পল্টনে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য-হকার সংঘর্ষে আহত ৬

আগের সংবাদ

জোয়ারের পানিতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি : কলাপাড়ার ৬০ কিলোমিটার সড়কের অধিকাংশই কাঁচা

পরের সংবাদ

‘মোমেন বাদ যে কারণে’

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ৬ সেপ্টেম্বর ভোরের কাগজের প্রথম পাতায় শীর্ষ ডানে এমন একটা শিরোনাম আগে দেখে বিনে পয়সায় ‘ই-ভোরের কাগজ’ পড়তে অভ্যস্ত হওয়া আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু আটলান্টিকের ওপার থেকে বিনে পয়সার হোয়াটসঅ্যাপ-এ আমাকে ফোন করে বলল, কারণটা কী?
কিসের কারণ? আমি জিজ্ঞেস করি।
ভোরের কাগজ ভালো করে দেখ, তোকে বাদ দিয়েছে।
ভোরের কাগজ আমাকে রাখুক আর বাদ দিক এ নিয়ে খবর হওয়ার কারণ নেই। ভোরের কাগজের সঙ্গে লেখালেখির সম্পর্ক সিকি শতাব্দীর। আমি নিজেই একবার রাগ করে ভোরের কাগজ বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম। এখন যদি আমাকে বাদ দিয়ে দেয় তাহলে বলা যাবে খেলাটা ড্র হয়ে গেছে। দুদিকেই একবার একবার করে বাদ।
রাগটা ভাঙিয়ে সম্পাদক নিজেই যখন আবার টেনে এনেছেন বাদ দিতে নিশ্চয়ই কিছুটা অস্বস্তি বোধ করবেন। তারপরও যেসব কারণে আমি বাদ পড়ে যেতে পারি তার একটি চেকলিস্ট দাখিল করতে চাই :
১. আমার সাপ্তাহিক কলাম ভোরের কাগজের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
২. আমার লেখায় রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মদ্রোহ ও নারী অবমাননার উপাদান থাকে।
৩. টেলিভিশন হলে বলা যেত আমার টিআরপি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এখন বলতে হবে এমনিতেই পাঠক নেই, দু’চারজন যারা ছিলেন এখন আমার নাম দেখলেই পাতা উল্টে ফেলছেন।
৪. নৈতিক সংকটের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে যা পত্রিকার ভাবমূর্তিকেও স্পর্শ করতে পারে।
৫. উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ আমাকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে (আর্থিক দেউলিয়াত্বই বেশি গ্রাহ্য, নৈতিক দেউলিয়াপনা পরিমাপের সমস্যা রয়েছে)।
৬. আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- সোজা কথা আমি পাগল হয়ে গেছি।
৭. অজ্ঞাত কারণে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই আসল কারণ) বাদ দেয়া হয়েছে।
এ লেখাটিও পরীক্ষামূলক- প্রকাশিত না হলে আমাকেই বুঝে নিতে হবে যে আমি আমলেই বাদ পড়ে গেছি।
এটা ঠিক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ সফরসঙ্গী হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দিল্লি যাওয়া থেকে বাদ পড়া নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমার ‘নেইমসেক’ অথবা আমি তার। যখনই এটা ওটা লিখি ভাবি আমার লেখার গুণগতহীন মানের কারণে না জানি তিনি কোন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কিংবা তার কাছে তার ভক্তদের যা প্রত্যাশা আমার লেখায় তা না পেয়ে হয়তো তাকে ভুল বোঝেন এবং বলেন তলে তলে তা হলে এই অবস্থা। কিন্তু মন্ত্রীরা যখন বলেন তাদের ‘নেইমসেক’ যারা আছেন তারাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারেন নিশ্চয় কেউ কেউ ভাবেন না। ভাবলে মেপেটেপে কথা বলতেন, গোপন কথা গোপনেই রাখতেন। ঘরের কথা পরের জানার কী দরকার।
আমার সরকারি চাকরি জীবনে ১৯৮৮-৮৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলাম। সচিব তখন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও কর্মতৎপর আমলা এম মোকাম্মেল হক। আমি সহকারী সচিব, আমার চেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন মোমেনুল হক, সবাই তাকেও মোমেন নামেই চিনতেন। সচিবের দপ্তরে শ্যামবর্ণ লম্বা একজন পিয়ন ছিলেন তার নামও মোমেন। কখনো কখনো আমাদের তিনজনের কানই খাড়া হয়ে থাকত, সচিব তিনজনের যে কোনো একজন মোমেনকে নাম ডাক ধরে ডাকলে আমরা তিনজনই একসঙ্গে সাড়া দিতে প্রস্তুত থাকতাম- জি স্যার।
নেইমসেইক হবার কারণে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে মানবাধিকার সংস্থার হস্তক্ষেপের কারণে ২১ বছর দণ্ডভোগের পর মুক্তি দেয়া হলো- মুক্তির কারণ আদালতের কোমল মন নয় বরং ২১ বছর পর আদালত নিশ্চিত হয়েছে প্রকৃত আসামি নগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর তার নামে নাম হওয়া নিরীহ একজন দুই দশকের বেশি সময় কারাগারেই কাটিয়ে দিয়েছে। গল্প-উপন্যাসে পড়েছি একই নাম হওয়ায় ‘অ্যাঞ্জেল অব ডেথ’-ও ভুল করে থাকেন, এক আর্থারের বদলে অন্য আর্থরের জান কবচ করে নেন।
অফিস থেকে স্ট্যালিনের ঘড়ি চুরি করেছে কোনো এক কনস্ট্যানটিন। প্রথম ১২ ঘণ্টায় স্ট্যালিনের ঘড়িসহ ২০ জন কনস্ট্যানটিনকে ধরা হয়, দ্বিতীয় ১২ ঘণ্টায় স্ট্যালিনের ঘড়িসহ যে ১০ জনকে ধরা হয়েছে তারা স্বীকার করতে চাইছে না যে তারা কনস্ট্যানটিন। কেজিবি প্রধান স্ট্যালিনকে আশ্বস্ত করলেন। হুজুর, আর ১২ ঘণ্টার রিমান্ড দিন, ওদের স্বীকার করিয়ে ছাড়ব যে ওদের কনস্ট্যানটিন। স্ট্যালিন বেডরুমে ঢুকে দেখেন ঘড়িটা বালিশের কাছে, তাড়াহুড়োর কারণে হাতে পরা হয়নি। তিনি ভেবেছেন চুরি হয়ে গেছে।
২০২০ সালের শেষে ভারতে ব্যাঙ্গালুরুতে এক তরুণ ব্যবসায়ী বিজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে জানিয়েছেন : আমি কোভিদ কিন্তু ভাইরাস নই। তার পুরো নাম কোভিদ চন্দ্রশেখর। আরো একজন জানালেন তিনি কোভিদ ধীরুপিল্লাই। বাবার রাখা নামের কারণে তাকে ভুগতে হয়েছে। তবে কোভিদ চন্দ্রশেখরের মতো বিত্তবান না হওয়ায় তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে পারেনি।
মোমেন নামের অন্তত আরো দুজন মন্ত্রীর নাম আমার জানা, দুজনেই খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। তবে তারা কেউ বেফাঁস কিছু খেয়েছেন বা বলেছেন বলে বাদ পড়েননি, মোমেন নামের অন্য কারো জন্যও অস্বস্তির কারণ হননি।
দিল্লি যাওয়া থেকে বাদ পড়া মানে এই না যে নিউইয়র্ক যাওয়া থেকে বাদ পড়বেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠক এসে গেল, নিশ্চয়ই তিনিও যাবেন।
দেশ রূপান্তর চার কলামে লিখেছে অস্বস্তি এড়াতে মাইনাস মোমেন। মাইনাস কথাটা ২০০৭-এ বহুবার শুনেছি, মাইনাস টু। আমার নেইমসেককে যেন উপ-প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন সে কামনাও কেউ কেউ করেছেন। আমিও বলি, গুডলাক।
আমার নামের একজন কেউ মন্ত্রী থাকলে আমিও শার্টের কলারে টোকা দিয়ে বলতে পারি : দেখলে তো।
সমস্যা তখনই হয়, সত্যি বলুন আর মিথ্যে বলুন তার কথা যদি ‘ননসেন্স টক’ হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। তার দল থেকে বলা হয় এসব ব্যক্তিগত কথন। ননসেন্স টক শুনে মন্ত্রীদের যারা প্রতিপক্ষ তারা আমোদ লাভ করেন, যারা স্বজন এবং আপন দলের তারা বিব্রত হন, যারা নেইমসেক তারা বিব্রত হলে তাদের বন্ধুরা ঠাট্টা করার বিষয় পেয়ে যায়।

মন্ত্রীরা কেন চাকরি হারান না
এই এপিসোডটি মোটেও দক্ষিণ এশীয় কোনো দেশের নয়। রাজা-শাসিত দেশের। রাজা বেছে বেছে তারা মন্ত্রিপরিষদ সদস্য নির্বাচন করে থাকেন। তারপরও ঊনিশ-বিশ হয়ে যায়। মন্ত্রীদের কেউ কেউ স্ত্রী কিংবা শ্যালিকার প্ররোচনাতেই হোক কিংবা সরল বিশ্বাসেই হোক রাজাকে যে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যে প্রস্তাবের অনুমোদন রাজার কাছ থেকে গ্রহণ করেন শেষ পর্যন্ত তা কল্যাণকর নাও হতে পারে। সেজন্য রাজা প্রতিনিবৃত্তিমূলক ব্যবস্থা রেখেছেন। তার সংগ্রহে দশটি ভয়ংকর বুনো কুকুর রয়েছে। এগুলোকে মন্ত্রীখেকো কুকুর হিসেবে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। মন্ত্রীরা যেদিন শপথ নেন সে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান এই দশটি কুকুরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কুকুর তাদের চিনে রাখেন। কোনো মন্ত্রী রাজাকে বিপথে পরিচালনা করলে এবং রাজা তা বুঝতে পারলে তার পেছনে এই দশ কুকুর লেলিয়ে দেন। মন্ত্রীকে হত্যা না করা পর্যন্ত কুকুররা ক্ষ্যান্ত দেয় না।
একবার এক মন্ত্রী রাজাকে ভুল পরামর্শ দিলেন। ভুলটা রাজা সঙ্গে সঙ্গেই ধরে ফেললেন এবং তিনি তার ডগ স্কোয়াডকে প্রস্তুত করতে বললেন। এটাই প্র্যাকটিস, আগেও তার ক’জন মন্ত্রীকে কুকুরদের কাছে নিক্ষেপ করা হয়েছে। রাজা আদেশ দিলেন, এই মন্ত্রীকেও নিক্ষেপ করা হোক। কুকুরই উত্তম বিচারক।
মন্ত্রী করজোড়ে বললেন, স্যার আমি দশটি বছর একান্ত অনুগত হিসেবে আপনার সেবা করেছি, বিনিময়ে আপনি আমাকে কুকুরের ভোজে লাগাচ্ছেন।
কিন্তু রাজার মনে দয়ার উদ্রেক হয় না, তিনি অনড়।
মন্ত্রী বললেন, তাহলে আমাকে কুকুরের কাছে নিক্ষেপ করার আগে অনুগ্রহ করে ১০ দিন সময় মঞ্জুর করুন।
রাজা পরিষদের দিকে তাকালেন, তারাও এই সহকর্মীর জন্য ব্যথিত। তাদের চেহারা ফুটে উঠেছে একই মিনতি- রাজা যেন তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। রাজা সত্যিই সময় মঞ্জুর করলেন।
সেই ১০ দিনের প্রথম দিন দণ্ডপ্রাপ্ত মন্ত্রী রাজকীয় কুকুররক্ষকের সঙ্গে দেখা করে বললেন, সামনে ক’টা দিন আমি কুকুরগুলোর দেখাশোনা করব, আপনি ইচ্ছে করলে বাড়িতেও বিশ্রাম নিতে পারেন, সস্ত্রীক শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘুরেও আসতে পারেন। আমার হাতে কুকুরের কোনো অযতœ হবে না।
কুকুররক্ষকও মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিতে সম্মত হলেন।
কুকুররাও মন্ত্রীকে পেয়ে সংকট হলো। এতদিন শুনে এসেছে মন্ত্রীরা শুধু জনগণের খাদেম। কুকুরেরও সে খাদেম হবার কথা, মুখ ফুটে সে কথা তারা কখনো বলেন না।
মন্ত্রী মনপ্রাণ দিয়ে কুকুরসেবায় ব্রত হলেন, ভালো খাবার দিলেন, উত্তম ডগ শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করালেন, কুকুরের পা ম্যাসাজ করলেন, বিকেলে তাদের সঙ্গে ছুটোছুটি খেললেন। কুকুররা তার সেবায় সন্তুষ্ট।
১০ দিন পেরোল। কুকুররক্ষকের হাতে কুকুরদের সমর্পণ করে প্রহরীবেস্টিত তিনি অবস্থায় দরবারে এলেন।
রাজা বললেন আর এক মুহূর্তও নয়, এক্ষণি তাকে ডগ স্কোয়াডে নিক্ষেপ করো।
এটাই শাস্তি। তাকে নিক্ষেপ করা হলো। সবাই বিস্মিত হয়ে দেখলেন কুকুরের আচরণ বদলে গেছে, তারা লেজ নেড়ে সাজাপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে স্বাগতম জানাচ্ছে। মন্ত্রীর শরীরে ছেদন দস্ত বসানো দূরের কথা জিহ্বা দিয়ে সব কুকুর তা পা চাটতে শুরু করেছে। রাজা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। কুকুরগুলোর কি হলো? তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন। পরিষদের অন্য সদস্যরাও থ।
এবার মন্ত্রী বললেন, আমি মাত্র ১০ দিন কুকুরগুলোর সেবা করেছি। তারা আমার সেবা ভুলেনি। আমি ১০ বছর আপনার সেবা করেছি, একটা ভুলের কারণেই আপনি আমার সব সেবা ভুলে গেলেন।
রাজা বুঝতে পারলেন, তাকে অন্তত কুকুরের সমমানের তো হতে হবে, কুকুরেরও অধম হলে তো চলবে না। মন্ত্রী ক্ষমা পেয়ে গেলেন এবং দাঁত কেলিয়ে মন্ত্রিত্ব করতে লাগলেন।
এর মধ্যে রাজা ডগ স্কোয়াড ভেঙে দিলেন। আদেশ করলেন, ১০ কুমিরের একটি স্কোয়াড গঠন করা হোক, ক্রোকোডাইলস স্কোয়াড ফর মিনিস্টার্স।
কুমির প্রশিক্ষিত করে মন্ত্রী চেনানো যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ একটি ব্যাপার। রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, আপাতত কোনো মন্ত্রীকে আর চাকরিচ্যুত করবেন না তা মন্ত্রী যত দুষ্টই হোন।

পাদটীকা :
সংসদীয় গণতন্ত্র চালু আছে যে কোনো দেশে যে কোনো মন্ত্রীর বাদ পড়া না পড়া পুরোটাই প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। আর আমার কলাম অব্যাহত থাকা না থাকা সম্পাদকের এখতিয়ার। নেইমসেক হলেই ঘাবড়াতে নেই।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়