২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু : হাসপাতালে ভর্তি ৩৫৩

আগের সংবাদ

সমান সুযোগের রূপরেখা নেই : ইসির রোডম্যাপ

পরের সংবাদ

ডলারের অভিন্ন দরে ভিন্ন পথে বাজার

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : স্থিতিশীলতা আনার জন্য ডলারের দর বেঁধে দেয়া হলেও উল্টো চিত্র বাজারে। গতকাল বুধবার ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০৬ টাকা ৯০ পয়সায় ডলার কেনাবেচা করেছে। মঙ্গলবারও তা ছিল ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা। একদিনের ব্যবধানে এদিন ডলারের দর বাড়ে ১০ টাকারও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে এতদিন যে স্থিতিশীলতা এসেছিল, তা অনেকটাই এলোমেলো হয়ে গেছে নতুন এক সিদ্ধান্তে। এই অবস্থায় ডলারের বাজারে তিন ধরনের চাপ তৈরির আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, একদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে আমদানি পণ্যের পাশাপাশি আমদানিনির্ভর শিল্পপণ্যের দাম বাড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে পণ্য ও জ্বালানি মূল্যের উল্লম্ফনের কারণে দেশে দেশে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার যে অবমূল্যায়ন সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা থেকে বাদ নয় বাংলাদেশও। করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে যায়। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। এ কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সেই পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু আগস্ট থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে দাম।  
প্রায় দেড় বছর ডলারের দর ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল থাকলেও গত বছরের আগস্ট থেকে বাড়তে বাড়তে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে তা উঠে গেছে ৯৬ টাকায়, কিন্তু খোলাবাজারে একপর্যায়ে কেনাবেচা হতে থাকে ১২০ টাকায়। সেখান থেকে কিছুটা কমলেও ডলারের দর নিয়ে উদ্বেগ এখনো যায়নি। তবে চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ফের বাড়তে শুরু করেছে। একইসঙ্গে আমদানি ব্যয়ও কমা শুরু করেছে। তবে এর মধ্যেও গত ২৬ মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়নের ঘরে নেমে গেছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতদিন সফলভাবে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের

সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে ডলারের দর বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। কিন্তু ডলার সংকট প্রকট হওয়ায় সরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি খাতের আমদানি ব্যয় মেটাতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দরে ডলার সংগ্রহ করছিল। এ দৌড়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও অংশ নিয়ে তারাও ১০৮ টাকা দরে ডলার কেনে। এসব ব্যাংক চড়া দামে সংগ্রহ করা ডলার করপোরেট সেলের আওতায় আমদানি ব্যয় মেটাতে আগাম বিক্রি করছিল ১১১ থেকে ১১২ টাকা দরে। এতে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে বাফেদার কারিগরি কমিটি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে ডলার সংগ্রহের দাম বেঁধে দেয়ার সুপারিশ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতিতে গত রবিবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাফেদা এক বৈঠকে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ ও রপ্তানি বিল কেনার দর বেঁধে দেয়া হয়। নতুন দর অনুযায়ী বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা এবং রপ্তানি বিল ৯৯ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকরের তিন দিনেও ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি।
জানতে চাইলে বাফেদার চেয়ারম্যান এবং সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মো. আফজাল করিম বলেন, বাফেদা ও এবিবি যৌথভাবে বৈঠক করে ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সে প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা এবং বাণিজ্যিক রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বিল নগদায়ন হবে প্রতি ডলার ৯৯ টাকায়। দুটির ওয়েট অ্যান্ড এভারেজ করে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করা হবে। এখন যদি কোনো ব্যাংক প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স বেশি কিনে তাহলে তার ডলার বিক্রির রেট বেড়ে যাবে। আর যখন রপ্তানি বিল বেশি কিনবে তখন রেট কমে যাবে। এটা স্বাভাবিক।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা আন্তঃব্যাংক ডলারের বেচাকেনার গড় দাম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ডলারের গড় ক্রয়মূল্য ১০২ টাকা ৩৭ পয়সা, যা মঙ্গলবার ছিল ১০১ টাকা ৬৭ পয়সা। গড় বিক্রয়মূল্য ১০৬ টাকা ৯০ পয়সা, যা গত মঙ্গলবার ছিল ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা।
এর আগে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের আন্তঃব্যাংক লেনদেনের মূল্য বদল করে। আগে সরকারের বিভিন্ন আমদানি বিলসহ বাজারে ডলার সরবরাহ ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে রেটে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করত সেই রেটই প্রকাশ করত এবং সেটাকেই আন্তঃব্যাংক ডলার রেট বলা হত। তবে মঙ্গলবার থেকে এটি পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দর ‘নয়’, ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে লেনদেন করা ডলারের দর প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ‘টাকার বিনিময় মূল্য’ অংশে বলা হয়েছে, চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে এবং বাফেদার নির্দেশনা অনুযায়ী আন্তঃব্যাংক লেনদেন এবং গ্রাহক লেনদেনের জন্য টাকার বিনিময়মূল্য নির্ধারণ করছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিন এটা আর নির্ধারণ করবে না। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য গতকাল সর্বোচ্চ ১০৬ টাকা ৯০ পয়সা এবং সর্বনি¤œ ১০২ টাকা ৩৭ পয়সা দেয়া আছে। কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে নগদ ডলার বেচাকেনা হয়েছে ১১৩ থেকে ১১৪ টাকায়। অর্থাৎ, চিকিৎসা, শিক্ষা বা ভ্রমণের জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের নগদে প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১১৪ টাকা। এদিকে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের বিভিন্ন আমদানির বিলসহ বাজারে ডলার সরবরাহ ঠিক রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ থেকে প্রতি ডলার ৯৬ টাকা দরে বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাফেদার ঘোষিত দাম অনুযায়ী, এখন থেকে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১০৮ টাকায় কিনতে পারবে ব্যাংক। বাণিজ্যিক রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বিল নগদায়ন হবে প্রতি ডলার ৯৯ টাকায়। এছাড়া রেমিট্যান্স আহরণ ও রপ্তানি বিল নগদায়নে ব্যাংকগুলোর গড় (ওয়েট অ্যান্ড এভারেজ) মূল্যের সঙ্গে সর্বোচ্চ এক টাকা যোগ করে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রি করতে পারবে ব্যাংকগুলো। গত সোমবার থেকে এ দর কার্যকর হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলার বাজারে এতদিন এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত স্থিরতা ছিল। কিন্তু নতুন দর নির্ধারণের ফলে বাজার আবার অস্থির হয়ে উঠল। ডলার সংকটের কারণে বাজারে এখন এক ধরনের ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে। এই সময়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হলেই বাজার অস্থির হয়ে উঠবে। যার নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে। কেননা ডলারের কারণে নানাভাবে মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়ছে। এতে পণ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় সব আমদানি ও শিল্পপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। একসঙ্গে ডলারের দাম এত না বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে বাড়ানো উচিত। তাহলে সবার কাছে তা সহনীয় হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় রপ্তানিকারকরা পড়বেন বেশি বিপাকে। কেননা রপ্তানি বিল বিক্রি করতে হবে ৯৯ টাকা দরে। কোনো প্রয়োজনে বাজার থেকে ডলার কিনলে দিতে হবে ১০৫ টাকা বা এরও বেশি। এতে রপ্তানি খাত অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই মুহূর্তে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত না নিয়ে অদ্ভুদ-উদ্ভট একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাফেদা-এবিবি। এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই ভালো ফল দেবে না। বাজারের চাহিদা-জোগান বিবেচনায় নিয়ে একটা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে না। তার মতে, ডলারের একক দর এখন ১০৫ টাকা বেঁধে (ফিক্সড) দেয়া উচিত। রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে দরের ব্যবধান বা পার্থক্য এক থেকে দেড় টাকা (খুব বেশি হলে ২ শতাংশ) হওয়া উচিত। তাহলেই বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়