জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সর্বশেষ রিলিজ স্লিপের মেধা তালিকা ২ অক্টোবর

আগের সংবাদ

ইউক্রেনের ৪ অঞ্চল রাশিয়ায় যুক্ত : প্রেসিডেন্ট পুতিনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, অবৈধ বলছেন ন্যাটো নেতারা

পরের সংবাদ

তিমিরের পথে জীবনের সন্ধান

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শিল্পযাত্রার পথে কখন কোন অনুষঙ্গে কে যাত্রা করবেন- নির্ণয় করা কঠিন।
তবুও কঠিনেরে ভালোবেসে, কঠিন যাত্রায়-শিল্পপথের অবিচল পথিক হয়ে ওঠেন অনেক অনিবার্য তৃষ্ণায়, ব্যাকুল আত্মহননে। কীভাবে, কেমন সত্তার মধ্যে এই নিঃশব্দ অমর যাত্রা, ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ অধিত প্রসঙ্গ। কিন্তু ভাব অনুভবের মহাচক্রে, হৃদয় কাঠামো বা মন মাঝারে স্বপ্ন বা কল্পনার বিলাসে যখন ফোটে শব্দের কারুবিন্যাসে রক্ত গোলাপ- সেই গোলাপ কি কেবলই গোলাপ? না শব্দ রক্ত কল্পনা উদ্যান? কিংবা ধরা যাক- দূর পাহাড়ের চূড়ায় দুুপুরের রোদে দেখা দেয়া তড়িৎ মরীচিকা, লেখক সত্তার সিন্দুকে মরীচিকা যখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, গড়ে ওঠে নির্মাণের অতল দেয়াল। দেয়ালের গাত্রে অজস্র ছবির বিন্যাসে গল্পকার বা উপন্যাসিক আঁকেন জোছনার নির্মম রোদ চাদর আর বৃষ্টিতে দেখেন দুধের নহর, নহরদরিয়া।
উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদা এখন পর্যন্ত দুটি উপন্যাস লিখেছেন। জন্মজাতি ও মৈনপাহাড়। জন্মজাতি উপন্যাসের দ্বিতীয় পৃষ্ঠা দিয়েই শুরু করা যাক।
‘তার আগে রমণী দাসের কথাই বলা যাক। রমণী দাস এই ইসকুলের দপ্তরি। কেউ বলে প্রহরী। ঠিক দুটোই। পাহারা দো দেয়-ই। দপ্তর ঠিক রাখার কাজও সে যোগ্যতার সঙ্গে পালন করে। বেঁটে খাটো মানুষ রমণী দাস। পেটানো শরীর। তবে হাঁটার সময়ে একটু খোঁড়ায়। চুলগুলো কাঁচাপাকা, গায়ের রঙ আলকাতরার মতো কালো। লোকে বলে হাবশী কালো। জাপান-ব্রিটিশের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল যে সব নিগ্রো সৈন্য, সেই সৈন্যদের মতো কালো।’
আমরা ইঙ্গিত পেয়ে যাই। লাইনটা আবার পাঠ করুন- জাপান-ব্রিটিশের পক্ষে যুদ্ধে করেছিল যে সব নিগ্রো সৈন্য, সেই সৈন্যদের মতো কালো।’ কে? রমণী দাস। রমণী দাস কে? ইসকুলের দপ্তরি কাম পাহারাদার। পিটায় ঘণ্টা ইসকুলের- ছুটির এবং ক্লাসের। রমণী দাস কোন এলাকার পুত? দরিয়া পারের এলাকা- কক্সবাজার এলাকার। সেই এলাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সামাজ্যবাদী ব্রিটিশদের হয়ে লড়ার জন্য আফ্রিকার দখল করা দেশ থেকেও হাবশী কালো নিগ্রোদের নিয়ে এসেছিল। এই মাটির ভুবুক্ষ ক্ষুদার্থ নারীর সঙ্গে সঙ্গম ক্রিয়ায় মত্ত থেকে রেখে গেছে কসের চিহ্ন, সেই চিহ্নের উত্তরাধিকার বহন করছে রমণী দাস, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘জন্মজাতি’ উপন্যাসের ভূভাগজুড়ে মানবজন্মের খতিয়ান আর দাগ নম্বর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। খুঁজেছেন অন্তহীন মানবযাত্রার প্রথম পদচিহ্ন, কিন্তু পেয়েছেন কোনো চিহ্ন, তিনি উপন্যাসিক নূরুল হুদা নির্ণয় করে আমাদের বহিত করেননি, অন্তত পাঠকদের। না, জানানোও সম্ভব নয়। মহাজীবনের কালো পৃষ্ঠায় সাদা অক্ষরে লেখা জীবনের অভেদ রহস্য খুঁজে পাওয়া সহজ? দুনিয়াজুড়ে কি দরিয়া বা দরিয়ানগর একটা? শত শত নদী ও দরিয়ার তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতার সুলুক সন্ধান কেউ কি কখনো পেয়েছে? না পাবে? কিন্তু জাতিস্বরের কণ্ঠস্বর, দরিয়াপারের সন্তান মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘জন্মজাতি’ উপন্যাসে খুঁজে ফিরেছেন, মানুষের জন্মবৃত্তান্তের অজানাকালের পাদটিকা। প্রচলিত কাঠামোয় বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস রচনা করা হয়, ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’ উপন্যাসের স্রষ্টা মুহম্মদ নূরুল হুদা সেই প্রচলিত ফরমেটে পা রাখেননি। নিজস্ব মানসশয্যায় উপন্যাসের আখ্যান রেখে নিজের জন্মজমিনের সঙ্গে ইতিহাসের সাম্পান চালিয়ে, কোদাল ও কাচির নিরিখে মানবসত্তার ভেদ খুঁজতে চেয়েছেন। সেই ভেদ ভূমির মাঝখানে এসে দাঁড়ায় অনেক চরিত্র আর আখ্যানের মানচিত্র!
চরিত্রগুলো রমণী দাস, ফিরুজা বিবি, নবি বলী, ইয়াজুজ মাজুজ, কিশোর এসব চরিত্রের সঙ্গে উপন্যাসের দেখা ও না দেখা ভূমির প্রান্তসীমায় আঁকেন অনন্ত মানুষের গাঁথা। অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়, উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদা কবি, কবিতার সত্তা সমগ্রে তিনি নিপতিত, নিমজ্জিত সেই জন্মকালের সকাল থেকে। অস্থিমজ্জা হৃৎপিণ্ড কল্পনায় কবিতার বিস্তারে আর দরিয়ার ডাক, দরিয়ার ছলছল জলের জলোচ্ছ¡াসে মগ্ন-উপন্যাসিক মূলত মহা কবিতার নতুন এক অধ্যায় রচনা করেছেন দুই উপন্যাসের ক্ষেত্রফলজুড়ে। ছোট ছোট পয়ারে উপন্যাসের আখ্যানে তিনি- কবি ও উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদার সীমার মধ্যে অসীমের সন্ধান করেছেন বিচিত্র ও বিবিধ অনুষঙ্গে। পাঠক দুটি উপন্যাসের যত গভীরে প্রবেশ করেন, মনে হয় শব্দ কল্পনা আর আখ্যানের পাতালপুরে প্রবেশ করে ভাবনা স্রোতের ভাটির দিকে উজান হাঁটছেন।
মুহম্মদ নূরুল হুদার দুটি উপন্যাস- ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’ জোড়া উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ সালে, কথাপ্রকাশ থেকে। জোড়া উপন্যাস প্রকাশের পেছনে আমার যোগাযোগের ভূমিকা ছিল প্রকাশক জসিমউদ্দিন ও উপন্যাসিকের মধ্যে। ‘জোড়া উপন্যাস’ প্রকাশের সময়ে উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদার ইচ্ছাক্রমে ফ্ল্যাপের লেখাটি লিখেছিলাম। ফ্ল্যাপের লেখা লিখতে গিয়ে উপন্যাস দুটো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলাম। পড়ার পর লিখেছিলাম ফ্ল্যাপ। আজ, ছয় বছর পর উপন্যাস দুটির ওপর পুনঃবার লিখতে এসে পেছনের স্মৃতি আমাকে অনুপ্রাণিত করছে। এবং সেই লেখা পাঠকদের উদ্দেশ্যে পুনঃবার লিখছি।
‘কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা’র উপন্যাস ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’। জোড়া উপন্যাস। জোড়া উপন্যাস সাহিত্যের এক অভিনব প্রকরণ। একের ভেতর দুই। দুইয়ের ভেতর এক। কবি ও উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদা জন্ম আঁতুরঘর দরিয়ানগর- দইজ্জার সঙ্গে মৈনপাহাড় পরস্পর বিপরীত সাযুজ্যের এক নিবিড় ঐক্য গড়ে তুলেছেন উপন্যাস জোড়ায়। নব্বই দশকের শুরুতে মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিদগ্ধ পাঠক ও লেখকরা বিস্মিত হয়েছিলেন। বাংলা ভাষার উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা ও উত্তরাধুনিকতা প্রান্তমুক্ততার প্রথম জাতক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করলেন কবি ও উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদা। রমণী দাস, ফিরুজা বিবি, নবি বলী, ইয়াজুজ মাজুজ, কিশোর- এসব মনুষ্য চরিত্রের সঙ্গে কক্সবাজার, মহেশখালি, দইজ্জ্যা, লইট্টামাছ, সাম্পান, আদিনাথ মন্দির, আদিনাথ পাহাড়ের চূড়া, রহস্যঘেরা পাহাড়ের পথ একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে বিচিত্র আখ্যানে অনবদ্য কাব্যিক গতিতে এগিয়ে গেছে জোড়া উপন্যাসের উপাখ্যান ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’।
হাজার বছর ধরে পাহাড় ও দরিয়া মানবজাতির সঙ্গে মিলনে ও বিরহের যে নিখুঁত উত্থানপতনের সংসার রচনা করে চলেছে, সেই সংসারের প্যাঁচালী মুহম্মদ নূরুল হুদা অনুভবের রক্ততিলকে ইতিহাস চেতনার নিরীক্ষায় বর্ণনা করেছেন গভীর ধ্যানমগ্নতায়। জোড়া উপন্যাস পাঠ করতে করতে মনে হয় হাঁটছি একই সঙ্গে দরিয়ার প্রবল ঢেউয়ের মাথায় ও মৈনপাহাড়ের চূড়ায় পা রেখে।
কবির ভেতরের গদ্যর আরতি অপূর্ব ও তীক্ষè দক্ষতায় কেমন করে নির্বাণ লাভ করে, উপন্যাস দুটিতে তার প্রমাণ রাখলেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। কবিতা, গান, লোকগীতি, প্রবচন, গল্প- একই সূতোয় গেঁথে গেঁথে জোড়া উপন্যাসকে দিয়েছেন চিত্তলোকের অনবদ্য মহিমা।’
মানুষ জন্ম থেকে হাঁটতে শুরু করেছে, অথবা লেখা যায় যাত্রা করেছে এবং অনন্তকালের দোলাচালের স্রোতে সেই যাত্রা এখনো বহমান। উপন্যাসিক, গল্পকার মূলত কি লেখেন গল্পে বা উপন্যাসের বিশাল ভূভাগজুড়ে? লেখেন মানুষের যাত্রার পায়ের চিহ্ন। কিন্তু সেই লেখা বা উপাখ্যানের নির্মাণ কখনো শেষ হয় না, থাকে যাত্রায়, থাকে মাত্রায়। জোড়া উপন্যাসের উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদা সেই যাত্রার ঠিকানা আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। আমরা পাঠ নিতে পারি-
‘বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গ পেরিয়ে ওই মাস্তল পার হয়ে যায় সোনাদিয়া। এই যাওয়াতে তার নিজের কোনো ভূমিকা নেই, তার নিজের কিছু যাওয়া আসা নেই। তার কাজ শুধু মাস্তল টান টান দাঁড়িয়ে থাকা। কেননা খাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে না পারলে সে আর মাস্তল থাকে না। হয়ে যায় মামুলি একটা গাছ, কাটা পড়া গাছ, উপড়ানো গাছ, বড়জোর ভূপাতিত বৃক্ষ। তখন সে কারো নজর কাড়ে না, উৎসুক কোনো চাখে পড়ে না। তখন তার ওপর বউটা ওড়ে না, পাল ওড়ে না। না, তখন দূর থেকে কিশোরও তাকে দেখতে পায় না। তাকে নিয়ে আর আকাশ-পাতাল ভাবনারও কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
তাহলে মূল কথা ওই দাঁড়িয়ে থাকা, খাড়া থাকা।
পায়ের নিচে পাটাতন, তার নিচে জল।
কিংবা পায়ের নিচে জলস্থল।
মাস্তলের এক পা, মানুষের দুই পা মিলে এক পা।
দুই পা এক করে অনড় ভঙ্গিতে খাড়া থাকে কিশোর। নৌকা ছেড়ে ডাঙায় এসে দাঁড়ায়। ইচ্ছে হয়, দক্ষিণ থেকে উত্তরে আসা ওই দূর মাস্তলের মতো সেও চলে যায় দূরে কোথাও। তার পায়ের নিচে স্থল নামক এক বিশাল নৌকা দোল খায়। যায়, জল যায়, স্থল যায়, ভেসে ভেসে যায়। নিজ ঘাটে যায়, যায় নিজ ঠিকানায়।’
[পৃষ্ঠা ১৮৪]
কিশোর জোড়া উপন্যাসের অনেকটা প্রধান চরিত্র। এই যে কিশোর করছে ঠিকানার সন্ধান, সেই কিশোর বা জোড়া উপন্যাসের একা কিশোর কি ঠিকানা খোঁজে? মূলত মানব চরাচরের প্রতিজন মানুষ ঠিকানা খোঁজে। প্রশ্ন হচ্ছে পায় কি? ঠিকানা কোথায়? জীবিতের ঠিকানা না মৃতের ঠিকানা? মৃতের ঠিকানা কোথায়? জীবিতের বা ঠিকানা থাকে? কিশোর আমাদের ঠিকানার সন্ধান দেয়ার জন্য দরিয়া পার হয়ে এসেছে কিন্তু তীরে এসেও আবার দিক ভ্রান্ত! মুহম্মদ নূরুল হুদা- উপন্যাসিক জোড়া উপন্যাসে কিশোরকে কেন্দ্র করে ঐন্দ্রজালিক এক জগতের নির্মাণ বিস্তার করেছেন। দেখিয়েছেন জীবনের চক্র নিজের চক্রে নয়, প্রকৃতি, নদী, জলস্রোত, ঘাস মাখা পথের শামুক-ভাঙা অলাতবোধে আক্রান্ত বিভ্রান্ত বিভ্রমের জীবনে কোনো ঠাঁই নেই- জীবনের।
কিশোর কে? কিশোর কি নূরুল হুদা? মুহম্মদ নূরুল হুদা? নাকি রিশাদ হুদা? অথবা এই হুদাদের কেউ নয়, দরিয়ার ওপার থেকে আসা হাজার বছরের চিহ্ন আঁকা যদু বংশের কোনো হুদা? যে হুদার শুক্রমজে গড়ে উঠেছে দরিয়া পারের অথৈ নগর? নগরের মানুষের সর্বনাশের গ্রাসের বিরহের কাতরের প্রেমের সমূহ আর্তি ও বুননে গড়ে উঠেছে ভিন্ন গ্রাম। সেই গ্রামের বুনিয়াদী রসায়নে তৈরি হয়েছে যে মৈথিলি সংরাগ- সেই সুরে বেঁধেছে কিশোরের জীবন চক্র।
দুটো উপন্যাসজুড়েই জটিল উত্তরায়ণের পতাকা তুলে এগিয়ে গেছেন উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদা। আমরা প্রচলিত ধারায় যে পড়ি বা পড়ে অভ্যস্ত- জোড়া উপন্যাস কিন্তু সেই ধারার নয়। জোড়া উপন্যাসে পটভূমি বা আখ্যান কেবল মানুষ নয়, মানুষেরও অধিক স্থান দখল করে রেখেছে প্রকৃতির অমৃত আধার ও সুধাপাত্র।
কিশোর কেন খুঁজে বের করতে চায় মৈনপাহাড়ের চূড়ো? কেন যায় আরশি বিবির মন্ত্র কারখানায়? আরশি বিবি গল্পের সূত্রে কিশোর কেন ছুটে যায় মৈনকিশোরীর সন্ধানে? মৈনকিশোরী? মৈনপাহাড় উপন্যাসের বাঁকে বাঁকে অপেক্ষা করে রহস্যের ভাগ ও বাঘ। পড়তে পড়তে পাঠক নিজেই ডুবে যাবেন ডুবন্ত জলের ঘূর্ণিস্রোতের আসমানে। পরাবাস্তবতার উত্তুঙ্গ ব্যবহারে ‘মৈনপাহাড়’ উপন্যাস পৌঁছে গেছে অন্ধস্রোতের তুমুল পিকনিকে। কত চরিত্র, ঘটনার কত ঘনঘটা- একের পর এক পার হয়ে যায় নদী, করাত আর বাঘের মাসি!
উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদা বহুমাত্রিক রূপান্তরে জোড়া উপন্যাসের আখ্যান সাজিয়েন ঘরোয়া ছন্দে যেমন, আবার বিপরীতে রেখেছেন ঘটনার বিষাক্ত তরবারিও। ফলে, জোড়া উপন্যাসের তল বা ঠাঁই পাওয়া মুশকিল। কোন লগনের সূত্র কোথায় যে ছিঁড়ে কোথায় জোড়া লাগায়- নামতায় গুনে শেষ পাওয়া যায় না।
আমরা পাঠ করতে পারি মৈনপাহাড় উপন্যাসের একটি পৃষ্ঠা :
‘মাথার ভেতর দ্রুত নানা চিন্তা ঝট পাকাতে থাকে। বাঁকখালি, মৈশখালি দইজ্জা আর বড় দইজ্জার মিলনমোহনায় যেমন জলের ত্রিঘূর্ণি ওঠে, সেই ঘূর্ণির চোঙাপাকে যেমন মুহূর্তেই তলিয়ে যায় ছোটখাটো জলযান, তেমনি ভাবের ঘূর্ণি ওঠে কিশোরের মাথায়। আশপাশের সবকিছু কোথায় যেন তলিয়ে যায়।
শাথাটাকে তার আকাশের মতো বিশাল মনে হয়।
সেই মাথার ভেতরে সে একটা চাঁদ উঠতে দেখে।
সেই চাঁদের যাত্রা শুরু হয় মৈনপাহাড়ের শিখর থেকে।
কিশোরের মনে হয়, তাহলে তো ব্যাপারটা খুব দুঃসাধ্য নয়। মৈন পাহাড়ের মাথায় গেলেই তো চাঁদের দেখা পাওয়া সম্ভব। তার সঙ্গে মোলাকাত করা যায়। তখন আজকের রহস্য আর অনেক বছর আগেকার বাঁশি পাগলার রহস্যও এক হয়ে যায়। তখন সব রহস্যের সাক্ষী ওই ঠাণ্ডা চোখের চাঁদের জবানবন্দি শোনা যায়। সব রহস্যের কিনারা করা যায়।’ [পৃষ্ঠা : ২৪৬]
কিশোর কি রহস্যের কিনারা করতে চায়? পাহাড়ের? চাঁদের? দইজ্জার? নাকি গাভীর? নাকি অন্ধকারের? না, উপন্যাসের শেষ পাদে এসে অলৌকিক যাত্রার সঙ্গি করেন উপন্যাসিক। সেই যাত্রায় যুক্ত হয়- সোনাবিবি। সোনাবিবির সূত্র ধরে অন্ধকার রাতে আসে একটি গাভীন ও দুইজন পুরুষ। কিশোর মনে করে চোর। অন্ধকার ধরে ধরে এগিয়ে যায় চোরের কাছে, চোরেরা গাভীন পাহাড়ে দেবীর দরবারে পাঠিয়ে ধরে কিশোরকে। কিশোরকে হাত-পা বেঁধে বেদড়ক মারে। জ্ঞান হারিয়ে গেলে চোরেরা চলে যায়, কিশোর জ্ঞান ফিরে পেলে চলে যায় সোনাবিবির কাছো।
সোনাবিবি মন্ত্র পড়ে ওর শরীরে তেল মাখে। মন্ত্র পাতনের মধ্য দিয়ে কিশোর পেয়ে যায় আরশি ফকিরনীর সন্ধান। আরশি ফকিরনী শোনায় হিমশীতল গল্প। মৈনপাহাড়ের উৎস গাঁথা। কোনো এক রাজা রানির সন্তান না হওয়ায়, রাজ্যর রাজজ্যোতিষী ও রানির গোপন মন্ত্র কাণ্ডে রানির গর্ভে আসে সন্তান। রাজা ভূমিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখেন মৈনকুমার। মৈনকুমার বড় হয়, চৌদ্দ বছরের মাথায় মৈনকুমার জেনে যায় নিজের জন্মদুর্ঘটনা। মূলত, মৈনকুমার ছিল নারী। তাকে পুরুষে রূপান্তরিত করা হয় রাজ্যের স্বার্থে, রাজার প্রয়োজনে। শিকারে যাওয়ার পর জেনে যায়। কীভাবে জেনে যায়?
উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদা বিশ্ব সাহিত্যের অভিজ্ঞানে পরিপূর্ণ রসিক শিল্পী। তিনি জানেন- অন্তরবাজির ম্যাজিক, ম্যাজিকরিয়ালিজম কিংবা উত্তরাধুনিকতা অথবা জাদুবাস্তবতার নির্মাণ প্রকৌশল জাদু। অধিত অভিজ্ঞতা, জন্ম ভূমিপুত্রের মাটি থেকে আহরিত শত সহস্র বছরের মাটি বাতাস দইজ্জার স্রোত ঘ্রাণ আর বিস্তার পঠন ও বিশ্বভ্রমণের সম্মোহন। এতগুলো সত্তা ধারণায় রেখে তিনি নির্মাণ করেছেন কিশোরের পাথরবাটির চরিত্র- আবার রেখেছেন পুরাণ জমানার রক্ত আলেখ্যর দুর্বাঘাস। পুত্র মৈনকুমার শিকার থেকে এসে চিঠি লেখে রানি মাকে-
মা…
আমার সবচেয়ে বড় লাভ, মহাজীবনে প্রবেশের আগে আমি জেনেছি আমি কে? আর কার ঔরসজাত? আমি মৈসকুমার নই। মৈনকুমারী।
আমি তোমার মতোই এক হতভাগ্য নারী।
আমাকে আমার নারীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তোমরা তোমাদের প্রয়োজনে আমাকে গড়তে চেয়েছিলে পরিপূর্ণ পুরুষ রূপে। তা তোমরা পারোনি। মাত্র গতকাল মৈনপাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় বসে বিশাল ডানার এক নাম না জানা পাখি শিকার করে যেই তীরবিদ্ধ পাখির বুকের রক্তে হাক ভিজালাম, অমনি আমি আমার নারীজন্মের প্রথম নিদর্শন দেখলাম। মৈনচূড়া আমার নারীনিদর্শনের রক্তে সিক্ত হলো।…
আমার একটাই অনুরোধ- মৈনপাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় আমাকে সমাহিত করো নির্জন নিশীথে। কেউ যেন না জানে আমার সমাধির ঠিকানা। সমাধিতে না যেন থাকে কোনো নিদর্শন। …আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমি আমার শরীরের প্রতিটি কোষকে এই মৈনপাহাড়ের বিশাল শরীর ও উপত্যকায় অরণ্যের বীজ করে তুলবো। আমার প্রতিটি রক্তকণা উৎস হবে এ একটি নহরের। আর এভাবেই ফলনের বান ডাকবে এই মৈনপাহাড়।’
[পৃষ্ঠা – ২৭৪]
হাজার বছরের গল্প বা মিথের সঙ্গে বর্তমান সময়কে শব্দের অনুভবের তরঙ্গের পেরেকে গেঁথে দিলেন মুহম্মদ নূরুল হুদা- জোড়া উপন্যাসের মহা যোজনায়। চলমান সময়ের কিশোরকে তিনি নিয়ে গেলেন আবার সেই মৈনপাহাড়ের চূড়োয়। বিনাস ঘটালেন রাতের গাভীন চুরির সেই দুই রক্ত কাপালিকের হাতে। কিশোর হারিয়ে যায় অজানা সময়ের স্রোতে, মৈনপাহাড়ের চূড়োয়।
শিল্পবাড়ি ও জোড়া উপন্যাসের প্রকাশনাকালে উপন্যাসিক মুহম্মদ নূরুল হুদা জানিয়েছিলেন- জোড়া নয়, হবে ট্রিলজি, তিনটি উপন্যাস, এমনকি এই আখ্যানের মধ্যে যাত্রা থেমে না গেলেও চতুর্থ বা পঞ্চম উপন্যাসও হতে পারে। আমার মগজের মধ্যে চরিত্রগুলো ক্রমাগত হাঁটছে। আমি বিশ্বাস করি, সাহিত্যের এই চলমান নাবিক যে কেন সময়ে জোড়া উপন্যাসের প্রবাহ ঘটনায় লিখতে বসতে পারেন এবং আমরা পাঠকরা অভিনব সৌকর্য সুন্দরের আগাম যোজনায় পেয়ে যেতে পারি- অসামান্য ফসল সম্ভার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়