মিতু হত্যাকাণ্ড : আদালতে চার্জশিট দাখিল, শুনানি ১০ অক্টোবর

আগের সংবাদ

নতুন ৮ নদীর পানিবণ্টনে নজর : আলোচনায় সম্মত বাংলাদেশ ও ভারত, আগামী মার্চ এপ্রিলে ঢাকা সফরের সম্ভাবনা ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রীর

পরের সংবাদ

কবিগান ও কবিয়াল চারুচন্দ্র

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলার লোকজ সংস্কৃতিতে কবিগান একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। কবিত্বময় ছড়া-ছন্দ, সুর, তাল, লয়, অলংকরণযোগে, তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টি করে আসরে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীর মনোযোগ আকর্ষণ করে যে গান গাওয়া হয়, সেই গানকে কবিগান বলা হয়। যে ব্যক্তি ধীশক্তি বলে মুখে মুখে ছড়া আকারে ছন্দে পাঁচালি বলেন, ও সুর, তাল, লয়যোগে পদ রচনা করত গান আকারে পরিবেশন করেন বা করতে সক্ষম তাকে কবিয়াল বা কবি-সরকার বলা হয়। এ অর্থে কবিয়াল বা কবি-সরকার এবং কবি গায়ক এক নয়। গায়করা মূলত কবি-সরকার রচিত পদ গেয়ে থাকেন। আর কবিয়াল বা কবি-সরকার নিজের সৃষ্ট পদ এবং অন্যের পদও পরিবেশন করেন। এ অনুষঙ্গের চারুচন্দ্র একজন কবি-সরকার এবং গায়ক। তাকে আমরা কবিয়াল চারু সরকার হিসেবে চিহ্নিত করি। তার প্রকৃত নাম চারুচন্দ্র মণ্ডল।
পরম্পরা : প্রাচীন চর্যাপদের ধারায় এসেছে কীর্তনযুগ। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্য প্রভাবিত কীর্তন পদাবলির ধারার পুষ্ট হয়েছে ভক্তিগীতিধারা। এ ভাব-তরঙ্গে অষ্টাদশ শতকে বাউল বা ভাবগান ধারার আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাউলরা গানে গানে তার অটল মানুষ, অধর মানুষ বা মনের মানুষের সন্ধান করে থাকেন। এই গানের আসরে বাউলরা একক পদ পরিবেশন করেন, আবার দুটি পক্ষ হয়ে ভক্তিধারার গানের মাধ্যমে ছুতমার্গ, জাতিভেদ, শাস্ত্রাচার বিষয়ে ছওয়াল জবাব পরিবেশন করেন। একদিকে সাম্য ও মানবতাবাদের শিক্ষা, অন্যদিকে ভেদবুদ্ধি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এদের ছিল উচ্চারণ। কীর্ত্তন, সারি, জারি, ভাটিয়ালি ভাসান প্রভৃতি সুরের গানের ধারার মতো বাউল সুরের একটা নিজস্ব ঘরানা আছে। বাউলরা সংসারধর্মে অনাসক্ত হয়ে থাকেন। গানই এদের উপাসনা। গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ সমাজচিত্র তুলে ধরাও এদের কাজ। এক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থান দেখা যা এই ধারার অন্যতম প্রবক্তা ফকির লালন সাঁই (১৭৭৪-১৮৯০) এর পদে। রামানন্দ, কুবীর গোঁসাই, নাভা চণ্ডাল, রবীদাস চামার প্রমুখ গ্রাম্য সমাজ সংস্কারক ভাব-বাউল ধারায় লালনের অগ্রণী পথিক।
কবি গানের ধারা : অষ্টাদশ শতকে বাউল ধারা থেকেই সৃষ্টিপুষ্ট ও পালিত হয়েছে কবি-তর্জ্জা গানের ধারা। পৌরাণিক কাহিনীর বাইরে এসে যুক্তি-তর্কের দ্বারা দুপক্ষের মুখোমুখি অবস্থান থেকে বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ এ গানের উপজীব্য। অনেক সময় বাকবিতণ্ডা, খিস্তি-খেউড়ের ঘটনাও ঘটেছে। এই গানকে তজ্জাপালা গানও বলা হয়। ধর্ম, শাস্ত্রতর্কসহ সামাজিক নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে কবিপালা গান অনুষ্ঠিত হয়।
কবিগান ও কবি-সরকার : সাধারণত মানুষের বিনোদন, শিক্ষা ও সচেতনতার জন্য কোনো পূজা-পার্বণ উপলক্ষে বটতলা, পূজাখোলা বা খোলা মাঠে কবিপালা গান পরিবেশন করা হয়। গ্রামগঞ্জে সচরাচার মধ্যরাত থেকে কবিগান শুরু হতো এবং সকাল পর্যন্ত গান চলতো। বিশেষ করে কালীপূজাদিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই পালা গানের গাইয়েদের অধিকাংশ গ্রামের অশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত তবে স্বশিক্ষিত হয়ে থাকেন। কবিতার ছন্দে কথা বলে তাৎক্ষণিক সুর করে কবি গায়কগণ দ্বারা গীত হয় বলে এ গানের নাম হয়েছে কবিগান। যারা মেধা-মনন দ্বারা স্বভাবসুলভভাবে কাজটি সম্পন্ন করেন তারা কবিয়াল বা কবি-সরকার নামে পরিচিত হন।
তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা কেন্দ্রিক অঞ্চল ছিল কবিগানের প্রাণকেন্দ্র। সাধারণত সমাজের উপেক্ষিত তবে উদীপ্ত শ্রেণির প্রতিভাবান স্বল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত শিল্পীগণের কণ্ঠে এ গান জেগেছে। পল্লীবাসীর প্রাণের গান হয়ে উঠেছিল কবি/তর্জ্জাগান। বাঙালিদের পাশাপাশি ফিরিঙ্গি অ্যান্টনিসহ বিদেশিদের কেউ কেউ হয়ে উঠেছিল কবি-সরকার।
গোড়ার কথা : জানা গেছে, গোঁজলা গুই ছিলেন কবিগানের ধারার পূর্বসূরি। তিনি ভারতচন্দ্র রায়গূণাকরের সমসাময়িক ছিলেন। তার শিষ্য রঘুনাথ দাস, রঘুনাথের শিষ্য দাসু রায়, নৃসিংহ, হরু (হরি?) ঠাকুর প্রমুখ। হরু ঠাকুরের এক শিষ্য কবিয়াল ভোলা ময়রা অপর শিষ্য রামপ্রসাদ ঠাকুর। রামের শিষ্য রাম বসু প্রতিভাধর কবিয়াল ছিলেন বলে জানা যায়। ভোলা ময়রার একটি পদ এখানে উদ্ধৃত করা হলো।

‘ময়মনসিংহের মুগ ভালো, খুলনার ভালো কই।
ঢাকার ভালো পাতাক্ষীর, বাঁকুড়ার ভালো দই\
কৃষ্ণনগরের ময়রা ভালো, মালদহের ভালো আম।
উলোর ভালো বাঁদর পুরুষ, মুর্শিদাবাদের জাম\
রংপুরের শ্বশুর ভালো, রাজশাহীর জামাই।
নোয়াখালীর নৌকা ভালো, চট্টগ্রামের ধাই\
দিনাজপুরের কায়েত ভালো, হাবড়ার ভালো শুঁড়ি।
পাবনা জেলার বৈষ্ণব ভালো, ফরিদপুরের মুড়ি\
বর্ধমানের চাষী ভালো, চব্বিশ পরগনার গোপ।
গুপ্তিপাড়ার মেয়ে ভালো, শীঘ্র-বংশলোপ\
হুগলির ভালো কোটাল লেঠেল, বীরভূমের ভালো বোল।
ঢাকের বাদ্য থামলেই ভালো, হরি হরি বোল\’
এই পদটি শ্লোক আকারে গ্রামবাংলার প্রবীণদের মুখে মুখে আজো শোনা যায়। পূর্ব বাংলার খ্যাতিমান কবিয়াল সাধক কবি ভবা পাগলা, রামু মালী (ময়মনসিংহ), বিজয় দত্ত, গঙ্গামণি দাসী (বরিশাল), নারায়ণ বালা (ফরিদপুর) প্রমুখ। সাধক কবিয়াল বিজয় সরকার সমাজ সচেতনতার পাশাপাশি বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব ও আধাত্মিকতার বিষয়ে বহু গান রচনা করেছেন, সুর সংযোজন করে কবিগানকে একটি সুরের ধারায় দাঁড় করিয়েছেন। যেমন, ‘পোষা পাখি উড়ে যাবে রে, সজনী একদিন ভাবি রাই মনে…।’ ‘যারে হারিয়েছি বিদিনে, তারে আর কি দেখা পাব জীবনে…।’ প্রভৃতি তার বিখ্যাত গানগুলো বহু প্রবীণের মুখে মুখে আজো প্রচলিত। নড়াইলে ডুমুদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বিজয় সরকারের সতীর্থ ও শিষ্য ধারায় বহু কবিয়াল ও গায়ক তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে বিজয়-রসিক-রাজেন-নকুল দত্ত সরকার ছিল কবিগানের অন্যতম জুটি। এদেশে জন্মেছেন অসংখ্য কবিয়াল ও কবি গাইয়ে। যেমন- রসিক সরকার (রামপাল), বিজয়নারায়ণ আচার্য, নিশিকান্ত, অসীম সরকার, এ ধারায় দেবেন্দ্রনাথ সরকার (গাইন), সারদা বিশ্বাস (পোড়াকাটলা-আড়পাঙ্গাশিয়া, শ্যামনগর সাতক্ষীরা), কালাচাঁদ, অশ্বিনী সরকার (জোড়সিং), অহিধর সরকার (কালিগঞ্জ), গৌর সরকার মোংলা, প্রিয়নাথ, জয়দেব, শরৎ সরকার (বটিয়াঘাটা), নেত্রকেনার মদন ঠাকুরসহ উল্লেখযোগ্য বহু কবিয়ালের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। বলা যায় ১৯৫০/৬০/৭০/৮০-এর দশকে এদের বহু সতীর্থ এবং শিষ্য কবিয়াল হয়ে বাংলার গ্রামগঞ্জের মানুষের মাঝে কবিত্বকলার দ্যূতি ছড়িয়েছেন। এ অনুষঙ্গে আলোচ্য কবিয়াল চারুচন্দ্র সরকারের প্রথম গুরু ছিলেন তার কাকা অভয়চরণ (মণ্ডল) সরকার (পাতাখালি) দ্বিতীয় গুরু মহেন্দ্র সরকার (আমাদী, কয়রা)। পরে চারুচন্দ্র বাগেরহাট জেলার মোল্যাহাট উপজেলার চুনখোলা গ্রামের কবিয়াল অনাদী সরকারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং গুরুগৃহে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। অনাদী সরকারের কাকা কবিয়াল বড় রাজেন সরকার। বিজয় সরকার রাজেন সরকারের কাছেও ন্যাড়া বাঁধেন।
জীবনপঞ্জি : কবিয়াল চারুচন্দ্র মণ্ডলের (জ. ০৯/০১/১৯৫০ খ্রি.), পিতা কমল চন্দ্র মণ্ডল, মাতা আহল্লাদিনী দেবী, স্ত্রী ফুলকুমারি। ছেলে- তন্ময় মণ্ডল, পেশা শিক্ষকতা, কবি গায়ক, মেয়ে ভারতী গৃহিণী। জন্মস্থান সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার পাতাখালী গ্রামে। শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ (ইনএড)। তিনি গ্রামের পাঠশালা, প্রাইমারি শিক্ষা শেষে পূর্ব পাতাখালী হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৬৬ খ্রি. এসএসসি পাস করেন। পরে যশোর কলেজ শিক্ষা শেষ করেন। চারুচন্দ্রের পেশা শিক্ষকতা। আর পারিবারিক পরিবেশ থেকে পাওয়া নেশা, কবি কীর্তন পালা গান গাওয়া। তিনি প্রথম জীবনে মহেশ্বরীপুর ও নওয়াবেঁকী হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৯ সালে প্রাইমারি স্কুলে যোগদান করেন এবং ২০০৭ সালে শ্রীফলকাটি (শ্যামনগর উপজেলা) প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষক থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর জীবনে কবিগান অপেক্ষা লেখালেখি বিষয়ে বেশি করে জড়িয়ে পড়েন।
লেখাগ্রন্থ : (১) নকিপুর জমিদার বাড়ীর ইতিহাস (২০০৭), (২) কাব্যগ্রন্থ : পত্রাঞ্জলি। (৩) ভারতমৃতম (ধর্মীয় প্রন্থ), (৪) সুন্দরবনের ইতিহাস ঐতিহ্য, (৫) আদর্শ শিশু পাঠ। তিনি নবযুগ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকার অনুমোদিত সদস্য। কবিয়াল চারু সরকার : সুদর্শন এবং সুঠামদেহী পুরুষ চারুচন্দ্র। ১৯৭৬ খ্রি. থেকে মঞ্চে কবিগান গাওয়া শুরু করেন। বিভিন্ন আসরে তিনি অহিধর, সরকার, অশ্বিনী সরকার, গৌর মালো সরকার, দেবেন্দ্রনাথ গাইন সরকার, সারদা বিশ্বাস সরকার, হরিবর সরকার (খেজুরডাঙ্গীতলা), মনোরঞ্জন (মৈশডাঙ্গী, বটিয়াঘাটা), শংকর, রসিক সরকার (রামপাল), নারায়ণ সরকার, গুরু অনাদি প্রমুখ কবি সরকারের সঙ্গে গান করেছেন। কবিয়াল চারুচন্দ্র ২০০টির অধিক কবিপদ রচনা করেছেন, যেমন-
এক মহাশক্তির শক্তি নিয়ে, কেন এত দলাদলি!
হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, কেন এত বলাবলি।
কেন এত দলাদলি?…।

এই নীল দরিয়ার মাঝি তুমিরে,
মাঝি পার করে নাও এসে।
বিশাল বৈতরণী সিন্ধু কূলে রে,
আমি একা বেলা শেষে,
সন্ধ্যা বেলায় নদীর কূলে দাঁড়িয়েছি এসে…।

আমি অনেক দিন রয়েছি গো বন্ধু
আর কতদিন রব,
এই অজানা অচেনা দেশে রে
আর কতকাল কাটাব?…।

ভবে মা খাওয়া এই এতিম শিশু মা,
ওমা নজর করে রাখিবে,
যেন চরণ ছাড়া করো না মা, আর কেবা দেখিবে।…

এরূপ বহু পদ তিনি রচনা করেছেন। বিভিন্ন কবি আসরে পরিবেশন করেছেন। এর পাশাপাশি শ্রোতাদের অনুরোধে বিজয়, রসিক, অনাদি, রাজেন প্রমুখ শ্রোতানন্দিত কবি সরকারগণের পদ বিভিন্ন আসরে পরিবেশন করেছেন। কবিগানের আসর বর্তমানে তেমন চোখে পড়ে না। শ্রোতাদের রুচিরও পরিবর্তন এসেছে। বাংলার লোকজ সংস্কৃতির এ ধারাটি হারাতে বসেছে। বয়সে বার্ধক্যের কোটায় পৌঁছালেও ভারী শরীর নিয়ে কবি গানের আসরে না উঠলেও এখনো আদর্শ শিক্ষক ও কবিয়াল চারুচন্দ্র মণ্ডল অদম্য আগ্রহে গান, কবিতা ও গবেষণামূলক লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়