জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সর্বশেষ রিলিজ স্লিপের মেধা তালিকা ২ অক্টোবর

আগের সংবাদ

ইউক্রেনের ৪ অঞ্চল রাশিয়ায় যুক্ত : প্রেসিডেন্ট পুতিনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, অবৈধ বলছেন ন্যাটো নেতারা

পরের সংবাদ

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার বৈচিত্র্যঋদ্ধ কবিতাসাম্রাজ্য

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সমুদ্রতুল্য তার কাব্যতৃষ্ণা, খনন, মন্থন এবং শিল্পবয়ন। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে কবিতাযাত্রায় নিরলস, অধ্যবসায়ী, বিশ্ব মানবতার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তিনি অঙ্গীকার করেন। স্বদেশের দ্রাবিড় সভ্যতার অহং, বাংলা ভাষার গীতল মহত্ত্ব, মানবিক মনস্তত্ত্ব, অধুনা জীবনের সংশয় দোলাচল তার কাব্যশরীরে আপন প্রাতিস্বিকতায় ভাস্কর হয়ে ওঠে। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার বিপুলায়তন কাব্যসম্ভার পাঠে আমরা অর্জন করি বৈচিত্র্যস্বাদু আনন্দ-অভিজ্ঞতা। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণের ব্যাপ্তি ও মন্থন তার কবিতাকে অন্যরকম মর্যাদায় উচ্চতায় স্থাপন করে। ছন্দসিদ্ধি, প্রগতিচিন্তন, লোকজ ঐতিহ্য-মিথের প্রতি সুদৃঢ় নিবিড় অঙ্গীকার দীপ্যমান হয়ে ওঠে।
টানা ৫০ বছরেরও বেশি কাব্যচর্চা ব্যাপক পঠন পাঠনজাত অভিজ্ঞানে পাঠক আবিষ্ট হন স্মৃতিমেদুর অবগাহনের সৌন্দর্য-সৌরভে। অজস্র বাঁকবদলের কোনো কোনো পর্যায়ে অধ্যাত্মচিন্তন আমরা প্রত্যক্ষ করি।
প্রাচীন গ্রিক কবি স্যাফোকে তিনি পঙ্ক্তিবদ্ধ যেমন করেন, বাংলার গৌরব লালন সাঁইয়ের একতারাও শিল্পিত বিম্বিত হয়। ‘স্যাফোর মত’ কবিতায় আমরা পাচ্ছি :
‘প্রত্যুষে আমিও জাগি সুপ্রাচীন স্যাফো,
আমারো মাংসের ধূপে সূর্যগুণপনা,
জ্বলে জ্বলে নিজেকে নির্মাণ করে যায়
না নয় না নারী সবাই আমার সঙ্গী,
শরীর বা হৃদয়ের সঙ্গে বনিবনা।

জতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় রাঙাবালি, সোনাদিয়া, মহেশখালীর কথা যেমন আছে, তেমনি সুদূর হনলুলুর মানোয়া উপত্যকা, সেখানকার সংস্কৃতি কৃষ্টি আচার ঐতিহ্যের স্বাদও আমরা পাই। স্বাদেশিকতার গণ্ডি পার হয়ে বিশ্বপঙ্ক্তিতে তিনি বাংলা কবিতাকে স্থাপন করেন। যুগপৎ প্রাচ্য-প্রতীত্যের পুরাণ থেকে তিনি আহরণ করেন মূল্যবান আকরিক, বিশ্ববীক্ষায় উদ্বোধিত করেন পাঠকবৃন্দকে। নারীসত্তার প্রতি অর্ঘ্য ও সম্মাননা নিবেদন করেন কবি। ‘আমি নারী আমি সিকোরাক্স’ কবিতায় যেমনটা আমরা লক্ষ্য করি-
‘আমি নারী আমি সিকোরাক্স
আমি অধীশ্বরা সাসাগরা এই দুনিয়ার
এখানে নোঙর নেই, নেই ব্যগ্র বিনিদ্র বন্দর
যেখানে গুটানো পাল উঁচানো মাস্তুল
সারি সারি সামুদ্রিক পোত
নেই রমণীর ইশারাইঙ্গিত, নেই আনাগোনা
পিপাসাকাতর কোনো নীল নাবিকের
নেই দূরদেশ থেকে আসা রাজারকুমার
সঙ্গে যার ক্ষিপ্র এক বিশাল বাহিনী
এই দ্বীপে অতিথির জন্যে কোনো আমন্ত্রণ নেই।

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার অনেক কবিতার বহু অনুষঙ্গ আমাদের জাতিসত্তা সম্পর্কিত। এক সাক্ষাৎকারে কবি কামাল চৌধুরীর এ বিষয়ক একটি প্রশ্নের উত্তরে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তার অবস্থান পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলছেন : আমাদের এই ভূখণ্ডের মানুষ অর্থাৎ মঙ্গোলয়েড ধারার যে মানুষ তার চেয়ে বেশি হচ্ছে শ্রীলঙ্কা থেকে আসা ভেড্ডিড গোত্রীয় মানুষের সংখ্যা। যাদের রং মূলত কালো। আমরা আদর করে বলি শ্যামলা। আবার আমাদের অধিকাংশের রং কালো থেকে একটু আলাদা, আবার আমাদের সবার রং হোমোজেনাস নয়, এই রঙের ভিতর মিশ্রণ আছে। অর্থাৎ আমরা মিশ্র রঙের- একথাটার ওপর আমি গুরুত্বারোপ করতে চাই। তাই আমি আমাদের তামাটে বলেছি। আমি দেখেছি, আমাদের এখানে শ্রমজীবী মানুষের শরীরের ওপর যখন প্রখর সূর্যের আলো পড়ে তখন তার শরীরের রং কালো থাকে না, চকচক করে- আমি দেখেছি সেটা তামাটে হয়ে যায়। আমি বলব আমরা এই ব্যাখ্যা এই ভূখণ্ডের কর্মী মানুষের ব্যাখ্যা। একটু চোখ ফেরানো যাক ‘রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি।’ রোদ্দুরে নেয়েছি একথাটা যখন আমি বলছি তখনি আমার ওই কর্মীমানুষের পিঠের কথা মনে পড়ে। সূর্যের আলো যার রং পালটে দিয়েছে। আসলে আমি যখন তামাটে মানুষের কথা বলছি আমি পোড়-খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের কথা বলছি। একটি ইতিবাচক দিক হলো আমরা এই বঙ্গীয় ভূখণ্ডে থেকেও পৃথিবীর প্রায় সব জাতির বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেছি। এটাকে এক ধরনের আন্তর্জাতিকতা বলা যায়। আমরা তামাটে জাতি বলতে যে কথাটা বুঝতে চেষ্টা করেছি সেটা হচ্ছে এই ভূখণ্ডে বসবাসরত কর্মীমানুষ, পোড়-খাওয়া মানুষ, যারা গোটা পৃথিবীর অধিবাসী।
প্রগতিবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে কবি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ব্যঙ্গ বিদ্রƒপের চাবুকে জর্জরিত হয় স্বৈরতন্ত্র, শৈল্পিক মহিমায় মূর্ত হয়ে ওঠে কাব্যিক প্রতিবাদ। ‘স্বৈরশাসক’ কবিতায় তিনি বলেছেন-
‘ডানাভাঙা বাজ
একটু হাওয়া পেলে লেফট-রাইট-লেফট
সাধ হয় পুনরায় পরবেন তাজ।’
ক্ষমতাদখল ছাড়া নাই তার কাজ।
চির অনুসন্ধিৎসু কবিসত্তা ব্যাকুল তৃষ্ণায় খুঁজে ফেরে পরশপাথর। অধ্যাত্মের অ¤øান আলোয় উদ্ভাসিত ঋদ্ধ হয় তার কবিতাযাত্রা। পবিত্র কুরআন শরীফ থেকে অনেকগুলো সুরার স্বচ্ছন্দ সুললিত গীতিময় ভাবানুবাদ তিনি করেছেন। এই কাজ প্রবল আত্মপ্রত্যয়, অধিকার ও তীব্র সত্য-তৃষ্ণার ফলেই সম্ভব। কাজটা কোনো বিবেচনায়ই মামুলি নয়, বরং দুঃসাহসের নামান্তর। ২০০৫ সালে বের হয়েছিল কুরআন কাব্য আমপারা। সেখানে সুরা ফাতিহার বাংলা ভাষ্য এখানে উদ্ধৃত হলো :

সুরা ফাতিহা
দয়াময়, দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করি
সমস্ত প্রশংসা তার,
যাঁর হাতে দুনিয়ার ভার।
জগতের প্রভু তিনি, দয়ার আধার;
করুণাময়ের হাতে শেষ বিচারের ভার;
আমরা বন্দেগি করি কেবল তোমার;
আমরা সাহায্য চাই কেবল তোমার;
দেখাও সরল পথ, যে পথে হয়েছে পার
প্রিয়জন; ভ্রষ্টজন যে পথে গজবে ছারখার
সে পথে যাবো না আমি, সে নয় আমার।
গীতলতা তার কবিতার অন্যতম চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য। হ্রস্ব-দীর্ঘ আয়তনের বহু বহু কবিতায় এ বৈশিষ্ট্য প্রস্ফুট, বিকশিত, সুরভিত। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত একটি কাব্য গ্রন্থের নাম ‘গালিবের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক।’ ওই গ্রন্থের ‘গালিবের কাছে প্রার্থনা’ কবিতার খণ্ডাংশ

ফুটলেই ঝরে যাবে, এই ভয়ে আজো ফুটলে না।
২.
তবু বিদায়কে বলিনি, বিদায়।
গালিব কি ভুলেছিল দু-বাহুর দায়?
৩.
বালুচরে উড়ে এলি, আমি তোকে চিনি।
পাখি, তোর পাখা ছিল কি? পা-তো দেখিনি।
৪.
আমি তো উড়তেই চেয়েছিলাম।
তারপর কখন পা-দুটো নিয়েই ফিরে এলাম।
৫.
আড়ালে ছিলে, ডালে ছিলে না।
ডালে যদিও পাতা ছিল, কাণ্ডের নিচে শেকড় ছিল না।
মুহম্মদ নুরুল হুদা তার কবিতায় মিথ ব্যবহার করেছেন প্রচুর। প্রয়াত অনু হোসেন তাকে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার রচনায় একটি বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়- সেটি হচ্ছে মিথ। আপনার রচনায় প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য মিথের ব্যবহার রয়েছে, আপনার কবিতার শোণিতে এই মিথ কি ভূমিকা পালন করে?
কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার উত্তর ছিল :
“আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পাঠের সময় একটা বিষয় অবশ্যপাঠ্য ছিল : গ্রিক পুরাণ। গ্রিক পুরাণ পড়তে গেলে এক ধরনের বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে যেতে হয়। সে বিস্ময় আমার ভিতরেও ছিল। স্বাভাবিকভাবেই আমি যখন আমার সাহিত্যজীবন শুরু করি তখন মিথ আমাকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। আমার পঠনপাঠন থেকে এটা জেনেছি যে মিথ হুবহু যা আছে তাকে যদি আমি বর্ণনা করি- তাহলে এটি নতুন কোনো সাহিত্য ভাষ্য নিয়ে দাঁড়ায় না। সাহিত্যে মিথের আধুনিকীকরণ, মিথকে যদি সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে উন্নীত করা না যায় তাহলে সে মিথের ব্যবহার একটি মৃত বস্তুতে পরিণত হয়। যে ইউলিসিসকে ব্যবহার করেছেন
জেম্স জয়েস, সে ইউলিসিস একটা মিথ, কিন্তু জেমস জয়েস তাকে বিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে দাঁড় করিয়েছেন। আমার অতীত সহযাত্রীদের দৃষ্টান্ত-থেকে এইটুকু বুঝতে পারি- মিথের ব্যবহার আমি যখন করব তখন তাকে আমার সমকালীনতার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এবং তার ভিতর এমন বিষয় উপ্ত রাখতে হবে- যা ভবিষ্যতে আবার নতুন কোনো মিথের জন্ম দেবে। কাজেই মিথ যখন আমি ব্যবহার করি- অতীত চর্চা হিসাবে ব্যবহার না করে তাকে ঐতিহ্যের সঙ্গে সংলগ্ন রাখার চেষ্টা করেছি। সে কারণেই সম্ভবত মিথকে আমি ভেঙেচুরে নতুন ভাষ্য তৈরি করতে পেরেছি। এ প্রশ্নের সঙ্গে আমি একটা কথা যুক্ত করে দিতে চাই। আমি শুধু গ্রিক মিথ ব্যবহার করেছি এমন নয়- ‘শুক্লা শকুন্তলা’ বলে আমার যে কাব্যগ্রন্থটি আছে- তা পুরোপুরি শকুন্তলা মিথনির্ভর। শকুন্তলার ভিতরও আমি সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতীকী হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। সফলতা-বিফলতা আমার বিবেচ্য নয়। তবে আমার পঠনপাঠনের ভিতর আমার যতদূর মনে হয় আমি যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং আমার ইংরেজি অনার্স ক্লাসে প্রচুর গ্রিক মিথ আমাকে পড়তে হয়েছে; তো পাশ্চাত্য মিথ আমার একটি প্রিয় বিষয়। আমি এখন বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি প্রাচ্য মিথ-উপকথা, লিজেন্ড, রূপকথা এগুলোকে গ্রহণ করতে। আর একটি প্রকল্প আমার হাতে রয়েছে সেটা হচ্ছে শেক্সপিয়ার। শেক্সপিয়ারকে ব্যবহার করা মানে এক ধরনের মিথকে ব্যবহার করা। কাজেই আমার মনে হয় আমি দুদিকেই কাজ করে যাচ্ছি। মনে হয় আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি শেক্সপিয়ারে।”

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়