সহিংসতা প্রতিরোধে মাঠে থাকবে ১৪ দল

আগের সংবাদ

পঞ্চগড়ে নৌকা ডুবে নিহত ২৫, নিখোঁজ অর্ধশতাধিক : করতোয়া তীরে শোকের মাতম

পরের সংবাদ

যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা থামান শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তুলুন : জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শামীম আহমেদ, নিউইয়র্ক থেকে : যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং একতরফা নিষেধাজ্ঞার পথ পরিহার করে বিরোধ নিরসনে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়তে রাশিয়া-ইউক্রেনসহ বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের ৭৭তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ভাষণে শুক্রবার এ আহ্বান জানান তিনি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ বা একতরফা জবরদস্তিমূলক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মতো বৈরীপন্থা কখনো কোনো জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনাই সংকট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বরাবরের মতো এবারো জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চেয়ে শেখ হাসিনা আরো বলেন, নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেয়া হয়। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং সব মানুষের জীবন-জীবিকা মহাসংকটে পতিত হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। মানুষ খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে, শিশুরাই বেশি কষ্ট ভোগ করে। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে যায়। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি সংঘাতের মূল কারণগুলো সমাধান না করে আমরা শান্তি বজায় রাখতে পারি না। আমরা দেখতে চাই, একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব- যেখানে থাকবে বর্ধিত সহযোগিতা, সংহতি, পারস্পরিক সমৃদ্ধি এবং ঐকবদ্ধ প্রচেষ্টা। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই গ্রহকে আরো সুন্দর করে রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।
মোট ৩৫ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান শুক্রবার সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দেয়ার কথা থাকলেও তিনি বিকাল ৫টার কয়েক মিনিট পর ভাষণ শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে কোভিড মহামারি মোকাবিলায় তার সরকারের সাফল্য, রোহিঙ্গা ইস্যু, সন্ত্রাস দমনে জিরো টলারেন্স নীতি, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী আবাসন নিশ্চিত করতে তার সরকারের উল্লেখযোগ্য অবদান, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু

পরির্তন, খাদ্য নিরাপত্তা, প্যালেসটাইন সংকট, নিরাপদ অভিবাসনসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু তুলে ধরেন।
১৯৩টি সদস্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, এই অধিবেশন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, সহিংসতা ও সংঘাত, কোভিড-১৯ মহামারির মতো একাধিক জটিল এবং বহুমাত্রিক প্রতিকূলতায় পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহ আজ জর্জরিত। মানবিক চাহিদা গভীর হচ্ছে, জলবায়ু লক্ষ্যগুলো মূলত অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে, বৈষম্য আরো প্রকট হচ্ছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহায়তা প্রার্থী ঝঁকিপূর্ণ দেশগুলো এখন আরো প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে। বর্তমানে আমরা এমন একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছি, যখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক পারস্পরিক সংহতি প্রদর্শন করা আবশ্যক। তিনি বলেন, আমাদের প্রমাণ করতে হবে, সংকটের মুহূর্তে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো জাতিসংঘ। তাই সর্বস্তরের জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য জাতিসংঘকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সবার প্রত্যাশা পূরণে কাজ করতে হবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, ‘গেøাবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ’ গঠন করায় জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই গ্রুপের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, আমি বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব ও সংকটের গভীরতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বৈশ্বিক সমাধান নিরূপণ করতে অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি জাতির পিতার রেখে যাওয়া পররাষ্ট্র নীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, করো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এর উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রতিপাদ্য-উদ্ভূত জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে আসছে।
কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকে এ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ মূলত তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে কৌশল নির্ধারণ করেছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, প্রথমতো মহামারি সংক্রমণ ও বিস্তাররোধ করতে আমরা জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত করেছি। দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে কৌশলগত আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করেছি, এবং তৃতীয়ত, আমরা জনগণের জীবিকা সুরক্ষিত রেখেছি। এসব উদ্যোগ মহামারিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস করার পাশাপাশি মানুষের দুর্ভোগ কমাতে সাহায্য করেছে, বলেন তিনি।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৭ সালে স্বদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে তাদের গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশের ইতোমধ্যে পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক এবং জাতিসংঘসহ অন্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি। মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরো দুরূহ করে তুলছে। আশা করি, এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বিশ্বসভায় প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরো বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানবপাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বেড়েছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে। এ সংকট প্রলম্বিত হতে থাকলে তা এই উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব। জলবায়ু নিয়ে প্রতিশ্রæতি দেয়া আর ভাঙার একটি দুষ্টচক্র আমরা অতীতে দেখেছি। আমাদের এখনই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের আমলে দ্রুতগতিতে দেশ এগিয়ে যাওয়ার বাস্তবচিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে বলেন, একটি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং সামাজিক সম্প্রীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপির হিসাবে আমাদের অবস্থান ৪১তম। বিগত এক দশকে আমরা দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র এক দশকে তিনগুণ বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেন, কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পূর্বে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক এক পাঁচ শতাংশ। এর আগে, আমরা টানা তিন বছর ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। মহামারি চলাকালেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬ দশমিক নয় চার শতাংশ হারে প্রসারিত হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার জন্য এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও জলবায়ু-সহিষ্ণু ব-দ্বীপে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, মা ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত এক দশকে সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছি। আমাদের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২১ জনে এবং প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু হার ১৭৩ জনে নেমে এসেছে। মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছরের অধিক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ মনযোগ দিয়েছি যাতে সমাজের কেউ পিছিয়ে না থাকে। স্বামী-পরিত্যাক্তা নারী, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তৃতীয় লিঙ্গ এবং অন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় উপকৃত হচ্ছেন।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ এক অনন্য সাফল্য বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, উন্নত ভৌত অবকাঠামো মজবুত অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এজন্য আমরা নদীর তলদেশের টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেমসহ টেকসই বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ করছি। আমাদের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’। এটি বাংলাদেশের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সহজতর করবে এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে। এই সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক দুই-তিন শতাংশ হারে অবদান রাখবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়