হাসপাতালে ভর্তি আরো ৩৮১ রোগী : ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন হওয়ার আহ্বান মন্ত্রীর

আগের সংবাদ

মহা আড়ম্বরে সমাহিত মহারানি

পরের সংবাদ

ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন কতটুকু নিরাপদ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে আলোচনা চলছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত সরকারপ্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সৃষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত নির্বাচনী আচরণ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান অবিশ্বাস তথা অনাস্থা ইভিএম সম্পর্কিত উদ্বেগকে আরো উসকে দিচ্ছে। এসব উদ্বেগের কেন্দ্রে যে প্রশ্নটি অবস্থান করছে তা হলো, ইভিএম কি ভোটদান প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে মুক্ত বা ‘টেম্পার-প্রæফ’ রাখতে পারবে? বর্তমান বিশ্লেষণের ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার তথ্য-উপাত্ত, বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব ও মতামত।
ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যালট পেপারের দ্বারা ভোট দানের সব বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নির্বাচনকে অনেক বেশি দ্রুততর করে। অত্যন্ত দ্রুত এবং পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারণে ইভিএম সময়, অর্থ ও শ্রমশক্তি বাঁচায়। একই সঙ্গে ব্যালট পেপারের ব্যবহার ছাড়াই ভোটদানের গোপনীয়তা রক্ষা করে। ইভিএম শতভাগ কারচুপি নিরোধক। আর নির্বাচনের শেষে, শুধু একটি বোতামে চাপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি ফলাফল পেয়ে যাচ্ছেন। ইভিএম দুটি পরস্পর সংযুক্ত ইউনিটের সমন্বয়ে তৈরি হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে, একটি ব্যালট ইউনিট যা একজন ভোটার তার ভোট দিতে ব্যবহার করেন। আর অপরটি হচ্ছে একটি কন্ট্রোল ইউনিট- পোলিং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যা ব্যবহার করেন। ইভিএমের নকশা এবং পরীক্ষা করায় সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন ১৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল। ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি কি নির্বাচনের সুষ্ঠু ফলাফল নিশ্চিত করে? নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গঠিত ইভিএম ব্যবহার সম্পর্কিত ১৯ সদস্যবিশিষ্ট এক্সপার্ট কমিটির সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের একজন ফ্যাকাল্টি ড. মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলামের মতে ইভিএম প্রযুক্তি নির্বাচনের সুষ্ঠু ফলাফল নিঃসন্দেহে নিশ্চিত করে। ড. ইসলাম বলেন, হার্ডওয়্যার অথবা সফটওয়্যার ম্যানিপুলেট করে ইভিএম সিস্টেমে কারচুপি করার কোনো উপায় নেই। ইভিএম প্রচলিত সব কারচুপির পদ্ধতি অবরুদ্ধ করে। ড. ইসলাম বলেন, ইভিএম সিস্টেমটি এমন সব উপায় অবরুদ্ধ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় সাধারণত ভোট কারচুপি হয়।
ভোট কারচুপির অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে ভোট দান শুরুর আগেই ব্যালট বাক্স বোঝাই করা। এই মেশিনগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে যদি কেউ নিজের ভোট ছাড়া অন্য কারো ভোট দিতে চায় তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে এবং ভোট শেষ হওয়ার পরে গণনার সময় আসল ফলাফলে কোনো পরিবর্তন রোধ করবে। আর ভোট শুরুর জন্য নির্ধারিত সময়ের আগে প্রবেশ করা কোনো ভোট বাতিল করার প্রোগ্রাম সংযোজিত হয়েছে। এটি শূন্য ভোট গণনা দিয়ে। প্রিসাইডিং অফিসার বা অন্য কারো কাছ থেকে কোনো নির্দেশ নেবে না। আঙুলের ছাপ না মিললে মেশিন কারো ভোট গ্রহণ করবে না। গণনা এবং সব প্রক্রিয়াকরণের কাজ মেশিন দ্বারা করা হয় এবং ড. ইসলাম জোর দিয়ে বলেন, এই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা অসম্ভব। সুতরাং ভোট কারচুপির এই তিনটি, ভোট শুরুর আগে ব্যালট বাক্স বোঝাই করা, অন্যের ভোট দেয়া এবং গণনা ও সবকিছু প্রক্রিয়াকরণ উপায় এখন ইভিএমের কারণে বন্ধ হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ইভিএম সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনে গত ২৫ মে, ২০২২ একটি মতবিনিময় সভা শেষে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে এই মেশিন প্রায় নিখুঁত এবং এটি চালানো সহজ।’ এ ব্যাপারে তিনি আরো বলেন, ‘আমি সংবাদপত্রে দেখেছি যে রাজনৈতিক দলগুলো নতুন কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করছে। আমি রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে বলব যে আপনারা যদি নতুন কমিশনও গঠন করেন তাহলেও আমি ইভিএম ব্যবহারের অনুরোধ করব।’ ‘এ পর্যন্ত ইভিএমকে ম্যানিপুলেট করার মতো কোনো সুযোগ দেখা যাচ্ছে না। একটি মেশিনকে ম্যানিপুলেট করার জন্য আপনাকে একটি লেভেল পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে যেখানে পৌঁছানো অসম্ভব।’ এই মেশিনে টেম্পার করতে চাইলে যে কেউ তা করতে পারবে কী না? একজন সাংবাদিক এ ধরনের একটি প্রশ্ন করলে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘যারা এগুলো বলেন তাদের আমি এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতে বলব।’
ইভিএমে সফটওয়্যার মেনিপুলেশনের সম্ভাবনা আছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর জাফর ইকবাল বলেন, এই সফটওয়্যারে কোনো কিছুই লোড কার যাবে না; বরং সবকিছুই রিড-অনলি মেমোরিতে (আরওএম) লোড হবে। ‘যখন আরওএমে তথ্য আপলোড করা হবে, জনগণ তা দেখতে পারবে।’ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিস্টিংগুইস্ড প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, একটি মেশিনের ওপর শতভাগ আস্থা রাখা কঠিন। তবে তিনি বলেন, ‘এই মেশিনটি (ইভিএম) এমনভাবে কাস্টমাইজড করা হয়েছে যে এর ম্যানিপুলেশন প্রায় অসম্ভব।’ ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক অলোক কুমার সাহা বলেন, ‘ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া ইভিএম একটি স্বতন্ত্র মেশিন। এটিকে ম্যানিপুলেট করা সম্ভব নয়।’
নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য করার জন্য সবাই উদ্বিগ্ন। ইভিএম এক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য বাহন। বিশ্বায়ন তথা ডিজিটাল যুগে গণতন্ত্রায়নের অব্যাহত জয়যাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য ইভিএম এখন বহুল ব্যবহারযোগ্য একটি অবলম্বন হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। ৩১ জুলাই ২০২২ তারিখ আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পর সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। এর মধ্যে ৩০০ আসনেই ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাবও আছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়াল বলেছেন আগামী সাধারণ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কিনা সে সম্পর্কে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনাররা বলেছেন ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের নেই। ইভিএম প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেছেন বর্তমানে কমিশনের কাছে প্রায় দেড় লাখ ইভিএম আছে। তিনি বলেন, ‘এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৩০০ আসনে নির্বাচন করতে হলে আমাদের সাড়ে চার লাখ ইভিএম প্রয়োজন।’ নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, সব রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন ইভিএম ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা মনোনীত এক্সপার্টদের সঙ্গে কমিশন আলোচনায় বসবে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিতভাবে ইভিএম ব্যবহারসহ অন্যান্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো পেশ করার সময় দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ভোট কারচুপি বন্ধের জন্য ইভিএমের কোনো বিকল্প নেই। যদিও কিছু সংখ্যক ভোটার প্রথম দিকে ইভিএমের বিরোধিতা করেছিলেন, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে টেকসই এবং নির্বাচন ব্যবস্থা যেখানে ভোট কারচুপি, ভোটকেন্দ্র দখল প্রভৃতি বিজ্ঞানসম্মতভাবে ইভিএম দ্বারা বন্ধ করা সম্ভব। নির্বাচনের সময় প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এবং অন্যান্য সব এজেন্সি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো যা নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন, সেসব কিছু নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগের মত হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার শুধু রুটিন কাজের মধ্যে সীমিত থাকবে। এই দলটি প্রস্তাব করেছে যে দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট অফিসার, যারা বিএনপির আমলে নির্বাচন কমিশনে, পুলিশে এবং বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নিরপেক্ষ দায়িত্ব এবং নিরপেক্ষ আচরণ প্রদর্শনের স্বার্থে তাদের নির্বাচনী দায়িত্বের বাইরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপির একটি বড়সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মী নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে, যারা বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে অথবা জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ আছে। এসব সরকারি কর্মকর্তাদের নির্বাচনী দায়িত্ব না দেয়ার দাবি ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক। মূলত ইভিএম ব্যবহারে নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় মানুষ ও মেশিনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে মানুষের উত্তীর্ণ হওয়া গণতন্ত্র ও সভ্যতার জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়