করোনা পরিস্থিতি : সংক্রমণের হার ১১.৬০ শতাংশ

আগের সংবাদ

খোলা ছাদে খুশির নিনাদ : মেয়েদের ঘিরে শোভাযাত্রায় লাখো মানুষ

পরের সংবাদ

পানির বোতল ও ছাতা যখন ভরসা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিয়ে ইতোপূর্বে বহু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। যার অধিকাংশই ছিল স্বাস্থ্যসেবার অব্যবস্থাপনা ও রোগীদের অসহায়ত্ব এবং দুর্দশার কথায় পরিপূর্ণ। সেই সঙ্গে ছিল এই সেবা নিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা প্রবাহ। সংবাদকর্মীরা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে রোগীরা কী পরিমাণে দুর্ভোগ পেয়ে থাকেন। আর তাদের প্রত্যাশাই বা কী। প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষ সেই জাতি, যার প্রায় প্রতি পদেই চিকিৎসাসেবা প্রয়োজন হয়। সম্ভবত অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে মানুষ তার শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় বুঝতে পারে এবং তার কারণও উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে বিধায় অসুস্থতা দূর করতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে মেধা, জ্ঞানে এগিয়ে থাকা মানুষের চাহিদার শেষ নেই। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার তীব্র আকাক্সক্ষা একমাত্র মানুষের। শক্তি, সামর্থ্য দিয়ে মানুষ সেই লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। যাই হোক, মানবসভ্যতা ক্রমেই মানুষের এই বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে মানবজাতি তার নিজের গতির চেয়েও দ্রুততর করেছে। যদিও প্রকৃতি এই আকাক্সক্ষার তোয়াক্কা করেনি, করে না। সম্প্রতি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে দিয়েছিল প্রকৃতি। কোভিড-১৯ ভাইরাস তার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। গোটা মানবজাতি হিমশিম খেয়েছিল। অতিমারি করোনা ক্ষণে ক্ষণে তার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে মানবজাতি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নাজেহাল করে তুলেছিল। উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ কোনো দেশই অতিমারির ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি। করোনা শনাক্ত দিন দিন কমে এলেও নির্মূল হয়ে গেছে, এ কথা কেউ বলতে পারবে না। এখনো সতর্কতা রয়েছে। প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। করোনার মতো অতিমারি ভাইরাস ১০০ বছর পর পর এলেও মানবজীবনে অন্যান্য রোগব্যাধি কিন্তু তার জীবনযাপনের সঙ্গেই চলে, সাথী হয়।
সম্প্রতি নিউজভিত্তিক একটি টিভি চ্যানেলে একটি দুঃখজনক সচিত্র সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। ইতোপূর্বে একটি দৈনিকে প্রকাশিত হলেও ততটা নজরে পড়েনি। সবার জানা, ক্যান্সার এক মরণব্যাধির নাম। বাঁচার সম্ভাবনা যতটা না, তারও অধিক নিশ্চিত এই রোগের ব্যয়বহুল চিকিৎসা। এই মরণব্যাধি নিরাময়ে তাই রোগী ও তার স্বজনরা থাকে ব্যাকুল। ঋণ, সহায়, সম্পত্তি বিক্রয়ের ইতিহাস থাকে প্রায় প্রতিটি পরিবারে। সংবাদে দেখা গেল, জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের মেঝেতে মিনারেল ওয়াটারের বোতল, ছাতা ও ব্যাগ সারিবদ্ধভাবে রাখা। এটা মূলত হাসপাতালে টিকেট কেনার রোগীদের লাইন। এভাবেই তারা সশরীরে নয়; বোতল, ছাতা ও ব্যাগ রেখে লাইনে দাঁড়িয়ে যায় ফজরের নামাজের পরপরই। সকাল ৮টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত চিকিৎসক কর্তৃক রোগী দেখার টিকেট দেয়া হয়, যতটুকু মনে পড়ে সংবাদে তেমনই বলা হয়েছে। শত শত রোগী এভাবে চিকিৎসককে দেখাবার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এটা কোনো স্বাভাবিক অপেক্ষা নয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। পানির বোতল, ছাতা রোগীর প্রতিনিধিত্ব করে লাইনে থাকার মানে হলো, ক্যান্সার রোগীর পক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানো সম্ভব নয় এবং অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা। রোগীর সংখ্যার তুলনায় চিকিৎসক কর্তৃক রোগী দেখার সময় অনেক কম। ফলে রোগী ও তার স্বজনদের মধ্যে থাকে চিকিৎসককে দেখাতে পারার চাপা উত্তেজনা ও প্রতিযোগিতা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্যান্সার রোগীদের শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসক দেখাবার প্রয়োজনীয়তা অন্যান্য রোগের চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে থাকে। সংবাদে বলা হয়েছে, আগত রোগীদের অধিকাংশ মফস্বল থেকে আসা। ক্যান্সার রোগের সাধারণ চিকিৎসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে হয় বলে তেমন তথ্য নেই। এই জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য স্বজনরা রোগীকে নিয়ে রাজধানীমুখী হয়ে পড়েন। অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস ভাড়া করে কিংবা পাবলিক বাস, ট্রেনে তারা রাজধানীতে পা ফেলেন, হাসপাতালে ছুটে যান। কিন্তু সেখানে নেই যথাসময়ে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। পানির বোতল, ছাতা দিয়ে লাইন ধরার ঘটনাটি নতুন নয়। তাহলে কেন এতদিনেও একটা সুষ্ঠু সমাধানে যেতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল। জবাবদিহিতার পথটি নিশ্চিত না হওয়ার কারণে হয়তো বিষয়টির প্রতি কারোর ভ্রæক্ষেপ নেই।
পাঠক, প্রতি বছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রচুর টাকা বরাদ্দ থাকে। কারণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষিত না হলে মানবসম্পদ হবে কী করে, হয় কী করে। হয় না। তাই উন্নয়নের জন্য তো ব্যক্তির শিক্ষার পাশাপাশি তার শারীরিক সুস্থতা লাগে। এটা সবাই বোঝেন, মানেন। ফলে অনেক পরিকল্পনা করা হয়, অনেক টাকা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু এতে আর স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ে না, সব ধরনের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হয় না, স্বাস্থ্য সুরক্ষিত হয় না। তবে ইট-সুরকির স্থাপনা হয়, মেশিনপত্র ক্রয় হয়। হয় অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ, জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল। ঠিকাদারি তৎপরতাও সক্রিয় থাকে। তারপর কিছুদিন পর ওসব অনেকটা জাদুঘরের উপকরণ হিসেবে পড়ে থাকে। করোনার সময় দেখা গেল তীব্র আইসিইউর সংকট। যাও বা আছে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে তার অধিকাংশই সঠিক পরিচালনার অভাবে বিকল, অচল। সাংঘাতিক অব্যবস্থাপনার চিত্র পাওয়া গেছে অতিমারি করোনার সময়। তারপরও টনক নড়েনি। জেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র উন্নত হয় না যেন কোনোভাবেই। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার মান এতটাই দুর্বল যে, বাধ্য হয়ে রোগীরা রাজধানীমুখী হন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো, সঠিক মনিটরিং ও তদারকি নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় চিকিৎসাসেবার গুণগত মান নিরূপণে কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই। তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, সম্প্রতি চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় অবৈধ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করা হলো। দেখা গেল, কোথাও কোথাও সিভিল সার্জন এই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, কী করে অবৈধভাবে বড় বড় হাসপাতাল গড়ে উঠল। একটি নয়, দুটি নয়, অসংখ্য। আমরা জানি, সাধারণ জনগণকে যে কোনো সেবা দেয়ার একটা অনুমোদন প্রক্রিয়া থাকে। অনেক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা হওয়ার পর তো ভেবে নিতে হয় যে, দায়িত্বশীলরা পূর্বে বিষয়টি তাদের দায়িত্বের মধ্যে নেননি অথবা অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে, যা সর্বসাধারণের জানা বারণ।
যখন লেখাটা লিখছি তখন সংবাদে প্রচার হচ্ছে চট্টগ্রামে একটি সরকারি হাসপাতালের স্টাফরা ওষুধ চুরি করে দালালের মাধ্যমে বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। সরকারি হাসপাতালের ওষুধ চুরি করে বাইরে বিক্রি করা কিন্তু নতুন নয়। হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই এই কাজটি করে থাকে। প্রশ্ন হলো, এমন অপরাধ করার সুযোগ কারা করে রাখছেন? আমরা কেবল চোর ধরি কিন্তু চোরের বাপকে ধরি না কেন? যিনি বা যারা চুরির সুযোগ করে রাখছেন, তাদের ধরা হলেই তো চুরি বন্ধ হবে, তাই না? সরকারি জিনিসের প্রতি এমনিতেই মানুষের মায়াদয়া কম। লোকে ভাবেন, এসব সস্তা। এসবের মা-বাপ নেই। কাজেই চুরি করে বিক্রি করলে কারোর কিছু যায় আসে না। আসেনিও কখনো। অথচ এসব ওষুধ কেনা হয় জনগণের টাকায়। সরকারি চাকুরেদের বেতনের মতোই। এমন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে কখনোই সেবার গুণমত মান সুরক্ষিত হবে না।
জানি না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারোর চোখে ক্যান্সার হাসপাতালের এই সচিত্র সংবাদ পড়েছে কি না। দৃষ্টিগোচর হলে ভালো। না হলে বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক, দুঃখজনক যা মেনে নেয়া যায় না। পরিসংখ্যান থাকা দরকার বছরে কত সংখ্যক ব্যক্তি কত ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী তো চিকিৎসা ব্যবস্থা ও তার সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার কথা স্বাস্থ্যসেবার সংশ্লিষ্টদের। পানির বোতল, ছাতা দিয়ে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অপেক্ষা করাটা কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা ও অবহেলাকে দৃশ্যমান করে কিনা, ভাবতে হবে। আসুন, ভেবে দেখি।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়