করোনা পরিস্থিতি : সংক্রমণের হার ১১.৬০ শতাংশ

আগের সংবাদ

খোলা ছাদে খুশির নিনাদ : মেয়েদের ঘিরে শোভাযাত্রায় লাখো মানুষ

পরের সংবাদ

দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এম. কে. রানা, বরিশাল : দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। তবে উল্টো চিত্র দেখা দিয়েছে নৌপরিবহন সেক্টরে। যাত্রী ধরে রাখতে ভাড়া কমানোসহ সর্বশেষ রোটেশন প্রথা চালু করেও সুফল পাচ্ছেন না নৌপরিবহন মালিকরা। এরই মধ্যে লোকসান এড়াতে বিলাসবহুল একাধিক লঞ্চ কেটে বিক্রি করা শুরু হয়েছে। ফলে প্রায় দেড়শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি কয়েক হাজার মানুষ বেকারত্বের কবলে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। মূলত, পদ্মা সেতু চালু হলে লঞ্চযাত্রায় ভাটা পড়বে এমন আশঙ্কা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেই আশঙ্কা যে এতটা ভয়াবহ হবে তা হয়তো বুঝতে পারেননি কেউ। এদিকে সচেতন নাগরিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর নৌসেক্টরে যে সংকট সৃষ্টি হবে সেজন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন ছিল।
সূত্রমতে, ১৮৮৪ সালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত যাত্রীবাহী প্যাডেল স্টিমার চালু করেছিল ব্রিটিশ মালিকানাধীন কোম্পানি ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন (আইজিএন)। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যার পাড় থেকে পদ্মা-মেঘনা হয়ে কীর্তনখোলা পর্যন্ত সেটিই ছিল নৌপথে তৎকালীন বরিশালের প্রথম ইঞ্জিনচালিত নৌযান। এরপর ১৯৬০ সালের দিকে আইজিএনের পাশাপাশি এই পথে লঞ্চ নামান বেসরকারি মালিকরা। শুরুতে কাঠের তৈরি দেড়তলা সাইজের ছোট লঞ্চ যেত বরিশাল থেকে ঢাকায়। ১৯৬৫ সালে প্রথম নামে দোতলা লঞ্চ। এমএল মারী, এমএল শাহরুন্নেসা, এমএল ইলিয়টগঞ্জসহ কয়েকটি দোতলা লঞ্চ চলতে শুরু করে এই রুটে। দোতলা হলেও এগুলোও ছিল কাঠের তৈরি। স্বাধীনতার পর কাঠের বডিকে হটিয়ে জায়গা দখল করতে শুরু করে স্টিলবডির লঞ্চ। ঐতিহ্যের সঙ্গে বিলাসিতা মিলিয়ে ঢাকা-বরিশালের লঞ্চ হয়ে ওঠে ঈর্ষণীয় সার্ভিস। লাল-নীল আলোয় ঝলমল দানবাকৃতির লঞ্চগুলো যখন পাড়ি দেয় পদ্মা-মেঘনায়, তখন চাঁদের আলো আর নদীর ঢেউ মিলিয়ে সৃষ্টি হয় অপরূপ সৌন্দর্যের। কেবল প্রয়োজনেই নয়, লঞ্চের এই আয়েশি যাত্রা উপভোগ করতে দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক চলাচল করে এই রুটে।
সেই লঞ্চযাত্রায় এখন কেবলই বিষাদের সুর। মাঝে কুরবানির ঈদ ঘিরে কদিন যাত্রী মিললেও এরপর থেকে অনেকটা যাত্রীশূন্য অবস্থায় চলতে হচ্ছে লঞ্চগুলোকে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে সৃষ্টি হয়েছে এই পরিস্থিতির। সড়কপথে মাত্র ৩ ঘণ্টায় ঢাকা যাওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় লঞ্চ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেকেই। এখন শুধু ডেকই নয়, কেবিন পর্যন্ত খালি নিয়ে চলতে হয় লঞ্চগুলোকে। যাত্রী সংকটের কারণে এডভেঞ্চার আর রাজারহাট সিও ওয়াটার বাস গ্রিনলাইন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে বহু আগে।
ঐতিহ্যবাহী নৌপথে যাত্রী ধরে রাখতে ভাড়া কমিয়ে লোকসান গুনছেন লঞ্চমালিকরা। অনেকটা বাধ্য হয়েই চালু করেছেন রোটেশন প্রথা। তাতেও সুফল মিলছে না। ক্রমাগত লোকসান সামাল দিতে না পেরে কেটে বিক্রি করা হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল রুটের বিলাসবহুল লঞ্চ এমভি কীর্তনখোলা-১। শুরুতে আস্ত লঞ্চ বিক্রির চেষ্টা করেছিল মালিক পক্ষ। ব্যবসা নেই বুঝে কিনতে রাজি হননি কেউ। শেষ পর্যন্ত কেটে কেটে চলছে লোহার দরে বিক্রি।
জানা গেছে, কেবল কীর্তনখোলাই নয়, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী আরো অন্তত সাতটি লঞ্চ এভাবে কেটে বিক্রি করছেন মালিকরা। একাধিক লঞ্চ মালিক বলেন, কোনো উপায়

নেই। যে কটি লঞ্চ চলছে তাও লোকসান দিয়ে। প্রতিবার রাউন্ড ট্রিপে যদি দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লোকসান হয় তো কতদিন টিকবে মালিক?’
সুরভী নেভিগেশনের পরিচালক রেজিন উল কবির বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার আগে প্রতি রাউন্ড ট্রিপে আমাদের খরচ হতো ছয় লাখ ২০ হাজার টাকা। দাম বাড়ার পর সেটি গিয়ে ৮ লাখ ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রী কমলেও টিকেছিলাম আমরা। লোকসানের মাত্রা খুব একটা বেশি ছিল না। কিন্তু তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছি। সরকারি রেটের তুলনায় ভাড়া কম নেয়া হচ্ছে ডেকে। কেবিনের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত ভাড়ার তুলনায় প্রায় অর্ধেক নিচ্ছি আমরা। তারপরও যাত্রী উঠছেন না লঞ্চে।’
অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের মালিক এফবিসিসিআই পরিচালক নিজামউদ্দিন বলেন, যাত্রী সংকটের কারণে শুরু হয়েছে রোটেশন পদ্ধতি। এখন উভয়প্রান্ত থেকে তিনটি করে মোট ছয়টি লঞ্চ চালাচ্ছি আমরা। ভেবেছিলাম এতে করে সংকটের কিছুটা হলেও সমাধান হবে। কিন্তু তা হয়নি। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আর লঞ্চ চালানো যাবে না’।
কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের মালিক মঞ্জুরুল আলম ফেরদৌস বলেন, ‘বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী কীর্তনখোলা-১ লঞ্চের মূল্যমান রয়েছে ২০ থেকে ২২ কোটি টাকা। যদিও এটি আমি কয়েক বছর আগে অন্য মালিকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। সেটি এখন কেটে কেটে বিক্রি করছেন তিনি। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। কেটে লোহার দরে বিক্রি করলে হয়তো পাঁচ-ছয় কোটি টাকা পাবেন তিনি। মানুষ তার ঘর কখন ভাঙে? যখন আর কোনো উপায় থাকে না।
তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ৩৮টি রুটে চলাচল করে লঞ্চ। কম করে হলেও ২০০ লঞ্চ চলে এসব রুটে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ভোলা অঞ্চলের রুটগুলো ছাড়া অন্যসব রুটেই চলছে যাত্রী সংকট। গৌরনদী, শরীয়তপুর, নড়িয়াসহ অনেক রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধই হয়ে গেছে। এখন যে সাত-আটটি লঞ্চ কেটে কেটে লোহার দরে বিক্রি করছেন মালিকরা, তার সবই এসব রুটের।
সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক ও কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘হয়তো দুই-তিনটি লঞ্চ থাকবে। তাও না থাকার মতো। এছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই সেক্টরটি বন্ধ হয়ে গেলে কয়েক হাজার মানুষ বেকার হবে। শ্রমিক-কর্মচারী মিলিয়ে একেকটি লঞ্চে কর্মী আছে ২৫-৩০ জন করে। সেই সঙ্গে ঘাটে কাজ করা লোকজন। লঞ্চ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও কাজ হারাবে। এই শিল্পে বিনিয়োগ রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এই বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কী?
বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে লঞ্চের যাত্রী কমবে। এটা মাথায় রেখেই লঞ্চ মালিকদের উচিত ছিল আরও আগে থেকে এই সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নেয়া। সড়কপথে সময় কম লাগলেও পদে পদে রয়েছে দুর্ঘটনার শঙ্কা। লঞ্চ মালিকদেরও নতুন করে ভাবতে হবে। গতি বাড়িয়ে কম সময়ে মানুষকে পৌঁছে দিতে হবে ঢাকায়। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে যেটা সম্ভব ছিল সেটা এখন কেন নয়? সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ভাড়া কমানোর পাশাপাশি মান বাড়াতে হবে যাত্রীসেবার। সে রকমটা করতে পারলে নৌপথেও দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা চলতে পারবে লঞ্চ বলে মনে করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়