জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সর্বশেষ রিলিজ স্লিপের মেধা তালিকা ২ অক্টোবর

আগের সংবাদ

ইউক্রেনের ৪ অঞ্চল রাশিয়ায় যুক্ত : প্রেসিডেন্ট পুতিনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, অবৈধ বলছেন ন্যাটো নেতারা

পরের সংবাদ

নতুনের আবাহনে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কবি নিজে স্বপ্ন রচনা করেন, জাতিকে স্বপ্ন দেখেন এবং দেখান; প্রয়োজনে কখনো স্বপ্ন বুননের কৌশল শেখান। কবি আত্মানুসন্ধানী হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেন, কখনো নিজস্ব জনপদকে জানার মন্ত্র শেখান পরিপার্শ্বকে; নিজেকে জানতে গিয়ে কখনো বিশ্বকে জানার ব্রতে মগ্ন হয়ে যান। শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে শব্দের বহিরাবরণ খুলে বের করে আনেন নতুন শব্দের সম্ভার। কবি সর্বক্ষণ ঘোরের গহনে নিমজ্জিত থাকেন; আবার ঘোর ভেঙে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ান। সত্যের মুখোমুখি হয়ে কখনো নিজেকে অতিক্রম করে যেতে চান; নিজেকে অতিক্রম করতে গিয়ে কখনো দার্শনিক অথবা ঋষি হয়ে যান; আমরা তো তেমন একজন কবির অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকি। কবির সৃষ্টিতে আমি অনন্তের সম্ভাবনা খুঁজি; যেখানে সম্ভাবনার আলো দেখতে পাই তার পেছনেই ছুটে যাই আলোর পিপাসা মেটাতে। তেমন এক সম্ভাবনার কবি ভেবেই আমি ছুটে চলি জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার পেছনে। বারবার তার বাখানে গদ্য লিখি, আরো একটি নতুন গদ্য লিখতে বসে ভাবি- একজন কবিকে নিয়ে এতবার লেখার প্রেরণা কোথায় পাই? উত্তর আসে একটাই, তার সৃষ্টিবৈচিত্র্য। হুদা আমার অগ্রজ, আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, আমার সৃষ্টিশীলতার প্রেরণা; হুদা আমার সাহস, আমার দিশা-বাতিঘর; হুদা আমার মাথার ওপর আশ্রয়বৃক্ষের ছায়া; আমাকে তাই তাকে দেয়া নৈবেদ্য দৃশ্যমান করতেও লিখতে হয়, ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। কেন না মুহম্মদ নূরুল হুদা কবিতার এক চলমান আন্দোলনের নাম, আমি যার নিরন্তর কর্মী, আর তিনি আমার নিরঙ্কুশ নেতা।
আমি তার ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ থেকে শুরু করে সদ্য প্রকাশিত ‘আমার মাতৃচুম্বনের আদি স্বর’ পর্যন্ত সমস্ত কাব্য পাঠের দায় থেকে লিখে যাই বারবার। কেউ যখন আমায় মুহম্মদ নূরুল হুদাকে নিয়ে নতুন একটি গদ্য লিখতে বলেন, আমি তাকে বলতে পারি না, ‘ভাই, একজন কবিকে নিয়ে আমি আর কত লিখব!’ সমুদ্র থেকে দু’চার ঘড়া জল তুলে নিলে সমুদ্রে কি জলের ঘাটতি হয়? মুহম্মদ নূরুল হুদার সমুদ্রের মতোই বিশাল এবং বৈচিত্র্যময়। আজ আমি লিখতে চাই ‘নতুনের আবাহনে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা’। সহস্র ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি কবিতা লিখে চলেন; তাকে নিয়ে লেখার জন্য নতুন নতুন অনুষঙ্গের জন্ম দিয়ে চলেন। ধরা যাক সাম্প্রতিক সময়ে তার এতটাই ব্যস্ততা, যে কারণে আমি নিজে ভালোবেসে সযতেœ তাকে এড়িয়ে চলি; কিন্তু কবিতা কি একদিনও তার কাছ থেকে দূরে থাকে? না-কি তিনি কখনো কবিতার কাছ থেকে দূরে থাকেন? এই যে কবিতার প্রতি তার এক বিস্ময়কর ঘোর সর্বক্ষণ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে; সেই ঘোর-অনুসন্ধিৎসাই বারবার আমাকে টেনে নিয়ে যায় তার কবিতার কাছে।
বাংলাদেশের অগ্রগণ্য কবি ও কাব্যকোবিদ, জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার জন্ম দরিয়ানগর খ্যাত কক্সবাজারে। দরিয়ানগরে জন্ম নিয়ে তিনি কাব্যসৃষ্টিতে দরিয়া চারিত্র্য ধারণ করেছেন। দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় তিনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা মাড়িয়ে যাওয়া সহজসাধ্য নয়। তার কবিতায় বাংলার সংস্কৃতি ও প্রকৃতি, বাঙালি জাতির বিকাশ, বাঙালির শৌর্য ও সংগ্রাম নানামাত্রিক ব্যাঞ্জনায় উচ্চারিত হয়েছে; প্রাগ্রসর মানুষ তাই যৌক্তিকভাবেই তার নামের সঙ্গে ‘জাতিসত্তার কবি’ অভিধা যোগ করেছেন। শোণিতে সমুদ্রপাত (১৯৭২) নামের প্রথম কাব্যেই তিনি জানিয়ে দিতে পেরেছিলেন তার প্রকট উপস্থিতির বার্তা। এর পর ক্রমাগত এবং অবিরাম- ১৭৭৫-এ প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্য ‘আমার সশস্ত্র শব্দবাহিনী’। যে কাব্যে সমকাল ও পরিপার্শ্ব উঠে এসেছে অনন্য দ্যুতি নিয়ে। তৃতীয় কাব্য ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’ও প্রকাশিত হয় ১৯৭৫-এ। তৃতীয় কাব্যে আমরা একজন নিষ্ঠ প্রেমিক কবিকে পাই, যিনি নিজেকে এ মাটির সন্তান দাবি করে অনার্য প্রেয়সীর প্রতি নিজের প্রেম এবং নিজেকে সর্বাংশে নিবেদন করেন। ‘অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী’ শিরোনামের চতুর্থ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে; যেখানে একই শিরোনামের পঞ্চাশটি কবিতা সংকলিত হয়েছে। চতুর্থ কাব্যের কাব্য-মেজাজ তৃতীয় কাব্যেরই সম্প্রসারণ বলা যায়। তবে সমাজদ্ব›দ্ব-শ্রেণিদ্ব›দ্ব এবং অন্তর্দ্ব›দ্বতাড়িত কবি যে প্রেমের পাশাপাশি পরিপার্শ্বের বিষয়েও সচেতন তা জেনে যাই এসব কাব্যে। ১৯৮১-তে প্রকাশিত পঞ্চম কাব্য ‘আমরা তামাটে জাতি’ কবিকে ‘জাতিসত্তার কবি’ অভিধায় পরিচিত করে তুললেও একই বিষয়ের কবিতা কবির পূর্বে প্রকাশিত কাব্যেও লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এ কাব্যের ‘রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি/ সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি/ আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।’ যেভাবে বাংলার কাব্যানুরাগীদের অন্তর ছুঁয়ে গেছে তেমনটি যেন পূর্ববর্তীদের ভাগ্যে জোটেনি। ষষ্ঠ কাব্য ‘শুক্লা শকুন্তলা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৩-তে। শুক্লা শকুন্তলায় কবির ঐতিহ্যপ্রীতি এবং পুরাণের প্রতি আগ্রহ লক্ষ করা যায়। ১৯৮৪-তে প্রকাশিত সপ্তম কাব্য ‘যিসাস মুজিব’-এর প্রবণতা রাজনীতি ও সমাজনিষ্ঠতার প্রতি। বৈরী সময়েও বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাব্য প্রকাশের স্পর্ধা দেখান মুহম্মদ নূরুল হুদা। অষ্টম কাব্য ‘হনলুলু ও অন্যান্য কবিতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭-তে। এ কাব্যে আন্তর্জাতিকতার পাশাপাশি লোকবাংলার জীবন বর্ণিত হতে দেখি। জীবনের সংকট-সংঘাত-মান অভিমান-বিরহ-বিচ্ছেদ-হাহাকার ও আকুলতার দীর্ঘশ্বাস পরিমিতি ও শিল্প সুষমায় উচ্চারিত হয়েছে তার নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ কাব্য কুসুমের ফণা (১৯৮৮), বারো বছরের গল্প (১৯৮৮), এক জনমে লক্ষ জন্ম (১৯৮৮) এবং গালিবের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক (১৯৮৯) কাব্যসমূহে। তার এসব কাব্যের কবিতায় ছন্দ নিয়ে নিরীক্ষার প্রবণতাও দেখি। যে আবেগের কথা আগেই বলা হয়েছে সে রকম কিছু ছবি এসব কাব্যে সন্ধান করা যেতে পারে। ‘বারো বছরের গল্প’ কাব্যের কবিতাগুলো এবং ‘গালিবের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক’ কাব্যের নাম কবিতা অথবা ‘তন্দ্রাচ্ছন্ন পঙ্ক্তিমালা’ কবিতাগুলো পাঠ করা যেতে পারে। তন্দ্রাচ্ছন্ন পঙ্ক্তিমালা পড়ে পাঠক বিস্মিত হবেন এবং কবির ‘ঘোর’ সম্পর্কেও নিশ্চিত হবেন। এসব কাব্যের কবিতায় যেমন আবেগের বাড়াবাড়ি আছে একই সঙ্গে আছে কবির পরিমিতি ও সংযম প্রদর্শনের দুর্লভ যোগ্যতার দ্যুতি, যা যে কোনো সংবেদনশীল পাঠককে চমকে দেবার ক্ষমতা রাখে। কবির ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ কাব্য ‘আমি যদি জলদাস তুমি জলদাসী’ (১৯৯০) ও ‘প্রিয়াঙ্কার জন্য পঙ্ক্তিমালা’ (১৯৯২)-তে দেখি কবির ঘুরে দাঁড়ানো। কেন ঘুরে দাঁড়ানো? যে আবেগের উত্তাল ঢেউ কবিকে বারবার ভাসিয়ে নিতে চেয়েছে- তলিয়ে দিতে চেয়েছে দুঃসময়ের বাঁকে পেয়ে, সেইসব ক্রমাগত আবেগের প্রবাহকে নিজের নিয়ন্ত্রণে-নিজেকে নিজের তালুবন্দি করে তাকে নিজের সৃজনশীলতার জাদুতে পরিশীলিত করে তুলেছেন অবলীলাক্রমে।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সাম্প্রতিক কবিতার দিকে এবার দৃষ্টি দেয়া যাক; নিরন্তর তিনি লিখে চলেছেন নতুন নতুন কবিতা। আসুন একটি কবিতা পাঠ করা যাক, যে কবিতা এখনো কোনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি-

মধ্যরাতে জেগে ওঠে/ কবিতার কবি,/ মধ্যরাতে জেগে ওঠে/ কবির কবিতা;

কে কার বন্ধনে মুক্ত,/ কে কার অঙ্গনে?/ তুমি হও, তুই হোস্,/ যার গন্ধ যে নে।

আমরা শয্যার ওমে/ পরস্পর পরিচর্যা করি,/ দেহের আধারে মন/ প্রাণে প্রাণে ধরি;

তথাগত, এইমতো/ কবিকে অমর করে/ কবিতাকবরী।
(কবিতাকবরী \ মুহম্মদ নূরুল হুদা)

কবি যেন তার প্রাত্যহিক অনুষঙ্গকে কবিতায় তুলে আনতে চান নিপুণ মুন্সিয়ানায়। এভাবে তিনি তার পাঠককে নতুন চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করে দিতে চান। নতুনকে আবাহন করতে গিয়েই কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা উচ্চারণ করেন-

মিশে গেলেই তো সবটুকু মিশে যাওয়া হয় না;
ন্যূনতম দূরত্বটা কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে;
আমাদের অনঙ্গমে যার জন্ম, সে কথা কয় না;
শেষমেশ সে-ও কি দাঁড়িয়ে থাকে তৃতীয়ের বাঁকে?
…………………………..
তোমার ভিতরে আমি, আমার ভিতরে তুমি চিরমনপ্রিয়;
তৃতীয় সত্তার কাছে মনবন্দি, আমরা তো পূর্বস্মরণীয়।
(চিরমনপ্রিয় \ মুহম্মদ নূরুল হুদা)
এভাবেই প্রেম আর দার্শনিকতার দ্যুতিতে কবি নিজের চলমান পথটিকে প্রসারিত করে দিতে চান নতুনের আবাহনে; তার এ আবাহন যতটা সর্বজনীন, ততটাই প্রতীকী। স্বপ্নকে ছুঁতে হবে স্বপ্ন দিয়ে, আত্মার ধ্বনি কেবল আত্মাই শুনতে পায়; প্রজ্ঞার পাঠ নিতে হবে প্রজ্ঞার আলোয়; নতুন প্রজন্ম যেন তার প্রজ্ঞার আলো চিনে নিতে ভুল না করে, সে জন্য নতুনেরা নিজেকে আলোকিত করে নেবেন ধ্যানমগ্ন প্রজ্ঞায়; এই আমার প্রত্যাশা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়