এসপি হলেন পুলিশের ৪৭ কর্মকর্তা

আগের সংবাদ

সাশ্রয়ের নামে নিম্নমানের বই! : ছাপানো শুরু হয়নি, বছরের প্রথমদিন সব শিক্ষার্থীর বই পাওয়া অনিশ্চিত

পরের সংবাদ

প্রশ্ন ফাঁসে সব এলোমেলো : শিক্ষা কর্মকর্তা বরখাস্ত, ৬ শিক্ষক গ্রেপ্তার, শিক্ষাব্যবস্থায় বারবার পরিবর্তনে নৈরাজ্য

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য (ঢাকা) ও তৈয়বুর রহমান (কুড়িগ্রাম) : দিনাজপুর বোর্ডের অধীনে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্র সচিবের মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। অথচ ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পুরো ব্যবস্থা প্রযুক্তির মাধ্যমে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু ৪ বছরেও তা বাস্তবায়ন না করা ও আবারো প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় শিক্ষা প্রশাসনের আন্তরিকতা ও দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি ভূরঙ্গামারীতে দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতার কারণেই প্রশ্নফাঁস হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাাচ্ছে। এরইমধ্যে স্থানীয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্র সচিবসহ ৬ জন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকার সনাতন শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে ১৯৯২ সালে। এ সময় ৫০ নম্বরের এমসিকিউ পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু হয়। বর্তমানে শিক্ষার মানে ধস- বিশেষ করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এ পদ্ধতিকে। এরপর ধারাবাহিকভাবে জিপিএ-৫ (গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ), সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠে। সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দিয়ে এ সংক্রান্ত বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণে মেতে ওঠেন শিক্ষা প্রশাসনের এক শ্রেণির সুবিধাবাদী কর্মকর্তারা। কিন্তু শিক্ষকরা বিষয়ভিত্তিক উন্নত প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হন। পাশাপাশি নৈতিকতায় ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে শিক্ষকদের একটি অংশ মেতে ওঠেন প্রশ্নফাঁসের মতো জঘন্য কাজে। যার সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। এমন ঘটনায় প্রতিবারই বলা হয়, ভবিষ্যতে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যথারীতি এবারো তা বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হচ্ছে না।
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, এত নিরাপত্তার মধ্যে যেভাবে এবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তা আমাদের চিন্তার মধ্যেই

ছিল না। এর ফলে সবকিছুকেই যেমন এলোমেলো করেছে তেমনি বাকি পরীক্ষাগুলোয় যেন এমনটি আর না ঘটে সেজন্য দেশজুড়ে কেন্দ্রসচিবসহ পরীক্ষা সংশ্লিষ্টদের কড়া বার্তা পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন প্রশ্নফাঁসের কোনো ফাঁকফোকর না থাকে সে ব্যাপারেও কাজ চলছে।
তবে নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ধারাবাহিক প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পর ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে বলা হয়েছিল, বিশেষ একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে র‌্যানডম সিলেকশনের মাধ্যমে পরীক্ষার দিন সকালে চূড়ান্ত প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে। পরীক্ষা শুরুর আধঘণ্টা আগে সকাল সাড়ে ৯টায় ওই ডিভাইস ব্যবহার করে কেন্দ্র সচিবদের প্রশ্ন জানিয়ে দেয়া হবে। তিনি পরীক্ষা কক্ষের বোর্ডে তা লিখে জানিয়ে দেবেন। এরপর পরীক্ষা নেয়া হবে। এছাড়া পরীক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জড়িত কর্মকর্তার সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে। পুরো পরীক্ষা পদ্ধতিকে ডিজিটালাইজ করা হবে। ডিজিটাল প্রশ্ন ব্যাংকের মাধ্যমে যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষার দিন সকালে অটোমেটিক পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে। পরীক্ষা শুরুর আগে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রশ্ন সেট ও পাসওয়ার্ড জানিয়ে দেয়া হবে। কেন্দ্র সচিবদের একটি করে ডিজিটাল ডিভাইস দেয়া হবে। সকাল সাড়ে ৯টার পর এতে পাসওয়ার্ড প্রবেশ করানো হলে প্রশ্নপত্র ভেসে উঠবে। তা দেখেই পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত শিক্ষকরা বোর্ডে প্রশ্ন লিখে দেবেন। তবে পরীক্ষার কক্ষ বড় হলে প্রয়োজনে প্রতি কক্ষে একাধিক বোর্ড ব্যবহার করা হবে, যাতে পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন দেখতে সুবিধা হয়। কিন্তু সেই সভায় নেয়া সিদ্ধান্তগুলো ৪ বছর পরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
শিক্ষাবিদরা বলেছেন, শিক্ষায় শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষা আইন করার কথা ছিল, সেটিও করতে পারছে না মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি গত ১০ বছরে শিক্ষা ব্যবস্থায় এত পরিবর্তন হয়েছে, যার ফলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সব মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় ঘন ঘন পরিবর্তন এবং পরীক্ষা ও প্রশ্ন পদ্ধতি বারবার পরিবর্তনের কারণেই শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে। হচ্ছে প্রশ্নফাঁসও। তাদের মতে, শিক্ষা ও পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অবশ্যই অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলা উচিত, আমলাদের ইচ্ছায় ঘন ঘন পরিবর্তন করা উচিত নয়। এতে শিক্ষায় বিশৃঙ্খলা আরো বাড়বে।
২০০৯ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়। এরপর থেকে সৃজনশীল বিষয়গুলোর পরীক্ষা নেয়া হতো অভিন্ন প্রশ্নপত্রে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বাড়তে থাকায় ২০১৪ সালে সব শিক্ষা বোর্ডে ভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। এতে ইতিবাচক ফলও পাওয়া যায়। বিশেষ করে এক বোর্ডের অধীনে প্রশ্নফাঁস হলে ওই বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এছাড়া অনেক জায়গায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠলেও তা সারা দেশে ছড়িয়ে যেত না। এই অবস্থায় ২০১৭ সালে নতুন করে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের যুক্তি- অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হলে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে ভারসাম্য আসবে। এতে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে সুফল পাবে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা।
অভিন্ন প্রশ্নের কারণে ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার প্রায় সব বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠে। এতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দ্রুততম সময়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পুরো পরীক্ষা পদ্ধতিই বিতর্কের মুখে পড়ে যায়। এরপরে আবার পরিবর্তন করে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নে বোর্ডগুলো পরীক্ষা নেয়া শুরু করে। এতে যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা, সেদিনই থানা থেকে সেই বিষয়ের প্রশ্নপত্র আনতে হয়। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্ধারণ করা একজন কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিতে কেন্দ্র সচিব দুই সেট প্রশ্নপত্র পুলিশি প্রহরায় কেন্দ্রে নিয়ে যান। এটি একটি যৌথ দায়িত্ব। একা কারো খোলার সুযোগ নেই। কেন্দ্রে নেয়ার পর পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে কোন সেট প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে, তার নির্দেশনা দেয়া হয়। তখনো দায়িত্বশীলদের উপস্থিতিতে তা খোলা হয়।
কুড়িগ্রামের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, থানাতেই কিছু একটা হয়ে থাকতে পারে। এ জন্য কেন্দ্র সচিব অবশ্যই দায়ী হবেন। কারণ, ঘটনাটি তিনি ঘটিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে কেবল কেন্দ্র সচিবকে একা দায়ী করলেই হবে না। অন্য যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরও অবহেলা আছে। শিক্ষা বোর্ড বলছে, এই অবহেলা বের করার জন্যই তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।

ভূরুঙ্গামারীর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরখাস্ত : দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ায় কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাসের সই করা অফিস আদেশ থেকে এ তথ্য জানা যায়। এর আগে গত বুধবার দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীন চলমান এসএসসির ৪ বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এগুলো হলো- গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ও রসায়ন। এছাড়া উচ্চতর গণিত ও জীববিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্নপত্র স্থগিত করা হয়। নতুন প্রশ্নপত্রে এ দুটি বিষয়ের পরীক্ষা আগের নির্ধারিত তারিখেই অনুষ্ঠিত হবে।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় অফিস সহায়কসহ আরো ২ শিক্ষক গ্রেপ্তার : কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে চলতি এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পুলিশ আরো দুই শিক্ষক এবং একজন অফিস সহায়ককে গ্রেপ্তার করেছে। গত বুধবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডেকে নিয়ে আসা হলেও পরে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। নতুন করে যাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তারা হচ্ছেন- নেহাল উদ্দিন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন, পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম এবং অফিস সহায়ক সুজন মিয়া। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় এ পর্যন্ত মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হল।
কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় নতুন করে আরো ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। প্রয়োজনে গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
উল্লেখ্য, এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় গত মঙ্গলবার ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমানসহ ৩ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষ থেকে সাধারণ গণিত, কৃষিবিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের প্রশ্নপত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড ওই ৪টি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেন। স্থগিত পরীক্ষা অক্টোবরের ১০ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে হবে বলে জানানো হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়