জেলে সম্প্রদায়ের রানি রাসমণির অর্থে নির্মিত মন্দিরের পূজায় অংশ নেয়া সম্ভব নয়। বহু চেষ্টা করেও ব্রাহ্মণদের রাজি করানো যায়নি। এমতাবস্থায় রামকুমার চট্টোপাধ্যায় নামে এক অত্যন্ত গরিব ব্রাহ্মণকে বহু কষ্টে রাজি করিয়ে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের উদ্বোধনী পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়েছিল। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এসেছিলেন তার ভাই গদাধর চট্টোপাধ্যায়। তাদের বিদায় লগ্নে রানি রাসমণি এবং রামকৃষ্ণের দুজনের অনুরোধে গদাধর চট্টোপাধ্যায় ওই মন্দিরের স্থায়ী পূজারিরূপে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে রামকৃষ্ণের শিষ্য বিবেকানন্দ গঙ্গার এপারের ভবতারিণী মন্দিরটির অপর পাড়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেলুড় মঠ। গঙ্গা নদীর দুপাড়ের এই মঠ ও মন্দির আজো রয়েছে।
রামকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রচলিত আছে তিনি বলেছেন, সব ধর্মের আরাধনাতেই ঈশ্বরপ্রাপ্তি লাভ সম্ভব। এক্ষেত্রে তার কথায় অসাম্প্রদায়িকতা আছে। অথচ এই রামকৃষ্ণই শেষ পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের দেবী মূর্তির কাছে হাত জোড় করে বলেছেন, ‘মা কালী, তুই জেলেনির অন্নপাপের পাপাচারে নিযুক্ত করলি। ভাগবানের কাছে কিসের প্রায়শ্চিত্তে আমার পাপ মোচন হবে জানি না। জেলেনির অন্ন গ্রহণের অপরাধে আমাকে নিশ্চয় চরম শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। মা কালী, তুই আমায় রক্ষা করিস মা।’ মন্দির, আশ্রমের জন্য সম্পত্তি দান এবং সব ইমারত-মন্দির কমপ্লেক্স নির্মাণে অর্থের জোগান দিয়েছিলেন রানি রাসমণি। রাসমণির দান রামকৃষ্ণ দুহাত পেতে নিয়েছেন। রাসমণি ছিলেন জেলে সম্প্রদায়ের। সে কারণে রামকৃষ্ণ অন্নপাপের জন্য প্রায়শ্চিত্তের শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়েছিলেন। ধীবরকুলের রাসমণির দেয়া সব সুযোগ-সুবিধা যখন নিয়েছেন তখন সে-কাজকে তিনি পাপ বিবেচনা করেননি। জেলেনি রাসমণি থেকে অনুদান নেয়ার পরে তার উক্তিতে তিনি জাতপ্রথার স্থায়ীকরণের পক্ষে শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। স্বার্থে আত্মসমর্পণ এবং স্বার্থ উদ্ধারের পরে নিম্নবর্ণের অন্নপাপের আত্মসমালোচনা! যে রামকৃষ্ণ মিশন মন্দির ভারতবর্ষসহ অনেক দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তার উৎসমূলে রানি রাসমণির বিশাল ভবতারিণী মন্দির কমপ্লেক্সটি। এরই শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটেছে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের রামকৃষ্ণ মিশন মন্দিরগুলোতে। রামকৃষ্ণ মিশনের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণকে অবজ্ঞাই করতেন। এই অপছন্দের প্রমাণ আছে। রামকৃষ্ণ ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি সাগরের কাছে এসেছি।’ উত্তরে ঈশ্বরচন্দ্র বিরক্তি সহকারে বলেন, ‘বেশ তো, এক ঘটি লোনা জল নিয়ে যান।’ মনোক্ষুণ্ন হয়ে বিদায় নেয়া ছাড়া রামকৃষ্ণের আর উপায় ছিল না।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়