করোনা পরিস্থিতি : সংক্রমণের হার ১১.৬০ শতাংশ

আগের সংবাদ

খোলা ছাদে খুশির নিনাদ : মেয়েদের ঘিরে শোভাযাত্রায় লাখো মানুষ

পরের সংবাদ

সাকিবকাণ্ডে বিব্রত দুদক > বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি : সচিব

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এস এম মিজান : বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে। জুয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি, শেয়ারবাজার কারসাজি ও স্বর্ণ ব্যবসার মতো নানা আর্থিক কর্মকাণ্ডে অনেক বড় পরিসরে জড়িয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই পোস্টার বয়। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় যাদের তদন্ত করার কথা, সেই দুর্নীতি দমন কমিশনেরই (দুদক) শুভেচ্ছাদূত হিসেবে এখনো তিনি কিভাবে বহাল আছেন- এমন প্রশ্ন নানা মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়া রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেছেন, সাকিবের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। অপেক্ষা করুন, সময় হলে জানতে পারবেন।
জানা যায়- ২০১৮ সালে দুদকের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন সাকিব আল হাসান। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই ক্রিকেটার তখন বিনা পারিশ্রমিকে দুদকের কয়েকটি বিজ্ঞাপনও করেন। সেই বিজ্ঞাপনে তিনি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার বার্তা দেন। কেউ দুর্নীতি করলে সেই তথ্য দুদককে জানানোর কথাও বলেন। অথচ এখন সেই সাকিব আল হাসানের নামই জড়িয়ে পড়েছে বড়সড় দুর্নীতিতে। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার কথা বললেও একটি জুয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেই চুক্তি করেন সাকিব। গত ২ আগস্ট সে কথা ফেসবুকে প্রকাশও করেন। অথচ বাংলাদেশের আইনে জুয়া এবং এ সংক্রান্ত যেকোনো চুক্তি বেআইনি। পরে নানা বিতর্কের মধ্যে সেই চুক্তিটি বাতিল করেন বাঁ-হাতি এই অলরাউন্ডার। সেই বিতর্কের রেশ না কাটতেই শেয়ার কারসাজির অভিযোগ ওঠে সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে, পুঁজিবাজারের তালিকাভভুক্ত ৭টি কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি করে একটি চক্র ১৩৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। সেই চক্রের অন্যতম সদস্য সাকিব আল হাসান। শুধু তাই নয়, স্বর্ণ ব্যবসার মতো নানা আর্থিক কর্মকাণ্ডে অনেক বড় পরিসরে জড়িয়েছেন বিশ্বসেরা এই ক্রিকেটার। এর মধ্যে কোনো কোনোটিতে জড়িয়েছেন বিতর্কিত উপায়ে। এর আগেও মাঠে ও মাঠের বাইরে বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার আলোচনায় এসেছে সাকিবের নাম। এছাড়া

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত হওয়ার ক্ষেত্রেও বিসিবি নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ না করার অভিযোগ রয়েছে জনপ্রিয় এ ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে।
সাকিব আল হাসানের সঙ্গে শুভেচ্ছাদূত-সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করতেন দুদকের পরিচালক নাসিম আনোয়ার। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। সাকিবের সঙ্গে চুক্তি বাতিল বিষয়ে দুদকের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, চুক্তি বাতিল করতে চাইলে আগে সাকিব এবং দুদক উভয়পক্ষ একে অপরকে জানাতে হবে। চুক্তির নিয়ম এবং সময় সম্পর্কে নাসিম আনোয়ার বলেন, এই চুক্তির কোনো টাইম লিমিট ছিল না। এটা ছিল, যে কোনো পক্ষ চাইলে তিন মাসের সময় দিয়ে চুক্তিটি বাতিল করতে পারে। উভয়পক্ষেরই এই স্বাধীনতাটা ছিল।
এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, সাকিব আল হাসান বিশ্বের জনপ্রিয় একজন ক্রিকেটার। ২০১৮ সাল থেকে তিনি দুদকের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে আছেন। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে দুদকের হয়ে কাজ করবেন বলে চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক তার সঙ্গে শুধু একবারই দুদক কাজ করেছে ২০১৮ সালে। এরপর তার সঙ্গে দুদকের আর কোনো কার্যক্রম হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে বর্তমানে যেসব অভিযোগ উঠেছে, এসব বিষয় নিয়ে দুদক পর্যবেক্ষণ করছে। অপেক্ষা করুন, সময় হলে জানতে পারবেন। এর আগে সাকিবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক বলেছেন, সাকিবের বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না। আমরা কমিশনে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। তারপর এ বিষয়ে জানতে পারবেন।
জানা যায়- ২০১৭ সাল থেকে বিএসইসির শুভেচ্ছাদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন সাকিব আল হাসান। গত বছরের মে মাসে সংস্থাটির কাছ থেকে প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে তার মালিকানাধীন মোনার্ক হোল্ডিংস। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জমা দেয়া নথিতে দেখা যায়, মোনার্ক হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান পদে নাম রয়েছে সাকিব আল হাসানের। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত শেয়ার ব্যবসায়ী ও সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হীরুর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান। আর পরিচালক হিসেবে জাভেদ এ মতিন ও আবুল কালাম মাতবরের নাম রয়েছে। এখানেও জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সাকিবের বিরুদ্ধে। শেয়ারবাজারে ব্যবসা করার জন্য সাকিবের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেডের অনুমতিপত্র (লাইসেন্স) পেতে দাপ্তরিক নথিতে তার বাবার নাম ‘জাল’ করেছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। মোনার্ক হোল্ডিংসের একটি নথিতে দেখা যাচ্ছে, খন্দকার মাশরুর রেজার পরিবর্তে বাবার নাম কাজী আবদুল লতিফ বলে উল্লেখ করেছেন সাকিব। দেশের তারকা এই ক্রিকেটার এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ায় বিস্মিত হয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ সাকিব দেশের জনপ্রিয় মুখ এবং তার বাবার নামও পরিচিত। অবশ্য এ বিষয়ে সাকিব বলেছেন, তিনি তার বাবার নাম সংশোধন করবেন।
শেয়ারবাজারের পর স্বর্ণ ব্যবসায়ও নাম লেখান এ তারকা ক্রিকেটার। গত বছর স্বর্ণের ব্যবসা শুরু করার আগে রেস্টুরেন্ট, কাঁকড়ার খামারসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় জড়ান সাকিব। ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলছেন সাকিব আল হাসান। ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট, বিগ ব্যাশ, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, শ্রীলঙ্কান প্রিমিয়ার লিগ, পাকিস্তান সুপার লিগসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিতই খেলছেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি বিভিন্ন লিগে খেলে বিপুল পরিমাণ আয় করেছেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু বিদেশে খেলে উপার্জিত অর্থ তিনি দেশে আনেননি। উপার্জিত অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছেন সাকিব। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে তার।
২০০৯ সাল-পরবর্তী সময় থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত ও পণ্যদূত হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হতে থাকেন সাকিব আল হাসান। ওই সময় ১৫ লাখ টাকায় শুভেচ্ছাদূত হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন একটি ব্যাংকের সঙ্গে। সে চুক্তির মাধ্যমেই দেশের ব্যাংক খাতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সাকিব আল হাসানের। তারপর থেকে বিভিন্ন সময়ে ব্র্যাক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডসহ বিভিন্ন ব্যাংকের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে পেপসি, বাংলালিংক, ক্যাস্ট্রল, লাইফবয়, সিঙ্গার ইলেকট্রনিকস, নরটন অ্যান্টিভাইরাস, বুস্ট, লা রিভ, লেনোভো, রানার মোটরসাইকেল, জা’এনজি আইসক্রিম, টিফিন বিস্কুটসহ বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনী দূত হিসেবে কাজ করেছেন সাকিব আল হাসান। বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। পরিচয় ঘটেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিকসহ ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে। তারকাদের আয় ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করে এমন বেশ কিছু ওয়েবসাইট থেকে সাকিব আল হাসানের মোট সম্পদের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। ক্রিকট্রেকারের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে সাকিব আল হাসানের সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ কোটি ডলার। আর ক্লাউডনেটওর্থের হিসাবে ২০১৯ সাল শেষে সাকিবের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অন্যদিকে নেটওর্থআইডিয়ার মতে, ২০২১ সালে সাকিবের সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৪ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে পাওয়া বেতন, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ থেকে আয়, পণ্যের দূত হিসেবে আয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যবসা থেকে আয়ের ভিত্তিতে সাকিব আল হাসানের মোট সম্পদের পরিমাণ হিসাব করেছে ওয়েবসাইটগুলো।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর দুদকের দূত হয়ে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন সাকিব। শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে সাকিবের নাম জড়িয়েছে। যদিও অভিযোগ এখনো প্রমাণিত নয়; তবুও বিষয়টা দৃষ্টিকটূ। তাই আমি মনে করি, অভিযোগ ওঠার পর দুদকের সঙ্গে চুক্তিটা বাতিল হওয়া উচিত। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে উভয়পক্ষ যেন এ ধরনের চুক্তি থেকে বিরত থাকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান নির্বাহী (সিইও) নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন বলেন, সাকিব আল হাসান নিজ দায়িত্বে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি থাকেন বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত হন, এটা তার সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানের বিষয়। এখানে ক্রিকেট বোর্ডের কোনো ভূমিকা নেই। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ উঠায় ক্রিকেট বোর্ড বিব্রত কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিব্রত হওয়ার বিষয়ের চেয়ে এখানে আমাদের করণীয় কী? সাকিব শুধু ক্রিকেট বোর্ডের সম্পদ নয়, সারা বাংলাদেশের সম্পদ। এটা আমাদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়