মর্টার শেল নিক্ষেপ,: রোহিঙ্গা নিহত, আহত ছয়জন

আগের সংবাদ

মাঠে মারমুখী আওয়ামী লীগ

পরের সংবাদ

বঙ্গমাতা সেতু দক্ষিণের খোলা জানালা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেশের দুই বিভাগ খুলনা ও বরিশালের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ শুরু হলো। গত ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিরোজপুরের কচা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি উদ্বোধনের মাধ্যমে শুভ সূচনা করেন। মাত্র দুই মাস আগে পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন করে সমগ্র দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষকে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত করার পরই এ সেতুর দ্বার খুলে দেয়া হলো পিরোজপুর তথা দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের জন্য। উন্নয়নের মূল ধারা থেকে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণ অঞ্চলকে উন্নয়নের শ্রোতধারায় এগিয়ে নিতে বঙ্গমাতা সেতু সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ সেতু নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন দুই বাণিজ্য নগরী খুলনা ও বরিশালের মধ্যে অভাবনীয় মেলবন্ধন তৈরি হলো।
পিরোজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসমিনা জেরিন, কচা নদীর অপর পার থেকে প্রতিদিন স্কুলে যেতে তাকে পাড়ি দিতে হতো প্রায় এক কিলোমিটার প্রস্থের খরস্রোতা এ নদী। কোনোদিন ফেরির জন্য অপেক্ষা করে ক্লাসে দেরিতে উপস্থিত হতে হয়েছে আবার কখনো বা পরীক্ষায় অংশগ্রহণে যথাসময়ে উপস্থিত হতে পারেনি। প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের এমন হাজারো গল্প শুধু তাসমিনা জেরিনের নয়, পিরোজপুরের অনেক শিক্ষার্থীর নিত্য জীবনের সঙ্গী ছিল। যা এখন কেবলই অতীত। এছাড়াও কাউখালীর কোনো মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া কিংবা বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি এখন শান্তিতে পরিণত হয়েছে। পিরোজপুর সদর উপজেলা ও কাউখালী উপজেলার মধ্যবর্তী বেকুটিয়া এলাকায় কচা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সেতুতে পরিণত হয়েছে। তাই পদ্মা সেতুর পর পর এ সেতু উদ্বোধন তাদের কাছে স্বপ্ন দেখা দক্ষিণের খোলা জানালার মতোই সুখের হাওয়া নিয়ে সামনে হাজির হয়েছে।
এ সেতুবন্ধনের মাধ্যমে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত সাগরকন্যা-খ্যাত কুয়াকাটা এবং বিশ্বের অন্যতম নয়নাভিরাম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলো। যার ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে, যার প্রাণকেন্দ্র হবে প্রাকৃতিক সবুজের লীলাভূমি পিরোজপুর। বিভাগীয় শহর বরিশালের সঙ্গে শিল্পনগরী খুলনার সড়ক যোগাযোগে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এ সেতু নির্মাণের ফলে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের প্রায় ২ কোটি ৬১ লাখ মানুষের যোগাযোগের সময় সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে ব্যয়ও কমবে। এছাড়াও গভীর সমুদ্রবন্দর পায়রার সঙ্গে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা ও সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
ফলে তিনটি সমুদ্রবন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানির নতুন সংযোগ তৈরি হবে, খুলে যাবে অর্থনীতির দ্বার। দূরত্ব কমে যাওয়ায় পিরোজপুরের চিকিৎসা, শিক্ষা, কেনাকাটার পথ আরো সহজ ও সুগম হবে। কাউখালী উপজেলার ব্যবসায়ী জসিম হাওলাদার ও গনেশ দাস তাদের উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেন এভাবে- ‘খুলনা থেকে পণ্য এনে পিরোজপুর হয়ে ফেরিতে করে কাউখালী নিয়ে যেতাম। অনেক সময় নদীতে পড়ে পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। ফেরি অনেক বিকল থাকত। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু উদ্বোধন হওয়ায় আমরা খুশি। আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। দীর্ঘায়ু কামনা করছি তার।’ বরিশালের পটুয়াখালীতে প্রচুর পরিমাণ মুগডাল উৎপাদিত হয়, এখন থেকে তা আরো সহজে দেশ-বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। বরিশালের অনেক কৃষিপণ্য মোংলা সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে রপ্তানির সম্ভাবনা দেখা দেবে যেমন- নারিকেল, সুপারি, তরমুজ, পেয়ারা, মুগডাল, আমড়া, ধান, পান ইত্যাদি। খুলনা থেকে বরিশালের দূরত্ব যেমন কমবে আবার কৃষি, শিল্প, মৎস্য, সেবা, পর্যটন, আবাসন, স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ তৈরি হবে। এর সুফল যতটা না দেখা যাবে অঙ্কের হিসাবে তার চেয়ে বেশি দেখা যাবে মানুষের জীবন মানোন্নয়নে। দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রী সারাদেশের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপন করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বঙ্গমাতা সেতু তার অনন্য উদাহরণ।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণাঞ্চল সব সময় অবহেলিত ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এ সেতু উদ্বোধনের সময় বলেন, শিল্পায়ন ও ব্যবসা বাড়াতে দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে; আধুনিক পরিবহনের অংশ হিসেবে মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলো নির্মাণ শেষ হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরো বেগবান হবে। পিরোজপুরের বেকুটিয়ায় কচা নদীর ওপর বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু উদ্বোধনের ফলে ঢাকার সঙ্গে পিরোজপুরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। জনগণ পিরোজপুরের তাজা পেয়ারা ও আমড়া রাজধানীতে বসেই পাবে। এই অঞ্চলের শীতলপাটিও বিখ্যাত। জেলার বাসিন্দারা অন্যদের পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন করতে পারবে, যা জেলা ও এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে ব্যাপক অবদান রাখবে। চীনের অর্থায়নে সেতুটি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে চীনকে পরম বন্ধু বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়াও বঙ্গমাতা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাবে। এটি পটুয়াখালীর শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্ট এবং যশোর সেনানিবাসের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করবে। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল থেকে পায়রা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বপ্নের দুয়ার খুলে যাবে। সেতু চালু হওয়ার ফলে আশপাশে বাণিজ্যের পরিধি বাড়বে। আর শিল্পকারখানা নির্মিত হলে স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দুই মাস পর এই সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগের এক নবদিগন্ত উন্মোচিত হলো। এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় সেতুটি ঘিরে কচা নদীর দুই তীরের মানুষের মধ্যেও খুশির জোয়ার বইছে। চাইনিজ মেজর ব্রিজ রিকনেসেন্স এন্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউট কোম্পানি লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে চায়না রেল ওয়াচ ১৭ ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড সেতুটি নির্মাণ করে। বঙ্গমাতা সেতুটি অন্য সেতুর চেয়ে অনন্য ও নান্দনিক স্থাপনার আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। এ সেতু সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়ার আরেকটি অনন্য নজির। বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০৪১ সালের উন্নত সমৃৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্জনে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও পর্যটন অর্থনীতির কানেক্টিভিটি হিসেবে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।

আবু নাছের ভূঁইয়া : শিক্ষক ও গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়