হাছান মাহমুদ : সেই নৈরাজ্যের পথেই হাঁটছে বিএনপি

আগের সংবাদ

ভূরাজনীতির ফাঁদে প্রত্যাবাসন! রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এডিটরস গিল্ডের গোলটেবিল বৈঠক : ৫ বছরে সংকট আরো বেড়েছে

পরের সংবাদ

ভোটের প্রস্তুতি রেখেই আন্দোলনে বিএনপি : প্রার্থী চূড়ান্তে তিন স্তরে মাঠে ৫১টি টিম

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রুমানা জামান : ‘দলীয় সরকারের অধীন আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না’ বলছে বিএনপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাবি আদায় না হলেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে দলটির। বলা যায়, পুরোদমে নিচ্ছেন ভোটের প্রস্তুতি বিএনপি। নেতাদের মতে, দলীয়প্রধানের মুক্তি ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি কোনোটাই সহজে মানবে না সরকার। তাই দাবি আদায়ে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে রাখা ভালো। যাতে যে কোনো মুহূর্তে বিনা চাপে ভোটে অংশ নিতে পারে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্রমতে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় ভোটের মাঠ এককভাবে আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়। এরপর ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেন ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীদের পরামর্শে নির্বাচনে অংশ নেয়া ছিল আরেক ভুল। কারণ, ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন’ ছাড়া আওয়ামী লীগের ওপর তারা কোনো দায় চাপাতে পারেনি। তারা যেমন নির্বাচনী মাঠে ঢুকতে পারেনি, তেমনি রাজপথেও গড়ে তুলতে পারেনি প্রতিরোধ। হারিয়েছে প্রধান বিরোধী দলের তকমা।
বিগত নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ায় দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতারই আফসোস, ২০১৪ সালের নির্বাচনে নিলে আজকে দেয়ালে পিঠ ঠেকতো না। তাছাড়া বেশির ভাগ নেতার বয়সই এখন সত্তোর্ধ্ব। আগামী দ্বাদশ নির্বাচন তাদের জন্য শেষ সুযোগ। এসব নেতারা এবার ভোটে অংশ নিতে ঐক্যবদ্ধ। তবে রাজপথ ছেড়ে দিয়ে ভোটে যাওয়ারও পক্ষে নন তারা। নির্বাচনকে সামনে রেখে পাল্টে গেছে দলটির নীতি কৌশল। তারা বলছেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার আর ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাজনীতির মাঠ এবং দলের গঠণতান্ত্রিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত দুটি নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত প্রশ্নের মুখে পড়েছে। প্রতি নির্বাচনেই তাদের কৌশল মার খেয়েছে। সামনে আসছে আরেকটি নির্বাচন। তারা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিএনপি প্রকাশ্যে কী বলছে, তার

চেয়েও গুরত্বপূর্ণ হচ্ছে নেপথ্যে ভোটের প্রস্তুতি। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায় করার নিজেদের সক্ষমতার বিষয়টিও আমলে নিয়েছে বিএনপি। এজন্য আন্দোলনের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন এবং দলীয় ইশতেহার প্রণয়নের কাজও চলছে সমানতালে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, বিএনপির দাবিকৃত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অনেক আগেই বাতিল হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া না হওয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যের একটি সম্পর্ক আছে। এই ভারসাম্য তৈরিতে সাংগঠনিক কাঠামো শক্ত করতে হবে। সম্ভবত বিএনপি রাজপথের পাশাপাশি দলীয় শক্তি বাড়ানোর কাজও করছে।
সূত্র জানায়, বিএনপি এবার ‘ডু অর ডাই’ নীতি অনুসরণ করে নির্বাচন ও আন্দোলন- এই দুই কৌশলে জেতার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে দলকে তৃণমূল থেকে শক্তিশালী করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়কেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি চলছে ভোটের প্রস্তুতি। যে প্রক্রিয়ায়ই ভোট হোক ৩০০ আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন চূড়ান্তে গোপনে চলছে কাজ। নানা মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে প্রতি আসনে দুজন করে সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাই করছে দলটির হাইকমান্ড। আপাতত প্রতিটি সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকা ধরে দলীয় কর্মসূচি পালনসহ নানা ইস্যুতে নিজ নিজ এলাকায় থাকার মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়ার বিষয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা পরিষ্কার করে বলছি, এই সরকার পদত্যাগ করবে, নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এরপরই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে হুট করেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত এলেও প্রস্ততিতে কোনো ঘাটতি নেই বিএনপির। কারণ বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়ার মতো প্রস্ততি আমাদের রয়েছে।
টার্গেটে পৌঁছাতে ভিন্ন কৌশল : সূত্র জানায়, নির্বাচন মাফিক বড় প্ল্যান নিয়েই মাঠে নামছে বিএনপি। চূড়ান্ত করা হয়েছে আগাম প্রস্তুতি। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলন ও নির্বাচনোত্তর জবাবদিহিমূলক কর্মসূচির রূপরেখাও চূড়ান্ত করেছে দলটি।
সূত্রমতে, নির্বাচনের আগে ও পরের জন্য দুটি পর্বে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। রূপরেখার প্রথম পর্বে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শর্তের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলন চলবে। দ্বিতীয় পর্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হলে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র বির্নিমাণে সব আন্দোলনরত সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা। শিগগিরই এ রূপরেখা উপস্থাপন করবে বিএনপি।
ভোটের প্রস্তুতির ঘটা : ভোট প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিএনপির মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা নিজ নির্বাচনী এলাকায় আসা যাওয়া বাড়িয়েছেন। ৩০০ আসনের তিন স্তরের যোগ্য প্রার্থীর তালিকা প্রস্তুত করতে দেশব্যাপী সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে ৫১টি কমিটি টিম মাঠপর্যায়ে জরিপ করছে। যাদের দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে তাদের জেলা ও মহানগরের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা হচ্ছে। আন্দোলনে রাজপথে না থাকলে মনোনয়ন দেয়া হবে না বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে। হাইকমান্ডের শক্ত মনোভাব বুঝতে পেরে সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, আগামী ডিসেম্বর থেকে নির্বাচন আন্দোলনের আদলে কেন্দ্রীক গণসংযোগ, সাংগঠনিক সভা ও মাঠপর্যায়ের কর্মীসভা শুরু করবে বিএনপি। নেতাকর্মীদের নির্বাচনকালীন দায়িত্বপালন করতে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে সারা দেশ থেকে সাহসী, বিচক্ষণ ও সৎ দলীয় নির্বাচনী পোলিং এজেন্ট বাছাইয়ের কাজ চলছে। বাছাই শেষে চূড়ান্ত দায়িত্বপ্রাপ্তদের কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় এনে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এছাড়া দলের ভাঙন ঠেকাতে মামলা নেই, দলীয় কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় নয়, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ‘নিরাপদ’ থাকছেন- এমন নেতাদের কালো তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা ভোটের মাঠে যাবো, চোরের মাঠে যাবো না। একটি নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিএনপি যে কোনো মুহূর্তেই প্রস্তুত আছে। আমাদের একটি সুবিধা হলো আমাদের আস্থা হলো জনগণের ওপর। বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে একটা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল বলেন, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে আমরা করোনাকালে মানুষের পাশে ছিলাম। স্ব স্ব এলাকায় সংগঠন সুসংগঠিত করে এখনো মাঠে আছি। এটাকে নির্বাচনের প্রস্তুতি মনে করতে পারেন। দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শাহিদা রফিক জানান, জনসমর্থন থাকায় বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে সময় লাগবে না। ভোট চুরি করতে হবে না, মানুষের কাছে টাকা দিয়ে ভোট কিনতে হবে না। সেই প্রস্তুতিও আছে এবং চলছে।
চলছে ইশতেহার তৈরির কাজ : ‘ভিশন-২০৩০’ কেন্দ্রে রেখে আগামী নির্বাচনের ইশতেহার তৈরির কাজও শুরু করেছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগমীরসহ ৭ জন নেতা এ কাজ করছেন। দলের বিভাগভিত্তিক বিশেজ্ঞরা ইশতেহারের কাজে যুক্ত হয়েছেন। সাবেক আমলা, সচিব, সাবেক সেনা-নৌ-বিমান ও পুলিশের কর্মকর্তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা দিয়ে ইশতেহার তৈরিতে সহায়তা করছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘ভিশন-২০৩০’ এর আদলে ও বিগত বছরগুলোতে করা ইশতেহারের সমন্বয়েই হবে আগামী ইশতেহার।
আন্দোলন চলবে : ভবিষ্যতের কোনো আলোচনার টেবিলে দর কষাকষিতে সুবিধা পেতে মাঠের দখল থাকাটা জরুরি বলে মনে করছে বিএনপি। তাইতো চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চায় দলটি। সেই লক্ষ্যে পরিকল্পনায় রয়েছে- আগামী এক বছরের জন্য বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সমাবেশের ছক কষা হচ্ছে। প্রতিটি ইস্যুতে এসব কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকার। এছাড়া চলমান সমাবেশ কর্মসূচি শেষ হলে প্রতি সপ্তাহে একটি বিভাগে সমাবেশ করা হবে। এরপর কর্মসূচি যাবে জেলাপর্যায়ে। জেলাপর্যায়ে শেষ হলে আবার ঢাকা মহানগরীতে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়া হবে। এসব কর্মসূচি শেষ হতেও অন্তত তিন মাস সময় যাবে। এভাবে চলবে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত।
২০২৩ সালের মার্চের পর আবার সারা দেশে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলাপর্যায়ে সমাবেশ করবে বিএনপি। সারা দেশের এই কর্মসূচি দুই মাস ধরে চলবে। এর মধ্যে সুধীজন, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে মতবিনিময় করা হবে। দলটির ধারণা, এসব কর্মসূচি পালন করতে বছরখানেক লাগবে। আর আগামী বছর জুন-জুলাইয়ের পর নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হবে। এই সময়ের মধ্যে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় না হলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে দলটির।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আন্দোলনের গতি সব সময় একরকম থাকে না। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের গতি পায়। ঘটনার গতি-প্রকৃতি যাই থাকুক সরকারবিরোধী আন্দোলনে ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে বিএনপি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়