এসপি হলেন পুলিশের ৪৭ কর্মকর্তা

আগের সংবাদ

সাশ্রয়ের নামে নিম্নমানের বই! : ছাপানো শুরু হয়নি, বছরের প্রথমদিন সব শিক্ষার্থীর বই পাওয়া অনিশ্চিত

পরের সংবাদ

সাহিত্য আন্দোলনের অতীত ও বর্তমান

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

লেখালেখির ক্ষেত্রে আড্ডা এবং সাহিত্য সংগঠনের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। সাহিত্যের আড্ডায় চিন্তার আদান প্রদান যেমন থাকে পাশাপাশি কবির নতুন লেখাপাঠ তার বিচার বিশ্লেষণ কবির লেখাকে পরিপুষ্ট করে তোলে। সাংগঠনিক ভিত্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্য সম্মিলনও কবি-লেখককে কাছাকাছি নিয়ে আসে। সাহিত্যের আন্দোলনও পুরনোকে ফেলে নতুন চিন্তা প্রকাশের একটা ভিত্তিভূমি তৈরি করে। আজকাল সাহিত্যের আড্ডা প্রায় উঠেই গেছে। যা হয় তার অধিকাংশই পরনিন্দা, অস্বীকার করা এবং নিজেকে জাহির করার প্রবণতা। আড্ডাবাজ হিসেবে বাঙালির সুনাম! সবকালেই ছিল। লেখকদের তো কথাই নেই। তিনজন বাঙালি যে কোনো জায়গায় একত্র হলেই চলে কথার তুবড়ি। কিশোর-যুবকরা রকে-রেস্তোরাঁয়, অফিসে কাজ ফাঁকি দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমনকি স্কুলে ছেলেমেয়েদের পৌঁছে দিয়ে সেখানকার বারান্দায় গৃহবধূদের আলাপচারিতা এখন নিত্যদিনের। আড্ডার যুক্তিহীন কথা যেমন গাছে ওঠে আবার আকাশ থেকেও কথা পেড়ে এনে উপস্থাপিত হয় আড্ডার ময়ালে। মেয়েদের আলাপচারিতায় সংসার জীবনের কথাই বেশি থাকে। অর্থাৎ বাঙালি মানেই আড্ডা। ব্যতিক্রম হাতে গোনা। এই যে আমাদের রবীন্দ্রনাথ-আমৃত্যু লিখেছেন, সময় নষ্ট করেছেন কম, তিনিও আড্ডাপ্রিয় ছিলেন। কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে নন্দন কাননে তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি নিষ্কলুষ আড্ডা দিয়েছেন। সময় পেলেই তিনি জমিয়ে আড্ডা দিতেন। একবার তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকা দপ্তরে হঠাৎ উপস্থিত। আব্দুল মান্নান সৈয়দ ‘আড্ডা’ শিরোনামের লেখায় প্রসঙ্গটি এভাবেই উপস্থাপন করেছেন- “আড্ডা দেয়ার লোভেই একবার তিনি হাজির হয়েছিলেন জলধর সেনের ভারতবর্ষ পত্রিকার দপ্তরে। জলধর সেনকে সবাই ‘জলধর-দা’ বলতেন। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে জলধর সেন ছোট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আসরে এসেই ‘জলধর দা’ কেমন আছেন?- বলে আসর জমিয়ে দিয়েছিলেন।”
প্রতিটি মানুষের জীবনেই যেমন গল্পের উপাদান থাকে আড্ডা নিয়েও নানা মুখরোচক গল্প রয়েছে। তবে, আড্ডা সম্পর্কে প্রয়াত রফিক আজাদের মন্তব্য এখানে তুলে ধরি।- ‘আড্ডা আমার রক্তে, কবিতা আমার শিরা উপশিরায়। … আড্ডা আমার রক্তে বটে, তবে কোনোমতেই তা আমার তুচ্ছ জীবনের প্রধান বিবেচ্য নয়। নিয়মে তো নয়ই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আমি উপভোগ করেছি, আড্ডা থেকে শিখেছি অনেক, যা ক্লাসরুমে শিখিনি। গোমড়ামুখো মাস্টারসাবদের কাছ থেকে যা না শিখেছি, সর্বস্বখোয়ানো জুয়াড়ির কাছ থেকে শিখেছি তার দিগুণ। ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতের কাছে যা না শিখেছি তার ত্রিগুণ শিখেছি পুরনো ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের অধিপতিদের উচ্চারণে। চিরজীবন গ্রন্থের চেয়ে জীবিত, জীবন্ত মানুষকেই প্রিয় পাঠ্য ভেবে এসেছি। মানুষকে আমি পাঠ করি অপার আগ্রহে, অনিঃশেষ আড্ডায়। জীবন, জ্যান্ত মানুষের জীবন-আমার কাছে চিরকালই পাঠ্য বিষয়।’
কবি শহীদ কাদরী ছিলেন প্রচণ্ড আড্ডাবাজ। পুরানা পল্টনে তার শ্বশুরালয়ে চলত দিনের পর দিন আড্ডা। বন্ধু, তরুণ, অতি তরুণ কবিরা ছিলেন সেই আড্ডর নিত্যদিনের সদস্য। শহীদ কাদরী যত না কবিতা লিখেছেন তার চেয়ে আড্ডায় সময় দিয়েছেন বেশি। কবি ফজল শাহাবুদ্দীন আমৃত্যু আড্ডাবাজ ছিলেন। বিখ্যাত ‘হারুন ডায়েরি’ কার্যালয়ে ঘটত সাহিত্যের উজির-নাজিরদের উপস্থিতি। অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকা অফিসে চলত ধুম আড্ডা। ‘সচিত্র সন্ধানী’ সাপ্তাহিকীটি এখন আর বের হয় না। এই পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক প্রয়াত গাজী শাহাবুদ্দীন আহমদ এবং নির্বাহী সম্পাদক সম্প্রতি প্রয়াত কবি বেলাল চৌধুরীকে ঘিরে কবিরা তাদের খেয়াল-খুশি উপহার দিতেন। আড্ডাবাজ হিসেবে বেলাল চৌধুরীর খ্যাতি এপার ছাড়িয়ে ওপাড়ের কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সীমানার ভেতরে পৌঁছেছিল, যা এখন ইতিহাস। বেলাল চৌধুরী দীর্ঘদিন কলকাতায় ছিলেন। পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে বসত নিয়মিত আড্ডা। সেখানে আসতেন কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, মাহমুদুল হক, আসাদ চৌধুরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ দেশবরেণ্য কবি লেখকরা।
দীর্ঘদিন কবি রফিক আজাদ বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেছেন। তিনি একাডেমির পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ দেখভাল করতেন। একই কক্ষে বসতেন কবি আসাদ চৌধুরী। একাডেমিতে ছিলেন কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার ও কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। তাদের কেন্দ্র করে চলত তুমুল আড্ডা। সত্তর দশকের প্রধানতম কবি অকালপ্রয়াত আবিদ আজাদ ‘শিল্পতরু’ নামে একটি সাহিত্যের কাগজ বের করতেন। ওই নামে ছিল তার প্রকাশনা ব্যবসা। ‘শিল্পতরু’র কার্যালয়ের প্রতি সন্ধ্যার আড্ডায় উপস্থিত থাকতেন কবি আল মাহমুদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, মাহবুব হাসান থেকে শুরু করে নবীন কবিরা। আড্ডা হতো নিউমার্কেটের ‘রেক্স’ এবং ‘মনিকা’ নামের রেস্তোরাঁয় কখনো বা বিভিন্ন দোকানের বারান্দায়। প্রয়াত কবি সিকদার আমিনুল হকের বাড়িতেও জমাট আড্ডা হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রনেতাদের আড্ডা ছিল কিংবদন্তির মতোই। কী সরকারি কী বিরোধী ছাত্রসংগঠন মাঠে ময়দানে পক্ষে-বিপক্ষে যতই গরম বক্তব্য হোক মধুর ক্যান্টিনে সেই উত্তাপ কমে যেত সহাবস্থানে আড্ডার মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক সহনশীলতার যে সংস্কৃতি ছিল গৌরবের এখন তা একেবারেই অনুপস্থিত। ব্যক্তিগত কুশলাদি তো দূরেই- প্রতিপক্ষের দেখা হলেই উত্তম-মধ্যমের সংস্কৃতি এখন দৃশ্যমান। এই মধুর ক্যান্টিনেই পরিকল্পনা হয়েছে বাংলা কবিতার এক অধ্যায় ‘স্যাড জেনারেশনের।’ ১৯৬৪ সালে স্যাড জেনারেশনের একমাত্র বুলেটিন প্রকাশের ঘটনা বর্ণনা করেছেন কবি বুলবুল খান মাহবুব তার ‘মধুর ক্যান্টিন’ গ্রন্থে এভাবে- ‘মধুর ক্যান্টিনে বসে আছি আমরা। আমি, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী আর শহীদুর রহমান। আসাদ চৌধুরী চলে গেল একটু পরেই। আমরা তিনজন বেশ উত্তেজিত। আগামীকাল বের হবে আমাদের বহুপ্রর্থিত কবিতা সংকলন ‘দ্য স্যাড জেনরেশন।’ গতানুগতিক কাব্যধারার বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহের ফসল স্যাড জেনারেশন বের হলে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে- এ নিয়ে আমাদের আলোচনার অন্ত নেই। আমার ভাবনাটা একটু বেশি, কারণ আমি এর প্রকাশক। এসএম হলের ৩৪ নম্বর রুম থেকে প্রকাশিত হচ্ছে সঙ্কলনটি। রফিক আজাদ আমাকে সাহস জোগাচ্ছে, দেখিস তোর কোনো অসুবিধা তো হবেই না বরং এর প্রকাশক হিসেবে ভবিষ্যতে গর্ববোধ করবি।’
আমরা এতক্ষণ আড্ডার অতীত ইতিহাসের সামান্য বর্ণনা দিলাম। এবার হোক হাল সাকিন। আজিজ মার্কেট এই সেদিনও বইপাড়া হিসেবে বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে নানা আনুষঙ্গিক দোকানের ভিড়ে বই মার্কেট সঙ্কুচিত হলেও আজিজ মার্কেটকেন্দ্রিক আড্ডা এখনো বিদ্যমান। অনতিদূরে কনকর্ড টাওয়ারের বেজমেন্টে গড়ে ওঠেছে আরেকটি বইপাড়া। সেখানেও চলে নিত্যদিনের আড্ডা। সেখানে সুকান্ত সাহিত্য বাসরের ব্যানারে প্রতি শনিবার কবি সাহিত্যিকদের উপস্থিতি ঘটে। এখান থেকেই সত্তরের বিশিষ্ট কবি বিমল গুহ বের করেন ‘পান্থজনের সখা’ নামে একটি সাহিত্য-সংবাদধর্মী কাগজ। আড্ডা বসে তার ছোট অফিসেও। প্রতি শুক্রবার ‘ম্যাজিক লণ্ঠনে’র কবিতা-আড্ডা বসে কনকর্ড টাওয়ারেই। পরীবাগে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডা, গাউছুল আজম মার্কেটে তৃণমূল অনুপ্রাস, গুলশানে ছড়ালেখক স.ম শামসুল আলমের আনন ফাউন্ডেশন এবং কবি রুবী রহমানের বাড়িতে বসে সাহিত্যের আড্ডা। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলাতেও সাহিত্যের আড্ডা হয়। কিন্তু প্রাণের আড্ডা এখন অনুপস্থিত। আড্ডা থেকে উঠে আসছে না ব্যতিক্রমী নতুন চিন্তা। আড্ডার ইতিবাচক ফল সঙ্কুচিত হলেও কবি/লেখকদের সম্মিলনী ঘটছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
পৃথিবীর সব দেশেই কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। সাহিত্যের অন্যসব শাখার চেয়ে কবিতা নানা কারণে ব্যতিক্রম। আকারগত কারণে কবিতাপাঠে যেমন সুবিধা আছে অন্য ক্ষেত্রে তেমন একটা নেই। কখনো কখনো গল্পপাঠ কিংবা গবেষণামূলক নির্ধারিত বিষয় অথবা স্মারক বক্তব্যের অনুষ্ঠান হলেও কবিতাপাঠের আসর বসে সে তুলনায় অনেক বেশি। অন্য ভাষায় তো বটেই বাংলা ভাষায়ও কবির সংখ্যা অনেক। তাই, পৃথিবীজুড়েই আয়োজিত হয় সাহিত্যের এই প্রবীণ শাখার অনুষ্ঠান। একসঙ্গে বহু কবির নানা স্বাদের লেখা তাদের কণ্ঠ থেকে শোনার অভিজ্ঞতাও কম নয়।
কবি ও কবিতার দেশ বাংলাদেশ। কবির এই দেশে কবিদের সম্মিলন নতুন কিছু নয়। কবি বা সাহিত্য সম্মেলনের প্রসঙ্গ উঠলেই ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের দিকে নজর দিতে হয়। ১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আহ্বানে টাঙ্গাইলের সন্তোষে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কাগমারী ও সন্তোষ পাশাপাশি এলাকা। সম্মেলনের পরিচিতি পায় কাগমারী এলাকার নামেই। মূলত সারা দুনিয়ার শান্তি কামনার লক্ষ্যেই মওলানা ভাসানী এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী, লেনিন, আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ আলী জিন্না, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, স্যার সৈয়দ আহমদ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মওলানা শওকত আলী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, শহীদ তিতুমীর, আব্রাহাম লিংকন, হাকিম আজমল খান, উইলিয়াম শেকসপিয়ার, আল্লামা আজাদ সুবহানী প্রমুখ মনীষীর নামের তোরণগুলো শহরের চেহারা পাল্টে দিয়েছিল। হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতায় মুখরিত ওই সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ছিল সাহিত্য সম্মেলন। উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। ভারত থেকে যোগ দিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, রাধারাণী দেবী, কাজী আবদুল ওদুদ এবং ভারতের শিক্ষামন্ত্রী ‘নদী ও নারী’ উপন্যাস খ্যাত হুমায়ুন কবীর। এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডেভিট গার্থ, কানাডা থেকে চার্লস এডামস, ইংল্যান্ড থেকে এফএইচসিন। আর দেশের বরেণ্য সাহিত্যিকরা হলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. উসমান গণি, ড. হেদায়েত উল্লাাহ, ড. এমএন হুদা, ড. আখলাকুর রহমান, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. কুদরত-ই-খুদা, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, শওকত ওসমান, কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রমুখ।
এর আগে ১৯৪৮ সালে ঢাকার কার্জন হলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে এক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এটিই ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাহিত্য সম্মেলন।
১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক বাংলা একাডেমি। সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জিডিআর, হাঙ্গেরি এবং মঙ্গোলিয়ার অনেক কবি-সাহিত্যিক অংশগ্রহণ করেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন কবি জসীমউদ্দীন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে ভারত থেকে এসেছিলেন লীলা রায়, মনোজ বসু, মন্মথ রায়, রমা চৌধুরী, আশুতোষ ভট্টাচার্য, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ মিত্র, অজিতকুমার ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, জীবেন্দ্র সিংহ রায়, বিনয় সরকার, দেবনারায়ণ গুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সবিতাব্রত দত্ত, প্রবোধকুমার ভৌমিক, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ সেন, আশিস সান্যাল, সুচিত্রা সেন, মায়া সেন ও প্রদীপ ঘোষ। এর একচল্লিশ বছর পর বাংলা একাডেমি ২০১৫ সালে চার দিনব্যাপী ১২ দেশের প্রতিনিধি নিয়ে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে।
ঢাকাসহ সারাদেশেই প্রায় প্রতি বছরই কবি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। দেশ-বিদেশের বিশেষ করে ভারতের বিশিষ্ট কবিদের জাতীয় কবিতা পরিষদ আমন্ত্রণ জানায়। ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা কবিরা এক মঞ্চে কবিতাপাঠ করেন। রাজনৈতিক আদর্শে গড়ে ওঠা এই সংগঠনের রয়েছে মজবুত সাংগঠনিক ভিত। ম্যাজিক লণ্ঠন নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে আয়োজন করে কবিতাপাঠ। এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ কবি ও কথা সাহিত্যিক রতন মাহমুদ। এই সংগঠন ছয়শ’র কাছাকাছি অনুষ্ঠান করেছে যা এখনো চলমান। ঢাকার বাইরে টাঙ্গাইলে আয়োজন করা হয় জমজমাট নানা অনুষ্ঠান। টাঙ্গাইলকে বলা হয় ‘কবিধাম’। কবিধামের এই শহরে কাব্য আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। এই শহরে ‘অরণি’র আয়োজনে বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে কবিতাপাঠের আয়োজন করা হয়েছে ১৯৮০ সালের ৮ জুন। সেই অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমান তার আবেগঘন বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেন, ‘অরণি’ আজ ইতিহাস সৃষ্টি করল। পাঁচবার আয়োজন করা হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ কবিতা উৎসব। আয়োজক টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগার। নিয়মিত হচ্ছে পাক্ষিক স্বরচিত কবিতাপাঠ প্রতিযোগিতা। টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদের আয়োজনে নিয়মিত এই অনুষ্ঠানটি এবছরের ১৫ মার্চ তিনশ’তে গিয়ে পৌঁছুবে। ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কক্সবাজার, বগুড়ায় আয়োজন হয় কবি সম্মেলনের। ময়মনসিংহে ১৯৮১ সালের ২৭ ডিসেম্বর আয়োজন করা হয়েছিল বৃহৎ পরিসরের সাহিত্য সম্মেলন। ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের নিয়মিত পাঠচক্র ‘বীক্ষণ’ প্রতি সপ্তাহে আয়োজিত হয়। ২০০৬ সাল থেকে কবি ফরিদ আহমদ দুলালের ‘স্বতন্ত্র’ পত্রিকার উদ্যোগে প্রায় প্রতি বছর ভারত-বাংলার কবিদের সমাবেশ ঘটছে। সমুদ্রের শহর কক্সবাজারে ‘কবিতা বাংলার’ উদ্যোগে কবি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বগুড়া লেখক চক্র ৩০ বছর থেকে অবদান রেখে চলেছে ছোট-বড় নানা মাপের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ১৯৮৯ থেকে বগুড়া লেখক চক্র কবিতা, গদ্য, সাংবাদিকতা ও লিটল ম্যাগসহ নানা বিষয়ে সম্মাননা প্রদান করে আসছে। রাজশাহীতে ‘কবিকুঞ্জের উদ্যোগে কবি আরিফুল হক কুমারের নেতৃত্বে জীবনানন্দের জন্মবার্ষিকীকে সামনে রেখে বড়ো মাপের সাহিত্য সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর অর্থমূল্যসহ একজন কবি ও একজন লিটলম্যাগ সম্পাদককে অর্থমূল্যসহ পুরস্কৃত করা হয়। এ ছাড়া অধ্যাপক শহীদ ইকবাল রাজশাহীতে প্রতি বছর ‘চিহ্ন’ মেলার আয়োজন করেন।
বাংলাদেশের প্রায় জেলাতেই কবিতাপাঠের আসর বসে। এর ফিরিস্তি না দিয়ে সারাৎসার এরকম : চট্টগ্রামে বড় মাপের সাহিত্য সম্মেলন, শিশু সাহিত্যের সমাবেশ, লিটল ম্যাগ সমাবেশসহ প্রতিনিয়তই সাহিত্যের অনুষ্ঠান হচ্ছে। যশোরে মাইকেল স্মরণে প্রতি বছর মধুমেলার আয়োজন করা হয়। কুষ্টিয়ার আকর্ষণ লালন মেলা। নারায়ণগঞ্জে আয়োজন করা হয় বড় মাপের কবি সম্মেলনের। রংপুরে কবি মহফিল হক ভারত-বাংলার কবিদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কিশোরগঞ্জে জাহাঙ্গীর আলম জাহানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় ছড়া উৎসব। জীবনানন্দের শহর বরিশালে তপংকর চক্রবর্তী করেন জীবনানন্দ মেলা। খুলনার ‘কবিতালাপ গোষ্ঠী’ বহুবার কবিসম্মেলনের আয়োজন করেছে। গাইবান্ধায় কবি সরোজ দেব ও এবং লালমনিরহাটে ফেরদৌসী রহমান বিউটি আয়োজন করেন কবি সম্মেলন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রাণপুরুষ কবি জয়দুল হোসেন। তিনিও সমবেশ করেন নানা মাপের অনুষ্ঠান। বগুড়ার শেরপুরে নাহিদ হাসান রবিন ‘অপরাজিত’র ব্যানারে এবং নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে নাজমুল হুদা সরোয়ার মাঝে-মধ্যেই অয়োজন করেন সাহিত্যের অনুষ্ঠান। এছাড়া ফরিদপুর, পাবনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, গোপালগঞ্জ, নাটোর, বাগেরহাট, মুন্সীগঞ্জসহ প্রায় প্রতিটি জেলাতেই কমবেশি সাহিত্য সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
আমরা সাহিত্যের আড্ডা এবং সাহিত্যসম্মেলন নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করলাম। কিন্তু সেই অর্থে সাহিত্য আন্দোলন খুব একটা ঘটেনি। ষাটের দশকে ‘স্যাড জেনারেশনের’ একমাত্র বুলেটিন প্রকাশ ছাড়া তেমন নজরকাড়া কোনো আন্দোলন ঘটেনি। তবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেক লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে। তবে কোনো কোনো লিটলম্যাগ এবং সেই কাগজের সংশ্লিষ্টরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী হয়ে নিজেরাই ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ফেলেন। প্রতিষ্ঠান দুর্বলকেও অনেক দূর এগিয়ে দেয়। কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী একটি বড় ধরনের প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে এরকম কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে, জানান দিচ্ছে কোনো কোনো দৈনিক কাগজ। পাশাপাশি করপোরেটের থাবাও এগিয়ে আসছে দ্রুত গতিতে। এগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য নতুনভাবে প্রয়োজন সাহিত্য আন্দোলনের; যেখানে মুনাফা নয়, জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়কে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে চিন্তার নবায়ন করা প্রয়োজন। কবিতার ক্ষেত্রে আঙ্গিক বিচারে যদিও এক দশক থেকে পরবর্তী দশকের ভিন্নতা মেলে কিন্তু এর কোনো সমন্বয় রূপ এখনো মান্যতা পায়নি। প্রয়োজন নিখাদ সাহিত্যের আড্ডা, সাহিত্যের সংগঠন এবং সাহিত্যের আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ-এর একটি কবিতার পঙ্ক্তি এরকম : ‘এক দশকেই সঙ্ঘ ভেঙে যায়।’ আমরা কিন্তু আশাবাদী। আমাদের বহু সংগঠন এক দশক কেন যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। তবে, এই টিকে থাকার গতিকে প্রবহমান রাখার জন্য শিরোনামের বিষয়গুলোকে প্রধান্য দেয়া উচিত।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়