জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সর্বশেষ রিলিজ স্লিপের মেধা তালিকা ২ অক্টোবর

আগের সংবাদ

ইউক্রেনের ৪ অঞ্চল রাশিয়ায় যুক্ত : প্রেসিডেন্ট পুতিনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, অবৈধ বলছেন ন্যাটো নেতারা

পরের সংবাদ

আমি একটি খাস প্রজাতন্ত্র চাই : বহুমাত্রিক জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘জাতিসত্তার কবি’ হিসেবে যেমন সমধিক পরিচিত, তেমনি ‘দরিয়া পাড়ের কবি’ হিসেবেও রয়েছে তার সুখ্যাতি। বাঙালির নৃ ও ভৌগোলিকসত্তার ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণ কাব্যকৃৎকৌশলের নান্দনিক উৎকর্ষে মূর্ত হয়েছে তার কবিতার পরতে পরতে; উঠে এসেছে হাজার বছরের সংগ্রাম আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার অসম সাহসী বিপ্লবের কথা। নৃ ও ভৌগোলিকসত্তা যদি হয় দেহ তবে সংস্কৃতিসত্তা নিঃসন্দেহে তার আত্মা- আর এ দুয়ের মিলনেই নির্মিত হয় জাতিসত্তা। যুগ পরিক্রমায় নৃ-ভূগোল আর ভাষার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা নির্মাণ করেছি বাঙালি নৃ-গোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র, পেয়েছি মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাংলা নামের ভাষা। এই বাংলা ভূখণ্ডেরই দক্ষিণের দরিয়া পাড়ে জন্ম নিয়েছেন এক কবি; নিজ জাতির দেহ ও আত্মসত্তার স্বরূপ যিনি উন্মোচন করেছেন নান্দনিক কাব্যভাষ্যে, তিনি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা- আমাদের জাতিসত্তার কবি।
‘যত দূর বাংলা ভাষা তত দূর এই বাংলাদেশ’ বলে তিনি স্পর্ধিত অহংবোধে উচ্ছ¡সিত হয়ে বাংলা ভাষা, নিজস্ব ভূগোল বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের শ্রেষ্ঠত্বের ইশতেহার ঘোষণার মধ্য দিয়ে জানিয়ে দিতে চান যে বাংলা ভাষা এখন আর শুধু বাঙালি জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রকৃতই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা ভাষা; বাঙালির আবাস এখন এ গ্রহের আনাচে-কানাচে। যেখানে বাংলা ভাষা, যেখানে বাঙালি, সেখানেই আত্মস্থ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচার-সংস্কৃতি- এ যেন বাংলাদেশেরই আন্তর্জাতিক সংস্করণ। এক্ষেত্রে একটি কথা স্মরতব্য যে, ভারত অধ্যুষিত বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকলেও তারা কিন্তু ভারত বর্ষেরই প্রতিনিধিত্ব করে; কোন স্বাধীন-সার্বভৌম নৃ-ভূগোল-ভাষার নয়। সুতরাং এ সেøাগানের তাৎপর্য বাংলা জাতিগোষ্ঠীর গভীর আত্মোপলব্ধির বিষয়। কিন্তু একটি বিষয় প্রায়ই আমাদের নজরে আসে না বা আমরা সযতনে এড়িয়ে যাই, তা হলো এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলা ভূখণ্ডে বাংলাভাষী ও নৃগোষ্ঠীর বাইরেরও অনেকে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী রয়েছে। তাদেরও রয়েছে নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-মিথ-রূপকথা-উপকথা, তদোপরি সংগ্রাম-বিদ্রোহের মতো আত্মশ্লাঘ্য বিষয়। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় তাদের সংগ্রামী জীবন-সংস্কৃতি-মিথ প্রভৃতিও যখন কাব্যিক ভাষা পেয়ে যায়, তখন তিনি মহৎ শিল্পী হিসেবে তার অবস্থান আরো দৃঢ় করেন। ‘আমি একটি খাস প্রজাতন্ত্র চাই’ কবিতাগ্রন্থ পাঠে যে কোনো পাঠক এ বক্তব্যের সারাৎসার খুঁজে পাবেন। ‘আসিমালজা’ কবিতার কিছু উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করা যায় :
আসিমালজার কথা মনে পড়ে।
মনে পড়ে সেই আদি সাংসারেক দম্পতির কথা।
আসি নারি, মালজা তার আচিক পুরুষ।
নাম শুনে এখনো আঁতকে ওঠে মান্দি আর মানব সমাজ।

কেন তারা অপবিত্র করেছিল সর্বমান্য দেব আর দেবীর নিবাস?
হঠাৎ সরিয়ে নিলো, কেন তারা, পাহাড়ের চূড়া থেকে সার্বভৌম দেবতার পাথর?
ফসল উৎপন্ন করে কেন তারা উৎসর্গ করেনি তা তাতারার উদ্দেশ্যে প্রথম?

শুধু জানা আছে, একদিন রোদেলা দুপুরে
হিং¯্র বাঘের পেটে আসি প্রাণ হারালো বেঘোরে,
মালজাও চলে গেল খুব ভোরে কুমিরের পেটে।

সালজং দেবতা আসি সেগ্রী দতদী পাগড়ী নামক এক নারীকে ধূপ জ¦ালাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আসির ধূপ এতই সুগন্ধী হয়েছিল যে দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে মান্দিদের এই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ করেছিলেন যে প্রতি বছর এই সময়ে তারা যেন তার নামে প্রথম ফসল উৎসর্গ করে, ধূপ জ¦ালায়। সেই থেকে প্রতি বছর বিভিন্নভাবে পালিত হয় ওয়ানগালা উৎসব। সালজং দেবতার সঙ্গে মানুষের যে আদি চুক্তি তার অনুষ্ঠানই ওয়াংগালা। আচিকরা সাংসারেক বিশ্বাস অনুসারে ধূপ জ¦ালিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। যদি তা না করা হয় তাহলে সালজং দেবতা অসস্তুষ্ট হয়ে কঠোর শাস্তি দিবেন বলে বিশ্বাস করা হয়, যাকে বলা হয় আসি মালজা। কারণ আসি ও মালজা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে, দেবতাদের সন্তুষ্ট না করায় যে করুণ পরিণতির শিকার হয়েছিল, তা তারা জানে। যে আচারসমূহ শুধু দেবতাদেরকেই তুষ্ট করার জন্য; মানবের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য নয়- সে সমস্ত প্রচলিত আচারনিষ্ঠার বিরোধী ও প্রতিবাদী যারা- তারা নিজগোত্র-গোষ্ঠীতে অবজ্ঞাত হলেও তারাই সময়ের পরিক্রমায় অবশেষে নমস্য হয়ে উঠে। শপথ ভঙ্গের অপরাধে তারা মহাপাপী না সর্বজনের মহাদাত্রী ‘রাণীখং সুুড়ঙ্গের বুকে হাজার প্রশ্নের ঘূর্ণি’ তুললেও একসময় ঠিকই প্রতিষ্ঠিত হয় তারা গোত্রের মুক্তিদাতা হিসেবেই এসেছিলেন।
‘দরিয়া পাড়ের’ এই কবি বাংলা ভূমির দক্ষিণ প্রান্তের সমুদ্র আর উত্তর প্রান্তের সোমেশ্বরীকে এক মেলবন্ধনে এনে সমতলের বাঙালি আর গারো পাহাড়ঘেঁষে বসবাসকারী মান্দিদের একসূত্রে গেঁথে দেন:
উত্তরেই সোমেশ্বরী, অনন্তর পাহাড়ের আঙ্গিনায় চুনাপাথরের ঘনিষ্ঠ খামার
গারোস্রোতে বয়ে চলে কামরূপ কামাখ্যার তন্ত্র-সার, সাংসারেক মায়ের সংসার
ওয়াংগালা দেবতার ধ্যান ছেড়ে আজ তারা ঈশ্বরের সন্তানের গূঢ় প্রতীক্ষায়

দক্ষিণ সমুদ্রে যাবে, দুই নদী অদলবদল করে দুই বুকে ভাটা ও উজান (উত্তরেই সোমেশ্বরী)

‘আমি একটি খাস প্রজাতন্ত্র চাই’ কবিতাগ্রন্থে কবি মুহম্মদ নূরল হুদা রাজনৈতিক স্যাটায়ারকে শৈল্পিক পর্যায়ে সংস্থাপিত করেছেন। গ্রন্থের নাম কবিতা থেকে আমরা পাঠ নিতে পারি:
আপনারা প্রজা দেখেন না, মজা দেখেন
ব্যক্তি দেখেন না, শক্তি দেখেন
দল দেখেন না, বল দেখেন
ভোট দেখেন না, জোট দেখেন
দায় দেখেন না, সায় দেখেন
মমতা দেখেন না, ক্ষমতা দেখেন
আপনারা অন্যকে দেখেন না, কেবল নিজেকেই দেখেন।
২০০৬ সালের নভেম্বরে লেখা এই কবিতায় কাদের উদ্দেশ্যে এই বয়ান তা পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ইসলামিক মিথ ইয়াজুজ-মাজুজকে সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মিথস্ক্রিয় করে তিনি যখন নান্দনিক কাব্যকুশলতায় নির্মাণ করলেন:
রূপকথার ইয়াজুজ ছিলেন গণপতি
চুপকথার মাজুজ ছিলেন রণপতি
দুজন মিলে একদেশে একবেশে হয়ে গেলেন ইয়াজুজ-মাজুজ
তখন তাদের অভিন্ন নাম হলো গণরণপতি।

রাজ্যের তাবৎ আইন-কানুন সংশোধন করে
গণরণপতি সাজালেন তার উত্তরবাগান

সান্ত্রীসেপাই পাইকপেয়াদা ঘিরে রাখলো তার সুরম্য ভবন
কেননা তিনি রপ্ত করেছেন তার সঙ্গোপন সিলেকশন

ভবনের চারপাশে উৎসুক জনগণবান, রাজা শুরু করেছেন মহাধ্যান
বাতাসে একটি পঙ্গু মশা উড়ে গেলেও গর্জে উঠছে হাজার কামান (ইয়াজুজ-মাজুজের দেশে)

তখন আমাদের ইয়াজুদ্দিনীয় ষড়যন্ত্রীয় শাসন আমল আর বিশেষ ভবনের কথা মনে পড়ে যায়।

‘আমি একটি খাস প্রজাতন্ত্র চাই’ কাব্যের প্রতিটি কবিতাই প্রাণশক্তিতে ভরপুর। কবিতার প্রাণশক্তি কী? না, ছন্দ, উপমা, প্রতীক, অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি কাব্যকৃৎকৌশলে সুনির্বাচিত শব্দে নির্মিত হয় কবিতা। আর এভাবে নির্মিত কবিতার প্রধান অবলম্বন যদি হয় ভাব বা চেতনা, তবে তাকেই আমরা বলতে পারি প্রাণ। মানব মনের এই বিচিত্র ভাবই দার্শনিকতা, যা মূলত কবিতার প্রাণ। প্রাণহীন কবিতা- কাব্যকৌশলে যতই কাব্যসৌন্দর্য পাক না কেন- তা মানুষকে শুধু বিভ্রান্তই করে। ‘আর্ট ফর আর্টসেক’ বলে যতই যুক্তি দেখানো হোক না কেন তা মূল্যহীন, অসার। মহান প্লেটো ‘রিপাবলিক’-এর দশম পুস্তকে মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের বয়ানে গøকনকে যা বলেছেন, তা এ প্রসঙ্গে তা উল্লেখ করা যায়: ‘কিন্তু তার শব্দের মাত্রা এবং ছন্দ এবং তার সংগীত মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। সাধারণ মানুষ যারা নিজেরা কবির মতোই অজ্ঞ, যারা কেবল শব্দের ভিত্তিতেই কোন বিষয়কে বিচার করে তারা মনে করবে, এ কবির পাদুকা প্রস্তুতকারক কিংবা যুদ্ধ পরিচালনা কিংবা ইত্যাকার সব বিষয় সম্পর্কেই গুরুতর বক্তব্য একটা কিছু রয়েছে। এরূপ প্রবল হচ্ছে কাব্যের স্বভাবগত জাদুর ক্ষমতা। কবির এই বক্তব্যকে তুমি তার কাব্যিক বর্ণলেপ থেকে মুক্ত করে ফেল, সাধারণ গদ্যে তাকে পরিণত কর, তাহলেই তুমি দেখবে, সে বক্তব্য কত মূল্যহীন।’ কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার এ কাব্য পাঠে আমাদের সহজেই প্রতীতি হয় যে, সুচিন্তিত ভাব বা চেতনার কাঠামোতেই তিনি নির্মাণ করেছেন এর সব কবিতা। তার কবিতার অভ্যন্তরে ফল্গুধারার মতো বহমান দার্শনিক ভাবনা, তথা প্রবল প্রাণশক্তি।

এই কবিতাগ্রন্থে বড় কবিতার পাশাপাশি কিছু স্বল্পায়তনিক কবিতাও রয়েছে। স্বরবৃত্ত আবার কখনো মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগে আভাসিত এই সমস্ত কবিতা উপমা, ধ্বনি ও প্রতীকের রহস্যময়তায় পাঠকহৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রাখে; কোনো কোনো কবিতার পঙ্ক্তি যেন প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে।
১. আকাশ তবু চায়
আকাশের ডানা বাড়াবার। (পালক খসানোর গল্প)

২. বুশের আসনে আসুক বুদ্ধ
চাই প্রশান্তি, চাই না যুদ্ধ। (বুশের আসনে আসুক বুদ্ধ)

তবে ‘সফরখণ্ড ৪: ঘরে ফেরা’ কবিতাটি এ গ্রন্থের আকর কবিতা বলে আমাদের মনে হয়। কেন মনে হয় সে ব্যাখ্যায় না গিয়ে পুরো কবিতটিই এখানে তুলে দেয়া হলো:
সব ঘুরে দেখি সেই এক ঘর
কোথাও তুষার ঢাকা, দ্বার নেই খোলা
ঢোকার আগেই শুনি চিরচেনা স্বর
কপাটবিহীন দোর, পর্দাটা তোলা
উড়ে ঘুরে হলো যেই নিজ ঘরে ফেরা
আমার মাটির শয্যা দুনিয়ার সেরা।

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘আমি একটি খাস প্রজাতন্ত্র চাই’ কাব্যের কবিতায় দার্শনিকতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা, রোমান্টিক আবেগ, নস্টালজিকতা, স্বপ্ন ও তা ভঙ্গের যন্ত্রণা, নৃতাত্ত্বিক বয়ান, পথদিশারীদের স্মরণ, সর্বোপরি দেশমাতা-মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে নান্দনিক কুশলতায়। ভাষা-রূপকল্প আর অলঙ্কারের নৈপুণ্যে বহুমাত্রিক জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাতে। বিচিত্র অনুভবের স্পর্শে স্নাত কবিতার বইটির অনেক কবিতার সঙ্গে পাঠক যেমন আত্মিকভাবে সংযুক্ত হতে বাধ্য, তেমনি কিছু পঙ্ক্তি পাঠকের মনে প্রবাদের মতো গেঁথে থাকবে। কবি সৃষ্টিশীল থাকুন সদা-সর্বদা; জয় হোক কবিতার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়