সোনারগাঁওয়ে দলিল লিখককে হত্যা স্ত্রী আটক

আগের সংবাদ

জন্মদিনের শুভেচ্ছা : জননেত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার

পরের সংবাদ

বাধা কাটলেই এশিয়ায় রোল মডেল হবে বাংলাদেশ : বিশ্ব পর্যটন দিবস আজ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শরীফা বুলবুল : পর্যটনের অপার সম্ভাবনার হাত ধরে নানা উদ্যোগ নিলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ভিসা জটিলতা, যোগাযোগ ক্ষেত্রে হয়রানিমূলক আচরণের সঙ্গে সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার বাধা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের পর্যটন খাত। এর ওপর নতুন করে ধর্ম ব্যবসায়ীদের বাধা ও সামাজিক রক্ষণশীলতা এ খাতকে রীতিমতো চোখ রাঙাতে শুরু করেছে। তবে সম্ভাবনাময় পর্যটন খাতের ব্যবসায়ী আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান বাধা কাটলেই বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে এশিয়ায় পর্যটন খাতের রোল মডেল।
করোনা মহামারিকালে খানিকটা ভাটা পড়লেও গত কয়েক মাসে আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পর্যটন খাত। অভ্যন্তরীণ পর্যটন স্পটগুলোতে আবারো ঢল নেমেছে পর্যটকদের। তাছাড়া প্রচলিত স্পটের বাইরে তৈরি হওয়া নতুন নতুন স্পটেও ভিড় বাড়ছে। বিশেষ দিনগুলোর পাশাপাশি মানুষের মধ্যে ভ্রমণে আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সেই সঙ্গে করোনা মহামারির বাধা কাটার পর বিদেশিরাও আসতে শুরু করেছেন। এতে আশাবাদী হয়ে উঠছেন পর্যটন খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।
যদিও করোনা মহামারির আগেই সরকার পর্যটন খাতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে কক্সবাজারকে গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন জোন হিসেবে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্রে রূপ দিতে ২০১৬ সালে টেকনাফের সাবরাংয়ে ‘সাবরাং অর্থনৈতিক অঞ্চল’ নামে পর্যটনকেন্দ্রের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের সব সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন পর্যটন স্পট। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নাফ নদীর বুকে জেগে ওঠা জালিয়ার দ্বীপের ২৭১ একর ভূমির ওপর গড়ে উঠছে নাফ ট্যুরিজম পার্ক। ইতোমধ্যে ৪৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮০ কিলোমিটারের বিশ্বমানের সড়কটি মেরিন ড্রাইভ কলাতলী হয়ে সাগরের কূল ঘেঁষে সাবরাং অর্থনৈতিক অঞ্চলে সংযুক্ত হয়েছে।
পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, পর্যটনের মেগা এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে গোটা কক্সবাজার অঞ্চল। শুধু তাই নয়, করোনার আগে ২০১৮ সালে সরকার পর্যটনের ২৭টি স্থানকে চিহ্নিত করে ৪৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়। যার মধ্যে রয়েছে মাধবকুণ্ড, রাতারগুল, মাধবপুর লেক, বিছানাকান্দি, পানামনগর, ময়নামতি, নীলাচল, মেঘলা অবকাশ কেন্দ্র, বগুড়া মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, কক্সবাজার, সুসংদুর্গাপুর, বিজয়পুর, কুয়াকাটা, ষাটগম্বুজ

মসজিদ, টেকের ঘাট, শ্রীমঙ্গল ও বাকের টিলাসহ অন্যান্য স্থান। এছাড়া পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে দেশের অন্তত ৩৬ জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে অপ্রচলিত কয়েকশ পর্যটন স্পটকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পর্যটন খাতের উদ্যোক্তা আর অর্থনীতিবিদদের মতে, পর্যটন খাতের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি বাধাগুলো দূর করা হলে এশিয়ায় পর্যটনে রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ। তারা বলছেন, পর্যটন শিল্প বিকাশের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমাদের বেশি। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের বেশি আকর্ষণ করে। পর্যটনশিল্পের সব বাধা কাটিয়ে এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় খাত হয়ে উঠবে এটি।
প্রতিবেশীসহ বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশ পর্যটনের বিশ্ববাজারকে ধরতে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর মধ্যে প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, চীন, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ পর্যটন খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়িয়েছে বহুগুণ। মালেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যটনশিল্পের অবদান অনেক বেশি। গত প্রায় অর্ধযুগ ধরে বিপুলসংখ্যক পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে থাইল্যান্ড। সার্কভুক্ত নেপালের জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশের জোগান দেয় পর্যটন খাত। সমীক্ষা মতে, জিডিপিতে পর্যটনশিল্পের অবদান সিংঙ্গাপুরে প্রায় ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ান, হংকং, ফিলিপাইন ৫০ শতাংশের বেশি। মালদ্বীপের প্রায় পুরোটা, ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকোর মোট রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশই পর্যটনে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একেবারে পেছনের সারিতে রয়ে গেছে।
অথচ বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন ছাড়াও দেশে প্রচলিত কয়েকশ পর্যটন স্পটের বাইরে রয়েছে আরো অনেক অপ্রচলিত স্পট । যেসব স্পট পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তুলতে পারলে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আয় আসতে পারে পর্যটন খাত থেকে।
পর্যটন খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিরাপত্তাহীনতার বাধা দূর করা যাচ্ছে না কিছুতেই। এর ওপর আবার বিদেশি পর্যটকদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ভিসা জটিলতা। পাশাপাশি রয়েছে দূরবর্তী স্পটগুলোর ক্ষেত্রে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। এর ওপর আবার পর্যটকদের পছন্দের পণ্যের বিপরীতে অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের প্রবণতা দেখা যায়। সেবা দাতাদের হয়রানিমূলক আচরণের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে সার্বিক নিরাপত্তাহীনতা, ধর্ম ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি আর সামাজিক রক্ষণশীলতা। এসব বাধা দূর হলে ঘুরে দাঁড়াবে গোটা পর্যটন খাত।
জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম ভোরের কাগজকে বলেন, কেবল ভিসা এবং নানা জটিলতাই নয়, আসলে দেশকে ব্র্যান্ডিং করাই হচ্ছে না। এসব উদাসীনতার কারণেই পর্যটন এগোতে পারছে না। তিনি বলেন, নিরাপত্তা ঝুঁকি কম বেশি পৃথিবীর সব দেশেই আছে। কিন্তু ব্র্যান্ডিংটা আন্তর্জাতিক মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি ই-ভিসা, রোড শো চালু করতে হবে। এসব জটিলতার বাধা কেটে গেলে বাংলাদেশ হবে এশিয়ায় রোল মডেল।
ট্যুর অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ রাফিউজ্জামান রাফি বলেন, বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প বিকাশে অবারিত সুযোগ রয়েছে। তবে পর্যটন বিকাশে পেশাদারিত্ব থাকা প্রয়োজন, আমাদের দেশে যা এখনো গড়ে ওঠেনি। পেশাদারিত্ব থাকলে বিদেশিরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে।
তিনি বলেন, বিদেশি পর্যটকনির্ভরতা ছাড়াও দেশের পর্যটকের নিরাপত্তা, যোগাযোগের সুবিধা, আকর্ষণীয় অফার দিলে মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেশ ঘুরে দেখতে চাইবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী আশার কথা শুনিয়ে ভোরের কাগজকে বলেন, বিদেশি পর্যটকদের অনেক ধরনের চাহিদা আমরা মেটাতে পারছি না। তবে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ শুরু হবে।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সংকট থেকে উত্তরণের উপায় ও ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক পর্যটন বাজারে সুবিধা অর্জনের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ইতোমধ্যে একটি ‘ট্যুরিজম রিকভারি প্ল্যান’ নিয়েছে। এই পরিকল্পনায় উল্লিখিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০টি গাইডলাইন প্রস্তুত করে সেই অনুযায়ী কাজ করছে। যার ফলে ইতোমধ্যে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গতি ফিরছে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্পে।
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন সচিব মোকাম্মেল হোসেনও একই আশার কথা শোনালেন। তিনি বলেন, আমরা মাস্টার প্ল্যান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ট্যুরিজম খাতে আগামীতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা নিয়ম মাফিক এগিয়ে যাচ্ছি। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। ভবিষ্যতে ট্যুরিজম শিল্পে বাংলাদেশ আরো ভালো করবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের গবেষণা এবং পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক (উপসচিব) মো. সাইফুল হাসান বললেন, ‘এক্সক্লুসিভ ট্যুরিজম জোন ফর ট্যুরিস্ট’ করার কথা ভাবছি আমরা। যেখানে কেবল ট্যুরিস্টরাই তাদের ইচ্ছে মতো অবাধ ঘোরাফেরা করতে পারবে। এছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইউনাইটেড নেশনস ভলান্টিয়ারের সহায়তায় ট্যুরিস্ট পুলিশের উইং বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়