আত্মহত্যা নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বে প্রতি বছর গড় হিসাবে এর সংখ্যা বাড়ছে। করোনা-পরবর্তীতে এখন তা অনেকটাই বেশি। জীবনের প্রতি চরম হতাশা, মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা, সামান্য ভুল করলে সমাজের কটুকথা, আর্থিক টানাপড়েন, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি কারণে মানুষ মূলত আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। সম্প্রতি আত্মহত্যাবিষয়ক সচেতনতামূলক একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে একজন ভুক্তভোগীর কথা শুনলাম। সেখানে আত্মহত্যাকারী মেয়েটি অত্যন্ত মেধাবী ছিল। তার বাবার ভাষ্য মতে, সন্তানটি নিজেকে এ সমাজে মানিয়ে নিতে পারত না। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি তার ডায়রিতে নিজের স্বপ্নের কথা লিখে রাখত। কিন্তু তার পরিবারের বাস্তবতার সঙ্গে তার স্বপ্নের কোনো মিল ছিল না। সে নীরব রাগে-অভিমানে ১২ তলার ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করে। সেই পিতা এখন সন্তানহারা হয়ে পাগলপ্রায়। তিনি চান না অন্য কারো সন্তানের ক্ষেত্রে যেন এমনটা হয়।
এরপর একজন সন্তানের কথা শুনলাম। তার কথা অনুযায়ী জীবনে তার বাবাই বড় প্রতিবন্ধকতা ছিলেন। পড়াশোনার ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির ফলেই তার জীবনে ঠিক মতো পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি। তাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তরুণটি। চার তলা থেকে ঝাঁপ দিয়েও আত্মহত্যা করতে গিয়ে সে করতে পারেনি। পরবর্তীতে প্রবীণদের নিয়ে কাজ করছে সে। তার ধারণা সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মাকেও প্রযুক্তিতে আপডেট হতে হবে। তাহলেই তারা বুঝতে পারবে সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে এবং তাদের ওপর এর বাজে কোনো প্রভাব পড়ছে কিনা। এখন বাবা তাকে বোঝে এবং সেও তার বাবাকে বোঝে। তাই বাবা তার বড় বন্ধু।
এ রকমভাবে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষজন তার নিজের জায়গা থেকে আত্মহত্যার বিভিন্ন ব্যাখ্যা বা সমাধানের কথা বলেছেন। আমি যেহেতু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ নিয়ে কাজ করি আমার অভিজ্ঞতার জায়গাটাও সে দিকেই। আমার মনে হয় আমাদের সন্তানদের যে বর্তমান চাহিদা তা থেকে তাদের পারিবারিক বা সামাজিকভাবে বের করে আনতে হবে। আমি দেখেছি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ যাদের আমরা প্রতিবন্ধী বলে থাকি তারা সবচেয়ে বেশি শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগে। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানরা তিন বেলা ঠিকমতো খেতেও পারে না। অথচ তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কম। আমাদের সন্তানদের মাঝে মাঝে এসব শিশুর সংস্পর্শে নিতে হবে। তাহলে তাদের মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। যখন আমাদের পরিবারের কেউ বা আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে ভর্তি থাকে তখন আমাদের সন্তানদের নিয়ে তাদের দেখতে যাওয়া উচিত। হাসপাতালে থাকা অসুস্থ মানুষগুলোর সুস্থতা ও বাঁচার জন্য যে আকুতি তা সহজেই আমাদের সন্তানদের মানসিকতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এমন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাদের বিশেষ দিন পালন করতে নিয়ে যাওয়া উচিত, যারা জন্মের পরই এতিম হয়েছে বা অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছে। এতে আমাদের সন্তানদের ভেতরে সমাজের পিছিয়ে থাকা বা অবহেলিত মানুষদের প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। নিজের লাগামহীন চাহিদার বেড়াজাল থেকে কিছুটা হলেও তারা বের হতে পারবে।
আমরা বিনোদনকেন্দ্রে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, পারিবারিক আনন্দ আয়োজনের বাইরে নিজের সন্তানদের এসব ব্যাপারে বাস্তবিক ধারণা দিলে তাদের ভেতরে জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দ পাবে, হতাশা থেকে বের হতে পারবে বলে আমি মনে করি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে এসেছিল এ তথ্য। গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের বেশি। গত বছর সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে গত ৮ মাসে ৩৬৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এ পরিসংখ্যান আমাদের জন্য সত্যিই অশনিসংকেত।
কাব্য সুমী সরকার : প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, ময়মনসিংহ ডিভিশনাল স্কুল এন্ড কলেজ।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।