সহিংসতা প্রতিরোধে মাঠে থাকবে ১৪ দল

আগের সংবাদ

পঞ্চগড়ে নৌকা ডুবে নিহত ২৫, নিখোঁজ অর্ধশতাধিক : করতোয়া তীরে শোকের মাতম

পরের সংবাদ

জগৎ জননীর আগমনী বার্তা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শরতের শিশিরভেজা ঘাস, আকাশের শ্বেত শুভ্র বিস্তৃত অবারিত রূপ আর কাশফুলের ছন্দের তাল প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিকেও আলোড়িত করে প্রবলভাবে। কারণ এ যে জগৎ জননীর আগমনীরই বার্তা দেয় প্রতিটি বাঙালির মনে। সবুজ ঘাসের ওপর শিউলি ফুলের গালিচায় অরুণরাঙ্গা চরণ ফেলে মা এই ধরাধামে উপস্থিত হন বলেই বিশ্বাস করে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। হাজার হাজার বছর ধরেই এভাবেই হয়ে এসেছে বাঙালি হিন্দুদের মাতৃ অভ্যর্থনা। মাতৃশক্তি দেবী দুর্গার মর্তে আগমনীর আরম্ভই হয় মহালয়ার মধ্য দিয়ে। ঢাকের বাদ্য, শিউলি ভেজা ভোরে মাতৃবন্দনায় আত্মনিয়োগকৃত মন আর শ্রীবিরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডিপাঠ এ যেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে ধরা দেয় প্রতিটি সনাতনী বাঙালির হৃদয়ে। প্রকৃতিই যেন এক শুভ বার্তা ছড়িয়ে দেয় চারিধারে। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘মহালয়’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত উৎস ‘মহৎ এবং আলয়’। কিংবা মহত্ত্বের আলয়ও বলা যেতে পারে। শাস্ত্রমতে ‘পিতৃপক্ষের শেষক্ষণ ও মাতৃপক্ষের সূচনাকালের সময়কেই মহালয়া বলা হয়। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ শুরু হয়ে পরবর্তী অমাবস্যা পর্যন্ত সময়কে পিতৃপক্ষ বলে। পুরাণ মতে, ব্রহ্মার নির্দেশে পিতৃপুরুষরা এই ১৫ দিন মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসেন। তাই এই সময় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু অর্পণ করা হলে তা সহজেই তাদের কাছে পৌঁছায়। তাই গোটা পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষদেব স্মরণ ও মননের মাধ্যমে তর্পণ করা হয়। যার চূড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হলো এই মহালয়া। সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে এবং বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বদের সঙ্গে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তর্পণ মানে পূর্বপুরুষদের উৎসর্গ করে অঞ্জলি প্রদান। এই মহালয়ার দিনে তাই তর্পণ দেয়া হয়। অনেকেই এই দিনটিকে দেবীপক্ষের সূচনা বলে থাকেন। এটি একটি জনপ্রিয় কৃতকর্ম। মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষ দিন। পরের দিন শুক্লা প্রতিপদে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। সেই দিন থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫ দিনই হলো দেবীপক্ষ।
দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া এবং নারীরূপে বিশ্বের পরম শক্তির প্রকাশ। তিনিই মহিষাসুর-মর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চণ্ডী, ল²ী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে বিভিন্নভাবে তার পূজা হয়ে থাকে। দেবী বন্দনার যে স্তোত্র রয়েছে সেখানে দেবী ‘মাতৃরূপে’, ‘পিতৃরূপে’, ‘শক্তিরূপে’, ‘শান্তিরূপে’, ‘বিদ্যারূপে’ আবির্ভূতা হিসেবে পূজিতা। ‘দেবী ভাগবত’, ‘মার্কণ্ডেয় চণ্ডী’ ও ‘কালিকা পুরাণ’ অনুসারে জানা যায়, পুরাকালে অসুরদের প্রধান, মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন। ব্রহ্মার বরে তিনি ছিলেন পুরুষের অবাধ্য। তাই বিষ্ণুর পরামর্শে দেবতাদের সম্মিলিত তেজে পরম শক্তি নারীরূপে আবির্ভূত হন দুর্গা। সব দেবতা নিজের নিজের অস্ত্র ও তেজ এই দেবীকে দেন। পুরাকালে দুর্গ বা দুর্গম নামে অসুর বধ করেছিলেন বলে এবং জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেই তিনি ‘দুর্গা’। শ্রী চণ্ডীতে দেবীর দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা, অষ্টভুজা, দশভুজা, অষ্টাদশভুজা, শতভুজা, সহস্রভুজা এবং নির্গূণ নিরাকার রূপে বিরাজিতা। আর দেবী ভক্তদের দশদিক থেকে রক্ষা করেন, সুতরাং দেবী দশভুজা। দেবী দুর্গা দশ হাতে অধিষ্ঠিত দশটি অস্ত্রের রয়েছে আলাদা মাহাত্ম্য। ১. ত্রিশূল তিনটি ফলায় আছে তমঃ রজঃ ও সত্য; ২. গদা- আনুগত্য, ভালোবাসা ও ভক্তি; ৩. বজ্রাস্ত্র- দৃঢ়তা ও সংহতি; ৪. সাপ- বিশুদ্ধ চেতনা; ৫. অগ্নি- জ্ঞান ও বিদ্যা, ৬. শঙ্খ- জীবজগতে প্রাণের সৃষ্টি; ৭. চক্র- সৃষ্টি ও জগতের কেন্দ্রে অধিষ্ঠান, ৮. তীর-ধনুক- ইতিবাচক শক্তি; ৯. পদ্ম- অন্ধকারেও আলোর আবির্ভাব; ১০. তলোয়ার- বুদ্ধি, যা বৈষম্য ও অন্ধকার দূর করে। মহালয়া থেকেই দুর্গাপূজার দিন গোনা শুরু হয়। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়। রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ এবং নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু তার আগে, দশম ও একাদশ শতকেও বাংলায় দুর্গাপূজা প্রচলিত ছিল বলে গবেষকরা অনুমান করেন।
শ্রীশ্রী দুর্গাপূজা আসলে ঈশ্বরের মাতৃভাব ও মাতৃরূপের উপাসনা। দুর্গাপূজায় দুর্গাপ্রতিমা ও নবপত্রিকা-প্রতিমায় ঈশ্বরীয় মাতৃভাব ও মাতৃরূপই প্রতিফলিত হয়। মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদ থেকে মহানবমী তিথি পর্যন্ত দেবী আরাধিতা হন এই নবরূপে। এই নবপত্রিকায় থাকে ধান, কচু, মানকচু, হলুদ, বেল, ডালিম, অশোক, জয়ন্তী (জয়ত্রী) এবং কলা। এই ন’টা গাছের পাতা দিয়ে তৈরি নারীমূর্তি তথা মাতৃরূপ। মহালয়ার দিন দেবী মায়ের চোখ আঁকা হয়। তার পর মহাষষ্ঠীতে হয় বোধন।
দেবী দুর্গা যেমন পরমা প্রকৃতি রূপে পূজিতা আবার তিনিই কন্যারূপে বাঙালির ঘরের মেয়ে। তাই পরম শক্তির সংহারক ও ভীতিকর রূপের পরিবর্তে তাকে আপনজনের মতো কোমল রূপে দেখা, ভয়ের বদলে তাকে স্নেহ ও ভক্তি করার মধ্য দিয়ে উপাসনায় উৎসবের যে রূপবদল সেটা বাঙালির একান্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। আবার, শরৎ-হেমন্তে ফসল তোলার সময় আবহমানকাল থেকেই এ জনপদে উৎসবের রীতি ছিল। সে উৎসবেরই একটি অংশ শারদীয় পূজা। ফসল তোলার সময় বাবা-মায়ের ঘরে বেড়াতে আসে প্রিয় কন্যা। সঙ্গে আসে তার স্বামী ও ছেলেমেয়েরা। দেবী দুর্গার পূজা রূপ পায় বাঙালির গৃহস্থ পরিবারের মিলনোৎসবের এক রূপক। দুর্গাপ্রতিমা শুধুই নারীর মাতৃদৃষ্টি ও নারীর মাতৃভাব প্রকাশ করে তা নয়, নারীর শক্তি-সামর্থ্যরে বিষয়টিও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। নারী একদিকে যেমন পবিত্রতা, দয়া, সহিষ্ণুতা, ভালোবাসা, ক্ষমা ইত্যাদি ভাবের প্রতিমূর্তি, অন্যদিকে নারী অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এক বলিষ্ঠ রূপ। তাই তো তিনি অসুরবিনাশিনী, শক্তিরূপী সনাতনী।
দশভুজা দুর্গা সব নারীর প্রেরণার উৎস। এই নারীশক্তিই যুগে যুগে পূজিতা। যে নারীকে দেবী বলে আরধনা করি, মর্তে সেই নারীই কিন্তু মানবী যিনি সংসার এবং সন্তান ধারণ করেন। তবু এই মর্তের দেবীরূপী মানবী কতই না অবহেলিত হন তার সব অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। নারীর ওপর নির্যাতনকারী অসুর-রূপ অপশক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হোক শুভশক্তির। নিত্যদিনের সংসারে-সমাজে প্রতিটি নারীর মধ্যেই তো দেবী দশপ্রহরণধারিণী মা দুর্গা বিরাজিতা মারূপে, ভগিনীরূপে, স্ত্রীরূপে, কন্যারূপে, সহকারিনীরূপে। তাই, মহালয়ার শুভলগ্নে এই ধরাধামেও মাতৃরূপী, কন্যারূপী, জায়ারূপী সব নারীর প্রতি অসম্মানের অবসান হোক। মহালয়ার এই শুভলগ্নে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্তিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ’।

সুমনা গুপ্তা
শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়