মিতু হত্যাকাণ্ড : আদালতে চার্জশিট দাখিল, শুনানি ১০ অক্টোবর

আগের সংবাদ

নতুন ৮ নদীর পানিবণ্টনে নজর : আলোচনায় সম্মত বাংলাদেশ ও ভারত, আগামী মার্চ এপ্রিলে ঢাকা সফরের সম্ভাবনা ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রীর

পরের সংবাদ

ভারত : প্রীতি-ভীতির আচানক বাতিক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভারত আর আওয়ামী লীগের প্রতি সন্তুষ্ট নয় বলে একটা তথ্য ছড়িয়েছে বাজারে। বক্তব্য বা মন্তব্য হিসেবে তা লুফে নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে মূল ধারার গণমাধ্যমও। কেন তার জরুরি হয়ে পড়ল এমন তথ্য বাজারজাত করা? অকারণেও ভারত বন্দনা, আবার হেতু ছাড়াই সমালোচনার একটা চর্চা বাংলাদেশে অনেকদিনের। বন্দনা আর সমালোচনা কোনোটাতেই যুক্তি-তথ্য কোনো কিছুর ধার ধারতে হয় না। বললেই চলে। লিখলেই হয়ে যায়। তা কখনো ঘটনাদৃষ্টে। আবার কখনো কখনো ঘটনা বা প্রসঙ্গও লাগছে না। একটা যাচ্ছেতাই দশা। এ ব্যাপারে কোনো শাসন-বারণও নেই।
ভারত প্রশ্নে ফ্রিস্টাইল এ ধারাটি জমেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফর নিয়েও। তাকে দেয়া সংবর্ধনার রকমফের, ভারতকে ইলিশ দেয়া, মমতার না আসার মতো ঠুনকা ব্যাপার নিয়ে রীতিমতো হাউ কাউ। যেন এগুলোই আসল ঘটনা। এসবের ডামাডোলে জরুরি বিষয়গুলো আড়ালেই পড়ে গেছে। বাণিজ্য ঘাটতিসহ ভারতের সঙ্গে বড় বড় আরো কত ইস্যু পড়ে আছে আলোচনার বাইরে। প্রাপ্তি না এলেও তিস্তা অবশ্যই বড় ইস্যু। কিন্তু একমাত্র ইস্যু নয়। আশপাশে আরো মোক্ষম ও জরুরি অনেক কিছু রয়েছে।
তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে ভারতের বিনা শুল্কে ট্রানজিট দেয়ার প্রস্তাবটি অনেকের বোধবুদ্ধিতেও আসেনি। বাস্তব বোঝা অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের কাছে এটি একটি অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি। তারা বলছেন, এটি বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। তবে এটি কাজে লাগানো বিশেষভাবে নির্ভর করবে কূটনৈতিক দক্ষতার ওপর। নির্ভর করবে বলেও মনে করেন তারা। ১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট আমদানি ব্যয় হয়েছে ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। আর এ সময় রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। যেখানে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। এমন বাণিজ্য ঘাটতির মধ্যে ভারতের বিনা শুল্কে ট্রানজিট দেয়ার প্রস্তাবটি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা। শুল্কমুক্ত ট্রানজিটের পাশাপাশি বন্দরগুলোকে আরো সময়োপযোগী করতে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়ও রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক কাজের বাইরে প্রধানমন্ত্রী এ সফরে বাণিজ্যিক এজেন্ডায় এগিয়েছেন অনেক দূর। সফরের প্রথম এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের আগের দিনই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর সম্রাট গৌতম আদানির সঙ্গে। যে গ্রুপটির সাম্রাজ্য এখন আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। গত পাঁচ-সাত বছরে ভারতীয় এই শিল্পপতি প্রতিবেশী বাংলাদেশেও লগ্নির পরিমাণ ক্রমশ বাড়িয়েছেন। দুনিয়াজোড়া কয়লাখনি, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বন্দর থেকে শুরু করে এলপিজি বা রান্নার তেল- সব খাতেই তার বিশাল রাজত্ব। বাংলাদেশের অ্যানার্জি সেক্টরেও বিশাল বিনিয়োগ তার। মাত্র গত সপ্তাহেই ব্লæমবার্গ বিলিওনেয়ার র‌্যাংকিংয়ে তিনি উঠে এসেছেন দুনিয়ার তিন নম্বর ধনী হিসেবে। ধনসম্পত্তির বিচারে আদানির অবস্থান এখন স্পেসএক্সের ইলন মাস্ক ও অ্যামাজনের জেফ বেজোসের ঠিক পরেই।
দিল্লি সফরের প্রথম দিনেই সেই গৌতম আদানির সঙ্গে শেখ হাসিনার একান্ত বৈঠক তাক লাগিয়ে দিয়েছে কেবল ভারত-বাংলাদেশ নয়, আশপাশের দুনিয়াকেও। যা বাংলাদেশের আগামী রাজনীতি ও অর্থনীতির বাঁক ঘুরিয়ে দেয়ার অন্যতম মন্ত্র হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশের নৌপরিবহন, উন্নত প্রযুক্তির জ্বালানি এবং সেবা খাতে বড় পরিসরে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায় গোষ্ঠী আদানি গ্রুপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর একটি ছবি টুইটার হ্যান্ডেল থেকে একটি পোস্ট দেন গৌতম আদানি। পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে অত্যন্ত সম্মানিত। বাংলাদেশ নিয়ে তার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা অত্যন্ত সাহসী এবং অনুপ্রেরণা দেয়।’ গৌতম আদানি তার টুইটে এও লিখেছেন, ‘বিজয় দিবস, অর্থাৎ ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ।’
আদানি গ্রুপ বিদ্যুতের যে সঞ্চালন লাইন তৈরি করেছে, সেটার ধারণক্ষমতা তো বেশি। এবার তারা সোলার ও উইন্ড মিলে ব্লেন্ডেড এনার্জির নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি অভিনব। শুল্কমুক্ত সুবিধা বৈদেশিক বাণিজ্যে বৈধ। আমরা গরিব শ্রমিকদের রক্ত পানি করে তৈরি করা পোশাক ইউরোপ আমেরিকার বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাই, যার লাভের ওপর ওই শ্রমিকের কোনো অংশীদারিত্ব নেই। তারপর ও আমরা চাই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু ভুলে যাই। ইলিশ আমরা মাগনা দিচ্ছি না। এক কেজির নিচের ইলিশ প্রায় ১০ ডলারে বিক্রি করছি। সপ্তাহ দুয়েক আগে আমরা ভারত থেকে কাঁচা মরিচ এনেছি। ৩০০ টাকার কাঁচামরিচের কেজি ৬০-৭০ টাকায় নামিয়ে আনলাম দিন কয়েকের মধ্যে। সেই ম্যাজিকটা ভুলে গেছি। পৃথিবীর ধনী-গরিব, উন্নত অনুন্নত দেশকে একে অপরের ওপর নির্ভর করতে হয়। ইউরোপকে দেখেও শিখছেন না। রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে গোটা ইউরোপে তামা তামা দশা। সেখানেও আমদানি-রপ্তানি চলছে যার যার সুবিধা ও যোগ্যতা-দক্ষতা মতো। দেশের প্রয়োজনেই ভারতীয় পণ্য আমদানি হয়, যা দোষের কিছু নয়। তবে আবার বাংলাদেশি অনেক পণ্যও ভারতে রপ্তানি হতে পারে। বিপুল জনসংখ্যা আর বিশাল অর্থনীতির দেশ ভারত। প্রতিবেশী হওয়ার দেশটির সঙ্গে প্রচুর আমদানি-রপ্তানি হয় মূলত স্থলবন্দর দিয়েই। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ভারতের পাল্লা বাংলাদেশের চেয়ে চার গুণেরও বেশি ভারি। সেখানে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজার বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও, কিছু জটিলতায় তা আটকে আছে।
আগের বছরগুলোতে কম থাকলেও গেল বছর ‘ভারতে মেড ইন বাংলাদেশ’ পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৭০ শতাংশ। বন্দর এবং শুল্কসহ কিছু জটিলতা না থাকলে রপ্তানি আরো বেশি হতো। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি ব্যাপক হারে বেড়েছে। ভারতের হিসাবে গত অর্থবছরে তাদের কাছ থেকে যেসব দেশ পণ্য আমদানি করেছে, তার মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। দুই বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল পঞ্চম স্থানে।
করোনার সংক্রমণ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে তুলনামূলক কম দূরত্বের বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য উচ্চহারে বেড়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ ও ভারত কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়লে ক্ষতি কী? বাংলাদেশ তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিনা মাশুলে ভারতে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার প্রস্তাবটি কার্যকর হলে নির্ধারিত স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ এ সুবিধা নিতে পারে। পাশাপাশি ভূগোলের দুদেশের সম্পর্কের বিভিন্ন দিকের পাশাপাশি চলমান সহযোগিতা, অমীমাংসিত বিষয়, ভবিষ্যৎ সহযোগিতা ও নতুন প্রস্তাবের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। হতে পারে বাংলাদেশের কাছে এগুলো নতুন বলে এখনই সিদ্ধান্ত জানানোর সুযোগ নেই।
ভারতের এই প্রস্তাব কার্যকর হলে বাংলাদেশের জন্য বৃহত্তর অর্থনৈতিক অঞ্চলে যুক্ত হওয়ার সুযোগ বুঝতে অর্থনীতিতে পাকা হওয়া জরুরি নয়। সাধারণ যোগ-বিয়োগের জ্ঞানেই তা বোঝা সম্ভব। এরপরও আঞ্চলিক রাজনীতি ও উপ-আঞ্চলিক কূটনীতির কিছু বিষয়আশয় থেকেই যায়। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে এটি শেখ হাসিনার ভারতে শেষ সফর হতে পারে। তাই এ সফরে সরকারের প্রয়োজন হবে প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি দেখানো। আলোচিত আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের প্রশ্ন রয়েছে। এর বাইরে অবকাঠামো নির্মাণ, কল্যাণমূলক কর্মসূচি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রাজনৈতিক সুফল পেতে ঢাকার আরো চাওয়া আছে। যে কারণে ভারতীয় বিশ্লেষকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরকে তার আগামী নির্বাচনের জন্য আলাদা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় উদ্বোধন করা হয়েছে কয়লানির্ভর রামপালের মৈত্রী বিদ্যুৎকেন্দ্র। কুশিয়ারা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়টি ছাড়া অন্য সমঝোতাগুলোর ক্ষেত্রে দুই প্রধানমন্ত্রীর প্রতীকী কূটনীতির রহস্য অবশ্যই বোধগম্য। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও দূরদর্শনের মধ্যকার সহযোগিতা কিংবা রেলকর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে সমঝোতা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের উপস্থিতির জন্য ঝুলে থাকার মতো বিষয় নয়। প্রায় এক যুগ ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানিবণ্টন হচ্ছে না, সেটি অনেকটা আগাম ফয়সালার মতো। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রশ্নে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের আলোচনা এবং ভারতীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করার কাজে প্রধানমন্ত্রী আপাতত অনেকটাই কামিয়াবি হয়ে ফিরেছেন।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়