হাসপাতালে ভর্তি আরো ৩৮১ রোগী : ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন হওয়ার আহ্বান মন্ত্রীর

আগের সংবাদ

মহা আড়ম্বরে সমাহিত মহারানি

পরের সংবাদ

নিঃসঙ্গ বার্ধক্য

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রোজ সকালে অভিরূপ দেখতে পায় তার স্ত্রী ঝিনুক বিছানা ছেড়ে উঠেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। মুহূর্তের পরে ঝিনুককে দেখা যায় প্রসন্ন মুখে বাথরুমে প্রবেশ করতে। অভিরূপ বেশ কয়েকবার এর পরপরই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। বিয়ে হয়েছে তিন বছর, নিজেরা পছন্দ করে। দুজন চাকরি করে একই ব্যাংকে। সেখানেই আলাপ। একসঙ্গে যায়, আসে। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। মনটা একটু খুঁতখুঁত করলেও, নিজের মনেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটা চলছে প্রায় মাসখানেক। জিজ্ঞেস করব করব করেও করা হয়ে ওঠেনি। অভিরূপের বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন। অবসর নেয়ার পর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকা শুরু করেছেন। অভিরূপ কলকাতাতে ওদের ফ্ল্যাটে এসে থাকতে বললেও রাজি হননি। যে বাড়িতে শৈশব-কৈশোর-আংশিক যৌবন কেটেছে, সেখানেই থাকতে চান এখন। অভিরূপ এই মাটির টানটা উপলব্ধি করতে পারে। নিজেরও শৈশবের কিছুটা কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। অবশ্য বাবা-মা, জেঠু-জেঠি, দুই কাকা-কাকি একসঙ্গে থাকেন, একে অপরের দেখাশোনা করেন। অভিরূপের বাবা-মা ভালোই আছেন। ঝিনুকের বাবা এখনো কর্মরত। তাছাড়া কলেজপড়ুয়া এক ভাইও আছে।
দিনটা রবিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই তাড়াহুড়ো নেই। চা খেতে খেতে পত্রিকার ওপর চোখ রেখে যখন অভিরূপ ব্যালকনির রহস্য জানতে চায়, অবাক হয়ে যায় ঝিনুকের জবাব শুনে। ছুটির দিন ছাড়া অভিরূপদের কারোরই সে রকম সময় নেই। সপ্তাহজুড়ে অর্থ উপার্জনের পেছনে দৌড়ানো শেষে ছুটির দিনেও মাঝে মাঝে লেগে থাকে এর-ওর বাড়ি যাওয়া, জন্মদিন-বিবাহবার্ষিকীর নিমন্ত্রণ। ঝিনুক শনি-রবিবার ছুটির দিনে সামনের টাওয়ারের একদম মুখোমুখি চারতলা নিবাসী একজন বৃদ্ধার সঙ্গে মাঝে মাঝেই ‘কেমন আছেন’ গোছের মৌখিক আলাপচারিতা করে, এটা লক্ষ্য করেছে অভিরূপ।
মাসখানেক আগে এক রবিবারে, কোথাও যাওয়ার কোনো প্ল্যান ছিল না বলে, ঝিনুক পাশের ফ্ল্যাটের ইস্পিতাকে নিয়ে সামনের টাওয়ারের ওই বৃদ্ধার বাড়ি ঘুরতে যায়। বৃদ্ধা গৌরী দেবীর বয়স ৮৬, তার স্বামী নলিনীবাবুর বয়স ৯২। এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলে থাকে দিল্লি আর মেয়ে থাকে মুম্বাইতে। ছুটি-ছাটাতে আসে। অবসর নেয়ার পরে নলিনীবাবু একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন। ১০ বছর আগে ছেলেমেয়ে দুজনই তাদের সঙ্গে থাকার জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নলিনীবাবু নিজের বাড়ি ছেড়ে যেতে চাননি। বছরখানেক আগে ছেলেমেয়ে দুজনে এসে এই আবাসনের ফ্ল্যাটটি ভাড়া করে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়। বানানো বাড়িটি একটি ব্যাংককে ভাড়া দেয়া হয়েছে, স্টাফ থাকার জন্য। ভাড়ার টাকাতেই এই ফ্ল্যাটের ভাড়া মিটে যায়। ছেলে অনলাইনে সবকিছু সামলায়। এখন দুজনেরই এত বয়স হয়ে গেছে, নিজস্ব বাড়িতে থাকা অসুবিধা হয়ে যাচ্ছিল।
নলিনীবাবু প্রথমে রাজি হতে চাননি, মেয়ে জোরাজুরি করাতে রাজি হয়েছেন। গৌরী দেবী বলেন, ফ্ল্যাটে অনেক সুবিধা। দুধ, ফল, সবজি, ওষুধ সব ফ্ল্যাটে এসে দিয়ে যায়। জলের কল, লাইটের সুইচ খারাপ হয়ে গেলে ফোন করলেই লোক এসে যায়। ওই বাড়িতে তো মিস্ত্রিদের ফোন করে করে ধৈর্য হারিয়ে যেত। ডাক্তারেরও খুব একটা অসুবিধা হয় না। সিকিউরিটিতে ফোন করে দিলে, এই আবাসনের যে কয়েকজন ডাক্তার আছেন- তাদের একজন সময়মতো এসে প্রেসার, পালস চেক করে যান। রক্ত পরীক্ষার জন্যও ডাক্তারবাবু লোক পাঠিয়ে দেন ফ্ল্যাটে। কিন্তু এখানে দুটো অসুবিধে- মাটির সংস্পর্শ নেই আর একদম নিঃসঙ্গ জীবন। এখানে সবাই ব্যস্ত। কারোর সময় নেই দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলার।
ঝিনুক সেদিনের গল্প বলে যায় অভিরূপকে। এরপর মাসিমা কী বললেন জানো, অভি? তিনি প্রত্যেক দিন রাতে শুতে যাওয়ার সময় ব্যালকনির সঙ্গে লাগানো শোবার ঘরটার জানালা বন্ধ করে দেন, আর সকালে উঠেই সেই জানালাটি খুলে দেন। বৃষ্টি হলেও একটি পাল্লা খুলে রাখেন। আমাদের ব্যালকনি থেকে যেটা সরাসরি তাকালে দেখতে পাওয়া যায়। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন রোজ সকালে উঠে ওই জানালাটি খোলা আছে কিনা দেখার জন্য। যদি কোনো সকালে দেখা যায় যে জানালাটি বন্ধ তবে বুঝে নিতে হবে…।
আমি মাসিমাকে তাড়াতাড়ি চুপ করিয়ে দিই। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। বলেন, ‘বুঝলে মা, এই বার্ধক্য জীবন, বেঁচে থেকে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গোনা, নিঃসঙ্গ মৃত্যুর আতঙ্কে ভোগা- এর থেকে কারোর রক্ষা নেই। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সবাই একসঙ্গে থাকতেন। খটাখটি লাগলেও, সেটা কোন সংসারে হয় না বলো, প্রত্যেকে প্রত্যেকের সুখে-দুঃখে পাশাপাশি থাকতেন। তখন মানুষের চাহিদা কম ছিল। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চাহিদা বাড়ল। আয়ের অসামঞ্জস্য মাথা চাগাড় দিয়ে উঠল। ধীরে ধীরে একান্নবর্তী পরিবারের চিন্তাধারা ভেঙে গেল। তারপর সময়ের প্রবাহে পরিবর্তনের বিবর্তনে, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আজ আমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধা নিঃসঙ্গতা, কথা বলার কেউ নেই। ফোনে ছেলেমেয়ের সঙ্গেও আর কতক্ষণ কথা বলব, ওরাও ব্যস্ত থাকে। আমাদের তো টাকা-পয়সার সে রকম অসুবিধা হয় না। ছেলেমেয়ে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পাঠায়। সাহেব পেনশনও পান। যারা পেনশন পান না, ব্যাংকে জমানো টাকার ইন্টারেস্টের উপর বেঁচে আছেন- তাদের কথা চিন্তা করে দেখো?’
মাসিমার প্রত্যেকটি কথা আমার বুকে যেন শেলের মতো বিঁধছিল। উনি প্রচুর গল্পের বই, উপন্যাস পড়েন- দেখলাম।
অভিরূপ ঝিনুকের কথা শুনতে শুনতে নিজেও একটু আবেগে প্লাবিত হয়ে যায়। পট থেকে ঝিনুক দ্বিতীয় কাপ চা ঢালে দুজনের কাপেই। তারপর বলে, ‘আমি আর ইস্পিতা একটু সার্ভে করেছি। আমাদের আবাসনে ৬০টি ফ্ল্যাটের মধ্যে আপাতত ৫৪টি ফ্ল্যাটে লোক থাকেন। তার মধ্যে বয়স্ক ব্যক্তি একা থাকেন ৬টি ফ্ল্যাটে। বয়স্ক ব্যক্তি আরো ৮টি ফ্ল্যাটে আছেন, কিন্তু তাদের সঙ্গে আছেন ছেলে অথবা মেয়ে কিংবা ভাই। তাই তাদের একাকিত্বের সমস্যাটা নেই।’
অভিরূপ সোজা হয়ে বসে বলে, ‘তোমরা তো দারুণ কাজ করেছ। ব্রাভো।’
‘শুধু ব্রাভো বললে হবে না। একটা বুদ্ধি দাও। এই বয়স্কদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। এভাবে নিঃসঙ্গ মৃত্যুর আতঙ্কে তাদের ভুগতে দেয়া যায় না। এর থেকে তো তাহলে বৃদ্ধাশ্রম ভালো।’
অভিরূপ ধীরে ধীরে বলতে থাকে, “এই গতিশীল যুগে এবং যেখানে একান্নবর্তী পরিবার প্রায় অবলুপ্তির পথে, হয়তো বৃদ্ধাশ্রম একটি সঠিক নির্দেশিকা। অন্তত সেখানে নিঃসঙ্গতায়, একাকিত্বে ভুগতে হয় না। সে কারণে এত বৃদ্ধাশ্রম আজ গজিয়ে উঠছে। আজ তবু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দুজনে একসঙ্গে আছেন। চিন্তা করো ব্যাপারটা, একজনের অবর্তমানে আরেকজনের কী অবস্থা হবে? আমি আমার ঠাকুমাকে দেখেছি। দাদুর অবর্তমানে আত্মীয়পরিজন বেষ্টিত হয়েও অবসাদে ভুগতেন। বয়স্ক মানুষ উৎপাদক নন, গুছিয়ে কেনাকাটা করার মতো উপভোক্তাও নন। তাই সরকার বা বাজার কেউই তাদের কথা ভাববে না। আমাদের নিজেদেরই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নির্ণয় নিতে হবে। একান্নবর্তী পরিবারের মূলমন্ত্র- ‘এসো আমরা বেঁধে বেঁধে থাকি’, এই কথাটিকে এই আবাসনের সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে।”
ঝিনুক যেন একটা আশার আলো দেখতে পায় অভিরূপের কথায়, বুঝতে পারে ওর মাথায় কিছু একটা চলছে। বলে- ‘কিন্তু তোমার প্ল্যানটা আসলে কী?’
‘আমাদের পরবর্তী সোসাইটি মিটিং আগামী রবিবার। আমি ওইদিন কয়েকটি প্রস্তাব দেব। সপ্তাহব্যাপী আমরা সবাই ব্যস্ত। রবিবার বিকালেও কেউ বন্ধুর বাড়ি, সিনেমা অথবা শপিংয়ে যায়। যারা ইচ্ছুক এবং যাদের পক্ষে সম্ভব, রবিবার সকালে আমরা এই ছয়জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে আমাদের আবাসনের ছোট্ট পার্কটাতে নিয়ে আসব। আমাদের সঙ্গে তারা গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা করে ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটাবেন। চা-টার ব্যবস্থাও করা হবে সোসাইটির টাকায়। প্রত্যেক মাসেই একটা-দুটো জন্মদিন পালন করা হয় আমাদের কমিউনিটি হলে। সবাই পরিচিতজনদের ডাকেন। এবার থেকে এই ছয়জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেও নিমন্ত্রণ করা হবে। আর একটা অনুরোধ করব, জানি না কতটা ফলপ্রসূ হবে। অন্ততপক্ষে তুমি শুরু করতে পারো, মাসে যে দুটি শনিবার ছুটি থাকে আমাদের ব্যাংকে, সেই দিনগুলোতে তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে গল্প-গুজব করে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসা। অনেক মহিলাই চাকরি করেন না। তাদের দুপুর এবং বিকাল কাটে টিভি দেখে, শুয়ে, গল্পের বই পড়ে। তাদের অনুরোধ করব বিকালে কিছুটা সময় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধদের সঙ্গে কাটানোর জন্য। তুমি আর ইস্পিতা শুরু করলেই, দেখবে আস্তে আস্তে অনেকেই এতে অংশগ্রহণ করবেন। এখন পর্যন্ত এই মাথায় আসছে। অন্য মেম্বারদেরও কোনো সাজেশন থাকলে সেটাও কার্যকর করা যেতে পারে।’
ঝিনুক এক লাফে চেয়ার থেকে উঠে হঠাৎ করে অভিরূপের গলা জড়িয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে, ‘ইউ আর এ রিয়েল ডার্লিং। এই না হলে আমার বর!’

সুপ্রিয় দেবরায় : বারাসাত, পশ্চিমবঙ্গ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়