কাগজ প্রতিবেদক : বাংলাদেশের মঞ্চ ও টিভি নাটকে উল্লেখযোগ্য নাম খালেদ খান। যুবরাজ নামেই যিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। অভিনয় অন্তঃপ্রাণ খালেদ খান গোটা জীবন দাপিয়ে বেরিয়েছেন মঞ্চে। ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ থেকে ‘নূরল দীনের সারা জীবন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘রক্তকরবী’ নাগরিক নাট্যস¤প্রদায়ের এই নাটকগুলোতে দুর্দণ্ড প্রতাপে তিনি মঞ্চ মাতিয়েছেন বহু বছর। টিভি নাটকেও তিনি কিংবদন্তি; ‘রূপনগর’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘তুমি কোন কাননের ফুল’, ‘লোহার চুড়ি’ নাটকগুলোতে তিনি এখনো দর্শক হৃদয়ে জাগরুক।
অভিনয়ের দিনগুলোতেই পরিচয় হয়েছিল কিন্নরকণ্ঠী মিতা হকের সঙ্গে। রবীন্দ্র সংগীতের কিংবদন্তি এই শিল্পীর সঙ্গে তিনি ঘর বাঁধলেন। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অভিনয় ও সংগীতের মেলবন্ধনে অসা¤প্রদায়িক আন্দোলনের যে ধারা রচিত হয়েছিল আশির দশকে, তাতে খালেদ খান ও মিতা হকও ছিলেন সম্মুখভাগে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় মিতা হক ও খালেদা খানের সেই অনবদ্য যাত্রার কথা স্মরণ করলেন তাদের অগ্রজ ও সতীর্থ সংস্কৃতিজনরা।
গতকাল শুক্রবার বিকালে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে যুবরাজ সংঘের আয়োজনে ‘মিতা ও যুবরাজ উৎসব’-এ সামিল হয়ে তারা স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে তুলেন আনলেন দুই কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনের নানা অধ্যায়। ‘বিবিধের মাঝে দেখা মিলল মহান/অসা¤প্রদায়িকতা ও মিতা-যুবরাজ’ শিরোনামে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন বাংলা নাটকের আরেক কিংবদন্তি অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। অতিথি হিসেবে ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সারা যাকের, প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক, অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী, ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা, জ্যেষ্ঠ রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী বুলবুল ইসলাম।
এই আয়োজনটি নিয়ে মিতা হকের মেয়ে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ফারহিন খান জয়িতা বলেন, আমি বরাবরই মনে করি, একজন প্রকৃত শিল্পীর সবসময় তার দেশের প্রতি, দশের প্রতি, সমাজের প্রতি কিছু আদর্শগত দায়বদ্ধতা থাকে। সৌভাগ্যক্রমে এই দম্পতির সন্তান হওয়ায়, আমি দেখেছি তাদের এই গুণটি। শিল্প চর্চার পাশাপাশি তারা কীভাবে সমাজ নিয়ে ভেবেছেন, কীভাবে দেশ নিয়ে ভেবেছেন,

কীভাবে সংস্কৃতি নিয়ে ভেবেছেন এবং তাদের গণ্ডির মধ্যে ও গণ্ডির বাইরে কীভাবে তাদের দর্শনগুলোকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সংস্কৃতি যতবার আক্রান্ত হয়েছে, তারা তাদের জায়গা থেকে কখনো নীরবে, কখনো সরবে কাজ করে গেছেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কখনো মাঠে থেকে সরব হয়েছেন, কখনো বা ছাত্রছাত্রীদের কিংবা শিষ্যদের এই মনন তৈরিতে কাজে লেগে গেছেন।
জয়িতা বলেন, একটা অসা¤প্রদায়িক রাষ্ট্রের স্বপ্ন তারা দেখতেন। স্বাধীনতার অর্ধশতক পার হবার পরেও দেশ যখন বারবার সা¤প্রদায়িক আচরণের শিকার হয়, তখন আমরা ভাবি, তাদের মতন এই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আকুতি যেই অগণিত মানুষের আছে, সেই কাজটা বোধ হয় এখন শুরু করা প্রয়োজন। যারা ইতোমধ্যে এগুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, আমাদের অগ্রজরা, তাদের মধ্যেও এই আশার আলোটা জ্বালানো প্রয়োজন। আমরা তাদের মশাল আলোকিত পথেই আছি। সেই ভাবনা থেকেই, আমাদের এই উৎসবের মূল মন্ত্র অসা¤প্রদায়িকতা।
নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বলেন, খালেদ খান নিঃসন্দেহে একজন উঁচু মাপের অভিনেতা। মঞ্চের সেরা অভিনেতাদের মধ্যে সে ছিল একজন। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য সে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসেবে মিতা হক শুধু বাংলাদেশেই না, ভারতের গণ্ডি ছাপিয়ে সব বাংলা ভাষাভাষীর কাছে সমাদৃত হয়েছেন। তার সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও দেশের প্রতি যে নিবেদন তা নতুন প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয়। এ দম্পতি নতুনের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। এ উৎসবে খালেদ খান, মিতা হক নতুনদের পথ দেখাবে।
অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী বলেন, প্রকৃত অর্থে মঞ্চের যুবরাজ ছিলেন খালেদ খান। আশির দশকে ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ ও ‘অচলায়তন’ নাটকে তার যে অভিনয়, তা এখনো আমার হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। এ শক্তিমান অভিনেতা অসা¤প্রদায়িক চেতনা বাস্তবায়নে আমৃত্যু কাজ করেছেন। একইভাবে মিতা হক শিল্পী হিসেবে অসা¤প্রদায়িক দেশ ও রাষ্ট্র গড়ার কারিগর ছিলেন। এ ধরনের শিল্পীর মৃত্যু হয় না, দেহাবসান হয়।
উৎসবে আবৃত্তি পরিবেশন করেন সুবর্ণা মুস্তাফা, আসাদুজ্জামান নূর ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। মাসুম রেজার নাটক ‘আবছায়ায় যুবরাজ’-এ দীর্ঘদিন পর মঞ্চে পারফর্ম করেন ইন্তেখাব দিনার। তার সঙ্গে ছিলেন রওনক হাসান, ত্রপা মজুমদার ও জ্যোতি সিনহা। নৃত্য পরিবেশনায় ছিলেন সামিনা হোসেন প্রেমা, র‌্যাচেল প্রিয়াংকা প্যারিস ও কস্তুরী মুখার্জি। বাউল গান পরিবেশনায় ছিলেন আরিফ বাউল ও সুরতীর্থ।
উৎসব উপলক্ষে খালেদ খান ও মিতা হকের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক জীবনের নানা আলোকচিত্র ঠাঁই পেয়েছে জাতীয় নাট্যশালার লবিতে। লবির নিচতলায় ব্যানারে রংতুলিতে মিতা হক ও খালেদ খানের সুহৃদরা লিখেছেন স্মৃতিচারণ।